চাইবাসা মিশনে বীরসার সহপাটি ছিল অমূল্য। সে অর ফানেজের ছেলে। মুণ্ডারী ভাষা জানে। বীরসার থেকে সামান্য বড়ো। বীরসা তুই বলে সম্বোধন করতে গেলে অমূল্য তাকে শিখিয়ে দেয়—“শোনো কাউকে ‘তুই’ বল না। তুমি বলবে। তাহলে দেখবে সাহেবরা খুব অবাক হবে।” অমূল্য বীরসার একান্ত আপনজনের মতো হয়ে তাকে ম্যাপ আঁকা শেখাতে প্রবৃত্ত হল, অঙ্ক কষাতে লাগল। অবসর সময়ে বীরসাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। এইভাবে অমূল্য তাকে আপন জনের মতো কাছে টেনে নেয়। মুণ্ডা বলে তাকে ঘৃণা করে না। ইতিমধ্যে মিশনের সঙ্গে বীরসার কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। বীরসা মিশন ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হলে “অমূল্য ছুটে এল। বলল যেওনা বীরসা, একবার মাপ চাও সাহেবের কাছে। মাপ চাও।” বীরসা অস্বীকার করলে অমূল্য তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে লেখাপড়া শিখলে সে মুণ্ডাদের আরও বেশি করে উপকার সাধন করতে পারবে। কিন্তু বীরসা তখনও ওর সিদ্ধান্তে অটল। তখন—“অমূল্য ওর হাত ধরল, হেসে বলল হাত ধরলে হাত ছাড়াতে পার তুমি ? আমি তোমার বন্ধু” বোধকরি অতি আপনজন ছাড়া এমন ভালোবাসার কথা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু অমূল্য তার হাত ছাড়লে দেখে বীরসা জোরে আরও জোরে হাত ঝাটকা মারল। অমূল্য বুঝল এ দুর্দমনীয়। একে আটকে রাখা যাবে না। তাই সে বীরসার হাত ছেড়ে দিয়ে তার মঙ্গল কামনা করে তাকে বিদায় দিয়েছিল।

পরবর্তীকালে অমূল্য তার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে রাঁচি জেলের মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট পদে নিযুক্ত হয়। বীরসা মিশনের শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে গ্রামে ফিরে কয়েক বছরের মধ্যে মুণ্ডাদের কাছে অবতার রূপে প্রতিপন্ন হয় এবং ইংরাজ সরকারের বিরাগভাজন হয়ে বন্দি অবস্থায় রাঁচি জেলে এসে হাজির হয়। পূর্বের বন্ধুত্বের সুলভ আচরণে অমূল্য তার হাত ধরতে যায়। কিন্তু বীরসা তাকে প্রত্যাখান করলে অমূল্য রাগে না। শুধু বলে—“তুমি যে একদিন মস্ত বড়ো হবে আমি জানতাম ।” জেল কর্মচারীদের মধ্যে কমিশনার সাহেব ভালো মুণ্ডারীর জানা লোক খুঁজছিল। তার মধ্যে অমূল্যকে পেয়ে বীরসার দেখভালের দায়িত্ব তার উপর দিয়েছিল ফলে বীরসার প্রথম দু’বছরের কারাদণ্ডে অমূল্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। বীরসার বিরুদ্ধে সরকার যতরকমের কৌশল অবলম্বন করেছিল তা সবই গোপনে অমূল্য বীরসার কাছে পাচার করেছিল। কিন্তু বিনিময়ে সে কিছুই প্রত্যাশা করেনি। শুধু সে বীরসার বন্ধুত্ব লাভ করতে চেয়েছিল। অবশ্য অমূল্য নিজের এই অন্যায় কৃতকর্মের জন্য সজাগ ছিল।–“বীরসা যত কথা তোমাকে বললাম, তাতে আমার চাকরি চলে যেতে পারে, কিন্তু তোমাকে বলা আমার কর্তব্য।” অমূল্যর এ কর্তব্য নিছক আবেগমথিত নয়। অসহায় নির্যাতিত মুণ্ডাদের মুক্তির কামনায় তার এ দুষ্কর প্রয়াস। আর এই অবহেলিত নির্যাতিত মুণ্ডাদের প্রতি সহমর্মিতা বোধ থেকেই সে জেল থেকে গোপনে যোগাযোগ রাখত কলকাতার ব্যারিস্টার জেকবের সঙ্গে, গোপন চিঠিতে সরকারি কার্যকলাপ সব ফাঁস করে দিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে। মূলত অমূল্যর এটি ছদ্ম দেশ সেবা।

দু’বছর পর বীরসা জেল থেকে মুক্তি লাভের পরও তার ক্রিয়াকলাপ থেকে একবিন্দু সরে থাকেনি। সে সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করার জন্য গোপনে প্রস্তুতি চালাতে থাকে। এদিকে ইংরেজরাও বীরসার ওপর চরমতম আঘাত হানতে থেমে থাকেনি। তারাও গোপনে প্রস্তুতি দিয়ে বলেন উদ্ভূদ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন। বীরসাইতদের সঙ্গে ইংরেজদের সংগ্রামে প্রতিদিন হতাহতের খবর অমূল্য গোপনে ‘বেঙ্গলী’, ‘স্টেটসম্যান’ প্রভৃতি পত্রিকায় ছাপানোর জন্য রিপোর্ট পাঠাত, ফলে সে বিদ্রোহের মূল্যায়ন ও জনমত গঠনে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিল। বীরসা যখন দ্বিতীয়বার ধরা পড়ে জেলে আসছে তখন অমূল্য বিশ্বাস করেনি। তবে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী জেলখানার আলাদা একটি ঘর পরিষ্কার করল, এবং পুলিশের গুলিতে যে সকল মুণ্ডারা আহত হয়ে এসেছিল তাদের চিকিৎসার ভার অমূল্য নিয়েছিল। জেলের ভিতর অকথ্য অত্যাচারে বীরসার প্রাণনাশের চেষ্টা চলছে সেকথা অমূল্য আগেই বুঝতে পেরেছিল। তাই সরকারি হুকুম উপেক্ষা করে কেবল ডি.সি.-এর অনুমতিক্রমে বীরসার সঙ্গে দেখা করে তাকে সতর্ক করে দিয়েছে–“মাগুরাম ওয়ান্ডার যা দেবে, তাছাড়া কোনো ঔষধ, খাবার, খাসনা বীরসা, জল ও খাসনা।” বীরসাকে আশ্বস্ত করতে অমূল্য ভোলেনি।–“আজ পয়লা জুন, তোদের কেস নিয়ে খুব হইচই উঠে গেছে, এবার বোধ হয় ফয়সালা হবে।” কিন্তু আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও অমূল্য শেষ রক্ষা করতে পারল না। ৯ জুন ১৯০০ খ্রিঃ বীরসা রক্তবমি করে মারা গেল। অমূল্য দিশেহারা হয়ে পড়ল, বীরসার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে অমূল্য জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে মুণ্ডাদের জন্য ভালোভাবে স্নান-খাওয়ার, থাকার ব্যবস্থা করল, আর সেই বীরসা মারা গেল। এককথায় বীরসার মৃত্যুতে অমূল্য ভেঙে পড়েছিল।

উপন্যাসের উপসংহার অংশে অমূল্যের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়। উপসংহার অংশটি মূলত অমূল্যের নোট বই-এর সূচনা অংশে সে লিখেছে—“আজ ১৯০১ সাল শেষ হল। নোট বইটা আমাকে শেষ করতেই হবে। আমার জীবনকালে বীরসা, যদি কেউ তোমার আশ্চর্য অপরূপ কথা জানতে চায় তাকে খাতাটা দেব। যদি না চায়, তাহলে এমন ব্যবস্থা করে যাব যাতে ভবিষ্যতে যদি কেউ তোমার কথা জানতে চায়, সে আমার নোটবই থেকে সব জানতে পারবে” —আসলে অমূল্যের এ নোটবই বীরসার আত্মার শান্তি কামনার জন্য নিহিত মূলত ব্যারিস্টার জেকবের দেওয়া তথ্যকে অবলম্বন করে বীরসা লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছিল। জেকবের দেওয়া তথ্য পড়তে পড়তে সে বিষাদ ভারাক্রান্তচিত্তে বীরসার উদ্দেশ্যে বলেছে—“তোমার সন্তানরা যদি তিরই ছুঁড়ল তবে এমন তির ছুঁড়ল না কেন যাতে প্রতিবার শিকার মরে ?” বড়ো কাছের মানুষ না হলে এমন কামনা কেউ করতে পারে না, অমূল্য যে বীরসার কত কাছের মানুষ তা তার বক্তব্যেই সুপরিস্ফুট—“বীরসা! আমার অনাথ আশ্রমের জীবনে ভালোবাসিনি কাউকে। তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসার মানুষ। তুমি আমার বন্ধু, ভাই সাথি, তুমি জেলে, মুণ্ডারা জেলে, তুমি আমাকে চিনতে চাইতে না আমাকে বিপদে জড়াবে না বলে।”

অমূল্য মুণ্ডাদের কৃতকর্মে বড়ো বিস্ময়বোধ করত। তাদের বীরত্ব ও সাহস দেখে তাদের কাছে নিজেদের বড়ো ছোটো মনে করত। তাই তো বীরসার আত্মার প্রতি তার শ্রদ্ধা নিবেদন—“তুমি জেলে, তোমার সন্তানরা জেলে, আমি যেন অশুচি হয়ে থাকতাম।” কিন্তু অমূল্যর কোনো ক্ষমতা ছিল না কিছু করবার। সে যে সরকারের বেতনভোগী কর্মচারি। তাই মুণ্ডাদের ওপর যখন অত্যাচার চলত অমূল্য নিজের রুদ্ধ আবেগকে অবদমিত করতে না পেরে ছুটে গিয়ে রাতে মুণ্ডাদের সেলে গিয়ে কান পেতে শুনত। মর্মে মর্মে অনুভব করত মুণ্ডাদের যন্ত্রণাকাতর চিৎকার। জেলখানার ডাক্তার হিসাবে চাকরি করার সুবাদে অমূল্য জানতে পেরেছিল বীরসার মৃত্যু হয়েছে আর্সেনিক প্রয়োগে । নিরুপায় অমূল্য সেদিন বীরসার উদ্দেশ্যে ভেবেছিল—“তোমার মৃত্যুর রহস্য নিয়ে প্রশ্ন জাগুক। প্রতিবাদ উঠুক। তাই চেয়ে চেয়ে আমি অনেক পাথরের দেয়ালে মাথা ঠুকেছিলাম।” বীরসার মৃত্যুর পরেও আরও কিছু বছর অমূল্য চাকরিতে বহাল ছিল কারণ মুণ্ডাদের শেষ পরিণতি কী হয় তা জানার জন্য। বিচারে যেদিন গয়া, সুখরাম আর সানরের ফাঁসি হয় সেদিন অমূল্য কাজে ইস্তফা দিয়েছিল। অমূল্যর মনে ক্ষোভ মুণ্ডারা তাদের জীবন দিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। কিন্তু অমূল্য তাদের বন্ধুস্থানীয় হয়ে কী করতে পেরেছে। নিজের অসহায় অবস্থার কথা সে এমন করে জানিয়েছে—“আমার যে আর কিছু করার নেই। আমি যে আর কিছু করতে পারি না।… আমি না পারি তির ছুঁড়তে, না পারি বলোয়া চালাতে, আমি শুধু এইটুকু পারি, বাকি জীবনটা বুঝতে চেষ্টা করতে।”

চাকরি ছেড়ে সে গিয়েছিল চালকাড়ে, গিয়েছিল বোর্তাদি, দেখে এসেছিল সেই ছাতিম গাছ, যে ছাতিম গাছের গোড়ায় বীরসা বাঁশি আর টুইলা বাজাত, সে দেখে এসেছে সেই ছাতিম গাছের গোড়ায় সালী বসেছিল। আর তার ছেলে পরিবা ধুলা মেখে খেলা করছিল। অমূল্য সেই ডুরান্ডা নদীর তীরে একটা চ্যাটালো পাথরের উপর বসে নোটবই লিখছিল আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে দেখছিল—“সামনে নদীর দিকে চেয়ে বসে আছে এক ভারতী মুণ্ডা মা।” অমূল্য বীরসাকে জানিয়েছে সেই ভারতী মুণ্ডানী হল বীরসার মা করমি। নোটবই এ অমূল্য আরও লিখেছে— “রোজ সকালে কোমতার মেয়ে ওকে হাত ধরে নিয়ে আসে, এখানে বসিয়ে দিয়ে যায়। দুপুরে কোমতার বউ ওকে খাবার এনে খাইয়ে যায়। রসার মায়ের স্থির বিশ্বাস বীরসা এজীবনে ফিরে আসবেই আসবে।

মূলত অমূল্য বীরসার বন্ধু স্থানীয় হয়েও আপন মহত্ব গুণে বীরসার বিদ্রোহের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে সে উপন্যাসের মধ্যে ধরা দিয়েছে। জেলখানায় সে ছায়ার মতো মুণ্ডাদের পাশে পাশে থেকে তাদের সাধ্যমত সাহায্য করেছে। জেলখানার মধ্যে যাদের অত্যাচারে মৃত্যু হয়েছে, সেই মৃত্যুর রিপোর্ট সেই তৈরি করেছে এমনকি বিচার শেষে ফাঁসি, দীপান্তর, কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে বীরসার আন্দোলনে ভাটা পড়লেও কাজ শেষ হয়নি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে বীরসার আশৈশব খেলে বেড়ানো অরণ্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছে। দণ্ডিত মুণ্ডাদের শোকার্ত আত্মীয় পরিজনদের সে সান্ত্বনা দিয়েছে। এককথায় উপন্যাসের মধ্যে অমূল্য একজন জাগ্রত বিবেকবান পুরুষ। সে বিবেকের তাড়নায় অন্তর্দাহে জ্বললেও বিবেকের কাছে মহান রূপে বিরাজ করছে।