রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বৈষ্ণব কবিতায়’ একদা প্রশ্ন করেছেন—

“পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান, অভিমান

অভিসার, প্রেম লীলা, বিরহ, মিলন

বৃন্দাবন গাথা এই প্ৰণয় স্বপন… 

একি শুধু দেবতার ?”

—বস্তুত বৈশ্বব পদাবলী মর্ত্য জীবনের জবানীতে অলৌকিক দিব্য জীবনের সংবাদ হলেও মর্ত্যলোকের বিরহ, মিলন, মান, অভিমান, প্রণয়ে ব্যাকুলতার কথা এখানেই প্রাধান্য লাভ করেছে। সংসার বন্ধনে বন্দিনী নারীর কাতর আর্তনাদই যেন রাধার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। লজ্জা ভীরু প্রেমের দুঃসাহস তাই ‘আক্ষেপানুরাগের’ সঙ্গে মিশে গেছে। সাধারণ মানুষের রূপ-মুগ্ধ হৃদয়ের বিহ্বলতাই পদাবলীর ‘রূপানুরাগের’ প্রেরণা তাতে সন্দেহ নেই। ‘অভিসার’ও এইরূপ একটি আলৌকিক প্রেমের পর্যায়, যা পদাবলীতে সাংকেতিক অর্থে গৃহীত হয়েছে। যেখানে যথার্থ প্রেম, সেখানে আছে ত্যাগের অমোঘ বীর্য, প্রেমাস্পদের জন্য দুঃসহ ক্লেশ স্বীকারে প্রেমিকা কখনো কুণ্ঠিতা হয়না। দুঃখ বরণ ও কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে প্রেম অগ্নি দগ্ধ স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মধুর ভাবের এই অভিসার পর্যায়ে প্রেমের গভীরতা পরীক্ষা করা হয়। পদাবলীর রাধার দয়িতের উদ্দেশ্যে ক্ষুরধারের মত দুর্গম পথে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়। রাধার এ অভিসার মানব জীবন সম্পৃক্ত।

অভিসারের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বৃন্দাবনের রূপ গোস্বামী তাঁর ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে বলেছেন—

“যা পৰ্য্যুত্সুক চিন্তাতি মদনেন মদেনচ।

আত্মনাতি সরেৎ কান্তং সামতা হাভি সারিকা।।”

অর্থাৎ নায়কের সঙ্গে মিলনের জন্য নায়িকা কিংবা নায়িকার সঙ্গে মিলনের জন্য নায়কের সঙ্কেত স্থানে গমনকে অভিসার বলে। এক কথায় নায়ক-নায়িকার পরস্পর অনুরাগ হেতু পূর্বে নির্ধারিত সংকেত স্থানে গমন। বৈষ্ণব পদাবলীতে নায়িকার অভিসার প্রাধান্য লাভ করলেও কৃষ্ণের অভিসারও আছে। তাই মনীষী হরেন্দ্রনাথ এই অভিসার সম্পর্কে বলেছেন—’Divine call’ বা ‘Spiritual quest’. বিদ্যাপতির পদে অভিসার লৌকিক সীমা অতিক্রম করে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা লাভ করলেও পরবর্তী কালে চৈতন্যদেবের নিবিড় কৃষ্ণপ্রেমের দর্শনে ভক্ত বৈষ্ণুব—‘জীবাত্মা ঈশ্বর অভিমুখী’ এমন একটি রূপক অভিসারের মধ্যে খুঁজে পেলেন। ফলে চৈতন্যে, ওর কাব্য কবিতায় অভিসার দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মণ্ডিত হয়েছে। তাই আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে—

“তারি লাগি, রাত্রি অন্ধকারে

চলেছে মানব যাত্রী     যুগ হতে যুগান্তর পানে

ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে।।”

এই চলা বা অভিসারের সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলতে বৈষ্ণব মহাজন আটপ্রকার অভিসারের কথা বলেছেন—জ্যোৎস্নাভিসার, তামসাভিসার, বর্ষাভিসার, দিবাভিসার, তীর্থযাত্রাভিসার, উন্মত্তাভিসার, অসম্মতাভিসার। বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, রায়শেখর প্রমূখ পদকর্তাগণ অভিসারের মাহাত্ম্য বহু বৈচিত্রে আপন আপন পদরচনার দ্বারা সাজিয়ে তুললেও এই পর্যায়ে পদকর্তা গোবিন্দ দাসকে রাজাধিরাজ হিসাবে আখ্যাত করা হয়।

গোবিন্দদাস তাঁর পদে আত্মবিস্মৃত গভীরতা, গতিশীলতা, ও রূপবৈচিত্র, চিত্রধর্ম, নাটকীয়তা এবং সঙ্গীত হিল্লোলের সংমিশ্রণে অপরূপ মহিমা দান করেছেন। তিনি বহু দৃশ্যের দ্বারা পদগুলিকে আবৃত করে এক সুন্দর নাটকীয় মহিমা দান করেছেন। দিবা, তিমির, জ্যোৎস্না, গ্রীষ্ম, বর্ষা প্রভৃতি অভিসারের বৈচিত্রের শেষ নেই। সমস্ত বিশ্বের নৈসর্গিক প্রতিকূলতা, সমস্ত সংসারের বিরোধিতার বিরুদ্ধে কৃষ্ণের জন্যে রাধার অভিসার। তাই উৎকণ্ঠায় কবি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন—

“মন্দির বাহির কঠিন কপাট। 

চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।। 

তহি অতি দূরতর বাদর দোল। 

বারিকি বারই নীল নিচোল ।।”

অর্থাৎ ঘরের বাইরে কঠিন কপাটের বাধা, পথ চলতে ভয়, তার উপর দুরস্ত বর্ষা ও পিচ্ছিলতা—এই নীল বস্ত্রে কি বৃষ্টির জল বাধা পাবে? কিন্তু শ্রীমতী অবিচল। কোন বাধাই আর তিনি মানতে রাজি নন। মনের লজ্জা, দ্বিধা, সঙ্কোচ– অন্তরের সব বাধাকে যিনি অপসারিত করতে পেরেছেন বাইরের বাধা তার আর কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে?

“কুল মরিয়াদ    কপাট উদ্ঘাটলু

তাহে কি কাঠ বাধা।

নিজ মরিয়াদ     সিন্ধু সঞে পঙারলু

তাহে কি তটিনী অগাধা।।”

রাধা তার সখীকে বলতে ভোলেনা—“সজনী মঝু পরিখন কত দূর।” অর্থাৎ আমায় পরীক্ষা করো না। আমি এখন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। সে রাধার জন্যে সঙ্কেত কুঞ্জে হরি প্রতীক্ষা করছেন সেই রাধা স্থির কি থাকতে পারে? মদনের শরে সে অহর্নিশ জ্বলে পুড়ে মরছে। বাদল ধারা কোন বাধাই নয়, তার জীবন যখন কৃষ্ণের পদতলে সমর্পিত হয়েছে তখন দেহের মায়া করে কী করবে?

দুরন্ত পথের দুর্গমতা বর্ণনায় বিদ্যাপতির মত গোবিন্দদাসও বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন— কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আকুল উদ্দেশ্যে রাধা দুশ্চর তপস্যায় মগ্না। আঙ্গিনায় জল ঢেলে পিচ্ছিল করে, কন্টক পুঁতে সেই পথে চলা অভ্যাস করছে। হাতের কঙ্কণ উপহার দিয়ে সর্বশের মন্ত্র শিখছে। পরিজনেরা কোনও নিন্দা মন্দ করলে— তা ‘বধির সম মানই। পদটি উদ্ধৃতি যোগ্য—

“কন্টক গাড়ি     কমল সম পদতল

মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।

গাগরি বারি    ঢারি করি পিছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।”…

এই সাধনার তুলনা নেই। বর্ষার পিচ্ছিল পথে কি করে চলতে হয় তাই ঘরের মেঝেতে জল ঢেলে তাতে পা টিপে টিপে চলার জন্য রাধা অভ্যাস করছে। কারণ, “মাধব তুয়া অভিসারক লাগি।” এই পথ শ্রমের কথা কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় রাধা একমুখে প্রকাশ করতে পারছে না—

“পথ আগমন কথা     কত না কহিব হে

যদি হয় মুখে লাখে লাখ।”

অভিসারের বহিরঙ্গগত রূপ বর্ণনাই গোবিন্দদাসের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। যেমন— তিমিরাভিসার, বর্ষাভিসার, কুঞ্ঝাটিকাভিসার, জোৎস্নাভিসার, তীর্থাভিসার, মানসাভিসার প্রভৃতি বৈচিত্র্যের জন্য এই পর্যায়ে গোবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠত্ব সকলে স্বীকার করেন।

গোবিন্দদাস চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ বৈক্ষ্ণব পদকার। তিনি রূপ দক্ষ শিল্পী। গভীর ভাবের শতধা বিচ্ছুরিত হীরক খণ্ডগুলিকে সংগৃহীত করে অখণ্ড শিল্প রূপ দিতে তিনি রূপদক্ষ। কোন কবিতাকে শ্রেষ্ঠ শিল্প হয়ে উঠতে গেলে তাতে ভাবের নিবিড়তা যেমন থাকতে হবে তেমনি সেই ভাবের সুষ্ঠু প্রকাশের জন্য মণ্ডনকলার উপযুক্ত উপস্থিতিও একান্ত প্রয়োজন। গোবিন্দ দাসের কাব্যে সেই ভাব ও মন্ডলক্যার অত্যাশ্চর্য মিলন লক্ষ্য করা যায়। ভক্তির আতিশয্য তাঁর কবিতার দু’কুল ছাপিয়ে যায়নি। সংযমের পারিপাট্য বজায় রাখার রহস্যটি তিনি জানতেন। এ প্রসঙ্গে ‘পদকল্পতরুর’ সম্পাদক সতীশ চন্দ্র রায়ের বক্তব্য বিশেষ স্মরণযোগ্য— “তাঁহার রচনায় ভাবের গূঢ়তা, অলঙ্কার ও ধ্বনির প্রাচূর্য ও সমাস বাহুল্যের জন্য তাঁহার রচনা সাধারণ পাঠকের তো কথাই নেই—অধিকাংশ শিক্ষিত ও সৌখীন কাব্যরসামোদী পাঠকের পক্ষেও দুরধিগম্য হইয়া উঠিয়াছে, যাঁহারা ধৈর্য্য ধরিয়া বিজ্ঞ ও রসজ্ঞ কোন কোন কীর্তন গায়কের মুখে গোবিন্দ দাসের পদ শুনিবার সুযোগ ও সৌভাগ্য লাভ করিয়াছেন তাঁহারা জানেন যে— “গোবিন্দ দাসের অভিসারের পদ কত উপভোগ্য।”

পরিশেষে বলতে হয়, অভিসারের পদ রচনার উৎস যাই হোক না কেন, বৈষ্ণব পদকর্তা গণ এই পদ রচনায় স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন। এতে একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক তাৎপর্য লক্ষণীয় অপরদিকে তেমনি কাব্যিক চমৎকারিত্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত। প্রেমের বীর্য রাধাকে অশঙ্কিতা করেছে। ফলে রাধা সকল বাধাকে অতিক্রম করে অভিসারে গিয়েছে। সত্যই তো সকল প্রকার বাধা অতিক্রম করতে না পারলে সেই প্রেমময়ের সঙ্গে মিলন হবে না। এই জন্যেই সেই পরম পুরুষের অভিসার, এই অভিসার পদে‌ সকল কবিদের মধ্যে গোবিন্দ দাসই শ্রেষ্ঠ। তাই তিনি অভিসারের পদ রচনার জন্য ‘রাজাধিরাজ’ আখ্যা পাওয়ার যোগ্য।