“বিদ্যাপতি ভন বুঝ রসমস্ত।

রাজা শিবসিংহ লছিমাদেবী কান্ত।।”

অর্থাৎ ‘বিদ্যাপতি বলেন এবং লছিমা দেবীর কাস্ত রসমস্ত রাজা শিবসিংহ এই রস বোঝেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে আর কোন কবির ভণিতায় এত সুস্পষ্ট আত্মপরিচয় পাওয়া যায় না। তাই বৈক্ষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি এক ব্যতিক্রমী কবি। চতুর্দশ-পঞ্চদশের মাঝামাঝি মৈথিলি-অবহট্ঠ ভাষার মিশ্রণে সৃষ্ট ব্রজবুলি ভাষাকে পাথেয় করে রাজসভার কবি হিসাবে বিদ্যাপতির যাত্রা শুরু। যেহেতু তিনি ছিলেন সভারঞ্জন কবি, তাই তিনি বিদগ্ধ, সাহিত্য রসিক, আত্মপ্রত্যয়ী কবি ছিলেন। ‘রাজসভার কবি’ এই অভিজ্ঞানে বিদগ্ধ পাঠকরা লক্ষ্য করেছেন বিদ্যাপতির পদাবলীতে রাধার স্বভাবে প্রকাশ পেয়েছে অভিজাত বিলাস, ছাপ চাতুরী। আর সমালোচক ও রসবেত্তারা লক্ষ্য করেছেন বিদ্যাপতি সুখের কবি, বিলাসের কবি, ভোগের কবি। অথচ প্রেমের গভীরতা ও অন্তর্ভেদী অনুভব বিদ্যাপতির হাতেও কত সহজেই সঞ্চারিত হয়েছে। তাঁর অভিনব সৃষ্টি রাধার বয়ঃসন্ধির পদ রচনায়, যার নেপথ্যে বৈষ্ণব ভক্তিবাদের কোন তত্ত্বাভাস নেই, কেবল নারীর উদভিন্ন রূপসৌন্দর্য দর্শনের জন্য দৃষ্টি কাতরতা আছে। এই রূপ সৌন্দর্য্য স্ফুরিত হয়েছে কেবলমাত্র পূর্বরাগ, মান, মাথুরেই নয়, তাঁর অভিসার পর্যায়ের পদেও তা সমরূপে দৃষ্ট হয়।

যৌবনে উত্তরণের ফলে কিশোরী রাধার অঙ্গ কেমন করে পরিবর্তিত হয়, চরণের চপলতা কেমন করে প্রকাশ হয়–এ সমস্ত বর্ণনা রাধার পূর্বরাগে সুপরিস্ফুট করার পর বিদ্যাপতি কাব্য রচনার সাথে সাথে শৈল্পিক দৃষ্টি নিয়ে উপনীত হয়েছেন অভিসারের পর্যায়ে। পূর্বরাগ অনুরাগের পরেই তো মিলনাকাঙ্ক্ষায় মন উন্মুখ হয়ে ওঠে। সমাজ সংসারের চোখে ধুলো ছিটিয়ে লোকচক্ষুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই তো যত কৌশল অবলম্বন, গোপনে, নিভৃতে, নির্জনে দায়িতের সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়েই তো চঞ্চল প্রেম শাস্ত হবে। তাই সবার অলক্ষ্যে শ্রীরাধার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পথে নামতে হয়, অভিসারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে থাকে কানু বিনে তার জগৎ অন্ধকার। যৌবনের চাপল্যে একদিন যেমন সে কৃষ্ণ অনুরাগিনী হয়ে উঠেছিল আজ তারই সঙ্গে মিলনে‌ উম্মাদ প্রায়, প্রিয় মিলন ব্যতীত জীবনের কোনও মানে হয় না। যত যন্ত্রণাই হোক, যত গঞ্জনা হোক, যত বিপদই হোক, থেমে থাকা নয়। কবি বিদ্যাপতিও সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে আপন প্রতিভা গুণে রাধার এই অভিসারিকার রূপ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার পর্যায়ের পদ রচনায় গোবিন্দদাস, হলেন রাজাধিরাজ। কিন্তু তাঁর গুরু কবি বিদ্যাপতি তুলনায় কিছু কম যান না। অভিসারের পদে তিনিও একচ্ছত্র। এমন মহিমময় মূর্তিতে বিদ্যাপতির লেখনীতে শ্রীরাধা মূর্ত হয়ে উঠেছে, তা দেখে আশ্চর্য হতে হয়। শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধিক্ষণ, তার পর প্রাজ্ঞ ও সুচতুরায় পরিণত রাধা আমাদের বিস্মিত করে–হতচকিত করে। বিশেষ করে রাধা যখন অভিসারে যাত্রা করে তখন তাকে দেখে মনে হয়, সে পরিপূর্ণা যৌবনবতী এবং প্রেম বিষয়েও সজাগ । তার দেহ-মন কামনায় থরোথরো, ফুলে ফুলে উঠছে আবেগ তরঙ্গ, আকুল পাগলপারা হৃদয়ে প্রেম দুর্বার স্রোতে ভেসে যেতে চায়, সে কি স্থির থাকতে পারে? কার সাধ্য রোধে তার গতি। যে দয়িতের উদ্দেশ্যে দেহ-মন প্রাণ সমর্পন করা যায়, তাকে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি কোথায়, আর সেই অসীমের, সেই পরমের উদ্দেশ্যে যাত্রার পথও তো দুর্গম।

“আত্রল পাউস নিবিড় অন্ধকার।

সঘন নীর বরিস বরিসত্র জলধার।। 

ঘন ঘন দেখিঅ বিঘটিত রঙ্গ।

পথ চলইত পথিকহু মনভঙ্গ।।”

বর্ষার এই দুর্গম পরিবেশ তো দূরের কথা শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত কোনও ঋতুর ভেদ নেই, দূর দুর্গম পথে বাঞ্ছিতের উদ্দেশ্যে গমনের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় একদিকে প্রেমের গভীরত্ব, অন্যদিকে প্রেমিকের প্রতি আকর্ষণের অতি গাঢ়তর রূপ।

বিদ্যাপতির লেখনীতে স্পষ্ট, রাধা নিজে যখন অভিসার করে, তখন বুঝা যায় দয়িতের জন্য তার হৃদয়ের আকুলতা কত অধিক। সে কারণেই সে পরকীয়া হয়েও সমাজ সংসার সংস্কারের সব বাধা অতিক্রম করে দূর-দূর্গম পথে বেরিয়ে পড়েছে সঙ্কেত কুঞ্জ অভিমুখে উপনীত হওয়ার জন্য। অভিসারে গমনের জন্য রাধাকে যথোচিত প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে। এই যে নায়িকা নিজেই অভিসার করছেন তাকেই ‘বিপরীত অভিসার ও বলা হচ্ছে।

“বিপরীত অভিসার অমিয় বরিস ধার

অঙ্কুশ ক এল অলকে।।”–বিপরীত

অভিসার অমিয়া ধারা বর্ষণ করে। আর রাধা মদনকে দমনের জন্য অঙ্কুশ রূপ মাধবকে লক্ষ্যস্থানে আসতে বললেন। কিন্তু এ পথও সামান্য নয়। কারণ, সরলপথে পরমকে পাওয়া যায় না—“ক্ষুরস্য ধারা নিশিত দুরত্যয়া দুর্গম পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।”

তবুও রাধা কি বাধা মানে? আর কেনই বা মানবে? নব অনুরাগে যার হৃদয় উন্মত্ত, জগতে এমন কোনও বাধা নেই যে তাকে থামাতে পারে, সে অপ্রতিরোধ্য—

“নব অনুরাগিনী রাধা। কিছু নহি মানত্র বাধা।

একলি ক এল পয়ান। পথ বিপথ নাহি মান।।”

রাধার অভিসারের কষ্ট কি একটি—পথের কষ্ট তো আছে। তাছাড়া—

“বয়সি ছোটি অতি ভীরু রমণী।

কতি খনে আত্তব কুঞ্জবগামিনী।

ভীম ভুজঙ্গম ঘরণা।

কত সঙ্কট তাহে কোমল চরণা।।”

তারো আগে আছে প্রিয়ের অদর্শন জনিত কষ্ট, সমাজ সংসারের বাধা জনিত কষ্ট। কিন্তু রাধা কোনও বাধাকেই আজ বাধা বলে মনে করে না। হৃদয়ের গহনে যাঁর প্রেমের আগুন জ্বলছে, সমাজের বাধা, গুরুজনের বাধার মতো খড়কুটো তার কি করবে?

পরিশেষে সমালোচক অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধায়ের কথা মেনে নিয়ে বলতে হয়। “এত কষ্টের পর রাধাকৃষ্ণের প্রথম মিলন, বাল্য-রমণীর দেহ মন্থণ জাত অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষার প্রথম উল্লাস, আনন্দ বেদনাময় এমন নারী জীবনের অপার রহস্য একমাত্র বিদ্যাপতিই এক একটি আঁচড়ে ফোটাতে পারতেন। এক মুহূর্তেই রাধার বাল্য-রমণী থেকে প্রথম যৌবনে উত্তরণ, অচিরে শঙ্কা-সঙ্কোচের অবসান হল। তারপর জীবন উদ্যানে যৌবন বসন্তের আবির্ভাব অভিসার, মিলন, বাসক সজ্জা, মান—রাধার সঙ্কীর্ণ জীবনকে কেন্দ্র করে বিচিত্র রসের আবির্ভাব।” তবে শ্রীরাধার প্রেমাবেগের চূড়ান্ত পরিচয় অভিসার পদে। আর বিদ্যাপতি এই অভিসার বর্ণনায় অনন্য সাধারণ কৃতিত্বের দাবিদার।