দেশ-জাতি ও জাতীয়তাবোধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাবনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত তাঁর ছাত্রজীবন থেকেই বুঝতে শুরু করেছিলেন। বরানগরের চটকল আন্দোলন থেকে শুরু করে আসানসোল-ধানবাদ-ঝরিয়ার কয়লাখনি অঞ্চল ও তার বিস্তৃর্ণ রুক্ষ প্রকৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অমিতাভকে জীবনের পাঠও তখন দিয়ে দিয়েছে। এর প্রায় সমসাময়িককালে ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ৮০ জন সদ্য গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের শহীদ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা কবি অমিতাভর চৈতন্যকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৯ এ যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে যাওয়া। এসময়ই (১৯৫৪-১৯৭৫)-এর ভিয়েতনাম যুদ্ধে শুনতে পেয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের বিজয়বার্তা। এই সমস্ত ঘটনাগুলি কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে অমিতাভর মেধা ও মননের যোগ সাধন করেছিল। নিজের অবস্থানগত প্রভেদকে কমিয়ে এনে এইসব সাধারণ মানুষগুলির সঙ্গে অমিতাভ জলের মতো মিশে গিয়েছিলেন। অনুভব করেছিলেন এদের দুঃখ-রাগ-ক্ষোভ-হতাশা-লাঞ্ছনাকে। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কবি বলেছেন, “বছরের পর বছর চোখের ওপর দেখেছি, সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে কি অকল্পনীয় লড়াই চালিয়ে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের বরানগরে একটির পর একটি উপনিবেশ গড়ে তুলতে। চটকল মজুরদের মহল্লায় গেছি বহুবার। অল্প বয়সেই তাঁদের একটি দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম…. স্কুলের ছাত্র থাকা কালেই আমরা কলেজস্ট্রিটের রাস্তায় এক মিছিলে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলাম ছাত্র শহীদ‌ রামেশ্বরের শব। আমাদের সামনেই পুলিশের গুলিতে হুমড়ি খেয়ে রাজপথে কলকাতার সঙ্গে সংগ্রামী ভিয়েতনামের রক্তরাখী বেঁধে দিয়েছিল একটি তরুণ ………..ওই সময় থেকেই আজ পর্যন্ত কবিতা বা কবিতা নামধেয় যাকিছু লেখার চেষ্টা করেছি, তার মূল কেন্দ্রে রয়ে গেছে মানুষ।” এরপর থেকে কবিতা রচনার বিভিন্ন ধারায় চিন্তায় মননে সুচিন্তিত ভাবে নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন কবি অমিতাভ, রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্ত পরিস্থিতিতেই তিনি নিজেকে তোমাদেরই লোক নামে চিহ্নিত করেছেন।

কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের যথার্থ আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল তখন যখন কল্লোল যুগ শেষ হয়ে কৃত্তিবাসী যুগ শুরু হচ্ছে। দীর্ঘদিনের সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামোর প্রতি আস্থাহীন মানুষ বদলে নিতে চাইছে তাদের সমাজব্যবস্থাকে। চিরাচরিত গান্ধিবাদ, সুভাষচন্দ্রের আদর্শ তখন ফিকে হয়ে গেছে। সে জায়গায় নাগরিক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ কৃষক ও শ্রমিকের স্বপ্ন আর বাস্তবে জায়গা করে নিচ্ছে মাও-সে-তুং, লেনিন। মার্কসীয় শ্রেণি দ্বন্দ্ব-সাম্যবাদী নীতির স্থিতাবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তখন অপরিসীম। কবি অমিতাভও এই অবস্থানের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। কিন্তু সামাজিক বদল তিনি তথাকথিত এই স্থিতাবস্থায় দাঁড়িয়েও চেয়েছেন। ‘কবিতা পরিচয়’ পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তি ও দু-দুটি যুক্তফ্রন্টের উত্থান-পতন এই অস্থিরতাকে তখন ১৯৭০-এর গোড়ায় এক দিশাহারা জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। একই সঙ্গে গত পনেরো বছর ধরে আমি এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন দীনকর্মী এবং মাঝারি বহরের কবিতা লেখক, প্রাণে ও কর্মে বারবার রাজনৈতিক ও সামাজিক বদল চেয়েছি।”

আসলে কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত স্বদেশ ও সময়ের তীব্র বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে লালন করেছিলেন তাঁর কবি মানসকে। যখন দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার পড়ছে, নকশালবাদী আন্দোলনের বারুদবাষ্প, বন্দুকের লড়াই ও আত্মাহুতিতে আমাদের চারপাশের পরিচিত প্রান্তর রক্তাক্ত। কবি অমিতাভ তখন সেই বধ্যভূমির রক্তাক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে একজন সৎ ও সত্যবাদী মানুষের মতোই নিজেকে এবং নিজের প্রজন্মকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে দিয়েছেন। এই প্রশ্নদীর্ণ যন্ত্রণার আগুন ‘আমার নাম ভারতবর্ষ কবিতাটির ছত্রে ছত্রেও প্রবাহিত করে দিয়েছেন কবি। “আমি তোমাদেরই লোক’ (১৯৮৬) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার নাম ভারতবর্ষ কবিতাটি প্রতিবাদ-প্রতিশোধের গভীর আগুন বুকে নিয়ে দেশ চিনিয়ে দেবার যথার্থ প্রত্যয়ে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষ তখন কোনো দেশ নয়, বন্দুক আর গুলির লড়াইয়ে, স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার সমস্ত শরীর। ভারতবর্ষের প্রচলিত মানচিত্রে তখন আর তার প্রকৃত চরিত্র ফুটে ওঠে না। নিত্য নতুন ক্ষতচিহ্ন তখন ভারতের শরীর জুড়ে তৈরি করে চলেছে আরও নতুন রেখাভাস। কবি বলেছেন,

“স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে 

আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র

তার নাম ভারতবর্ষ।”

কবিতাটির প্রথমস্তবকে ভারতবর্ষের এই নতুন পরিচয় যেন পরবর্তী প্রজন্মকে স্তব্ধ করে দেয়। সমগ্র কবিতাটি জুড়েই এরপর বর্ণিত হয়েছে চা-বাগান, কয়লা খাদান, পাহাড় অরণ্যে বসবাসকারী অসহায় মানুষের নির্যাতনক্লিষ্ট মুখচ্ছবির আভাস। এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলির প্রতি মুহূর্তের লড়াই ও টিকে থাকার আপ্রাণ প্রয়াসে, রক্তাক্ত পথচলায় যে ভালোবাসা পথ খুঁজে পায়, তার নাম ভারতবর্ষ। এ ভারতবর্ষের মাটি তাই এইসব মানুষের চোখের জলে ও মৃতদেহের হাড়ের ফসফেটে উর্বর। ‘খুনীর চেয়েও রুক্ষ্ম কঠোর মাটিকে তারা ধান উৎপাদনের উপযুক্ত করে তুলেছে এই ভাবেই। এই ভাবেই ধান উৎপন্ন করে মানুষের মুখে অন্নের জোগান দিয়ে চলেছে তারা। সবুজ সবুজ ধানের যে স্বপ্ন তারা মানুষের চোখে এঁকে দিতে পেরেছে—সেই সোনালী স্বপ্নের নাম ভারতবর্ষ।

ভারতবর্ষ এভাবে শুধু কৃষিতে নয়, বিজ্ঞানের যাদুকাঠির প্রবল স্পর্শে, নিজের অর্জিত সম্পদেরও উন্মোচন ঘটিয়েছে ‘ভাকা নাঙালের মতো পাথুরে বাঁধের গভীরে জমা করে রেখেছে গভীর ছায়া। বিশ্বের বাজারে অপরিশোধিত তেলের বিক্রয়মূল্যকে ক্রমাগত উচ্চস্থানে পৌঁছে দিয়েছে এই দেশের মাটির সম্পদ। কিন্তু অজস্র উন্নতিকামী শক্তি, আত্মপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতবর্ষের সমস্ত অন্তর সম্পদকেই তার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে। স্বার্থান্বেষী এইসব মানুষের পাশাপাশি রয়েছে দীন দরিদ্র, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিরন্তর যারা প্রতিদানের রসদ জোগাড় করে সেইসব মানুষ। তাদের প্রতিটি রক্তকণায় উজ্জীবিত যে ভালোবাসা তার নাম ভারতবর্ষ। কয়লাখনির শ্রমিক থেকে শুরু করে সুতোকলের জঙ্গী মজুর কেউই বাদ নয় কবি সৃষ্ট এই লগ্নতায়। তারা নিজেরাই নিজেদের ভাইয়ের কপাল থেকে রক্তের দাগ মুছে দিতে পারে। কবি বলেছেন,

“আমাকে বুকে করে তুলে নিতে এসেছে 

আমেদাবাদের সুতোকলের জঙ্গী মজুর। 

আমার মৃতদেহের পাহারাদার আজ 

প্রতিটি হাল বহনকারী বলরাম। 

প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর 

শোক নয় ক্রোধের আগুনে 

দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।”

এই অংশটিতে কবির সমস্ত সত্তা ক্রোধে উন্মত্ত। তিনি অনুভব করেছেন কারখানার মজুর থেকে শুরু করে কৃষক, ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতী প্রত্যেকের ক্রোধের আগুন সঞ্চারিত হয়ে গেছে তাঁর চেতনায়। পৃথিবীর—সমাজের প্রতিটি শোষিত লাঞ্ছিত মানুষের যন্ত্রণার অংশীদার তিনি। আসলে এই মানবায়িত প্রকৃতি কবির সত্তা ও অনুভবের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। সন্তান-সম্ভবা নারীর মতো করে আকাশের যে চিত্রকল্প এঁকেছেন কবি, বৃষ্টির আসন্ন জন্ম সম্ভাবনায় তা অসাধারণ বাণীমূর্তি লাভ করেছে। এই একই দৃশ্যের পাশাপাশি রয়েছে ভারতবর্ষের বুলেট ও স্টেনগানের সমকাল। বরফগলা শুভ্র গঙ্গোত্রি যে ভারতের বুক চিরে বয়ে চলেছে সেই ভারত কিন্তু বুলেটে ও স্টেনগানে ঝাঁঝরা। প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর ও মায়ের জলভরা চোখ যেন সেই শুভ্র ধারায় অবারিত। কবি বিশ্বাস করেন ক্ষমতা লোভীর দম্ভ আর অহংকারের অগ্নি উদ্‌গিরণে ক্ষতবিক্ষত, স্টেনগানের বুলেটে ঝাঁঝরা, ভারতবর্ষের মৃতদেহেও একদিন প্রাণের সঞ্চার হবে। জ্বলে উঠবে উৎসবের রাত। সমস্ত দেশের মানবসম্পদ ও নানা প্রদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অপূর্ব বৈচিত্র্য-সুষমায় নিয়ে আসবে মহামিলনের রাখী উৎসব।

“ওড়িশির ছন্দে ভারতনাট্যমের মুদ্রায়

সাঁওতালি মাদলে আর ভাঙরার আন্দোলনে 

জেগে উঠবে উৎসবের রাত।”

কবি আসলে দেখাতে চেয়েছেন লক্ষ লক্ষ ক্ষতভরা এই ভারতের শরীরকে মিথ্যা সজ্জায় সাজিয়ে তোলার জন্যই কৃত্রিম এই উৎসবের আয়োজন। কিন্তু কবি যেন ভারতবর্ষের মানবায়িত প্রকৃতির আকুল আবেদনটিকে ভুলে যান। তার ক্ষতভরা সত্তার চরম প্রকাশকে কবি বাণীমূর্তি দিয়েছেন, সেখান থেকে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে মানুষের স্বদেশ ভাবনা স্বাধীনতা ও ভারতবর্ষের চিরায়ত ধ্যানধারণা। 

“যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কল্‌জে,

ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম

মাইল-মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম

স্বদেশ

স্বাধীনতা

ভারতবর্ষ।”

সময়, সমকাল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা মানুষকে কতখানি জান্তব করে তোলে, কীভাবে ক্রমশ আপোষ করতে করতে মানুষ শুধু তার এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানের স্বপ্ন দেখে, জীবনের উষ্ণতা, স্নেহময় উত্তাপ থেকে দূরে ক্রমশ দূরে চলে যায়, সেই অনুভূতিশূন্য জীবনের প্রতি ক্ষমাহীন প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছে কবি এ কবিতায়। ‘আমার নাম ভারতবর্ষ কবিতায় কবি আসলে নিজেই হয়ে উঠেছেন একটি দেশের প্রতিভূ। স্বদেশকে দেখা, তার অনুভব, প্রতিটি যন্ত্রণাবিধ্বস্ত মানুষের আর্তিকে নিজের হৃদয়ে ধারণ করা ও সেই যন্ত্রণার কঠিন প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠবার মাধ্যমে কবি নিজেই হয়ে উঠেছেন একটি সমগ্র ভারতবর্ষ। এই ব্যাপ্ত স্বদেশচেতনা ও তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠবার প্রখর শানিত অনুভবের নামও ভারতবর্ষ, সেখানে নিহিত রয়েছে কবির আত্মিক স্বাধীনতা স্বপরিচয়ের মুগ্ধবোধ। কবিতাটিতে তাই স্বদেশচেতনার ধারাভাষ্যের সাথে সাথে প্রতিবাদের দৃপ্ত অঙ্গীকারও ধ্বনিত হয়েছে বলা যায়।