কবিতার নামকরণ তখনই হয় যখন কবিতার ভাববস্তু নামকরণের মধ্যে ধরা পড়ে। ‘অভিশাপ’ কবিতাটি নজরুলের একটি সার্থক প্রেমের কবিতা। কিন্তু প্রেমের যে রূপটি এখানে ফুটে উঠেছে, সে প্রেমে আছে গভীর অভিমান, বঞ্ছিত প্রেমিক হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস। কবির ব্যথিত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসই অভিশাপ হয়ে কবিপ্রিয়াকে একদিন বিদ্ধ করবে। সেই বেদনার ও দীর্ঘশ্বাসের কাব্যকারু এই কবিতাটি।
নজরুলের রোমান্টিক কল্পনা দয়িতার জীবনকে কল্পনানেত্রে প্রত্যক্ষ করে তাকে কাব্যভাষায় চিত্রিত করেছেন। কবির অন্তরের অভিমান সংগীতের স্পর্শে অনুরণিত হয়ে কবিপ্রিয়ার নবজীবনকে কল্পনানেত্রে প্রত্যক্ষ করেছে। এই রূপায়ণের মধ্যে আছে কবির বক্তৃিত জীবনের দুঃখাভিমান। কিন্তু যেখানে কবি এই অভিমানকে প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে ব্যঞ্জিত হয়েছে অভিশাপের সুর। এই কারণেই অভিশাপ নামটি সার্থক হয়ে উঠেছে।
কবি বিশ্বাস করেন যে যেদিন তিনি তাঁর দয়িতার জীবন থেকে হারিয়ে যাবেন তাঁর যথার্থ মূল্য তাঁর দয়িতা বুঝতে পারবেন। অন্তপারে সন্ধ্যাতারা উঠবে, কবিপ্রিয়া সেদিন হয়তো সন্ধ্যাতারার কাছে তাঁর বার্তা জিজ্ঞাসা করবেন। কবি সন্ধানে তাঁর প্রিয়জন ছুটে বেড়াবে—বুকে ছবি বেঁধে, পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে কত মরুভূমি-অরণ্য-পর্বত পার হয়ে তখন তাঁর প্রিয়জনকে ছুটে বেড়াতে হবে। জীবনে যাকে দয়িতা বোঝেনি তার অবর্তমানে তাকে খোঁজার যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হবে। এই অনুভূতির মধ্যে কবির অভিশাপ ফুটে উঠেছে। কিন্তু অভিমানের সুরে এই অভিশাপ ফুটে উঠেছে বলে কবিতাটির এক অপূর্ব কাব্যব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে।
গভীর রাতে নিদ্রাভঙ্গে বা স্বপ্নভঙ্গের মধ্যে কবির পরিচিত স্পর্শসুখের স্মৃতি তাঁর দয়িতাকে হয়তো ব্যাকুল করে তুলবে। কবির ছায়ামূর্তি অনুসরণ করতে গিয়ে দেখতে পাবে, যে শয্যা শূন্য, মিথ্যা স্বপ্ন। কবিপ্রিয়া তখন বেদনার্ত হয়ে উঠবে। এই সম্ভাব্য দৃশ্য কবির অভিমান থেকে উৎসারিত হলেও এর মধ্যে অভিশাপের স্পর্শ আছে।
কবিপ্রিয়ার জীবনযাত্রার নানাক্ষেত্রে তার বেদনার মূর্তি কবি প্রত্যক্ষ করবেন। কখনও গানের আসরে, কখনও কবির সমাধিমন্দিরে, কখনও আশ্বিনের শিশির ভেজা রাত্রে বন্ধুজন-পরিবৃত্ত হয়ে কবিকে বার বার দয়িতার মনে পড়বে। গানের আসরে বন্ধুজনের অনুরোধে কবি-রচিত গান গাইতে গিয়ে দয়িতার চোখ জলে ভরে আসবে, কারণ তাঁর গানে বেহাগের সুর লাগবে। কবিপ্রিয়া যে বঞ্ঝঞ্ছনা করেছে, সেই বঞ্ছনার কথা, সেই ফাঁকির কথা স্মৃতিপথে আসবে। তার অশ্রুহীন চোখ দুটি বেদনায় ভরে উঠবে। শিউলি ফুলের প্রাঙ্গণে ফুল তুলতে গিয়ে দয়িতার কাঁকন কেঁপে উঠবে। কবির সমাধিক্ষেত্র শিউলি-ঢাকা। তার কথা ভেবে মন কেঁদে কেঁদে উঠবে। প্রেয়সীর বুকের মালা তার অন্তরে জ্বালা ধরাবে। কবি মনে করেন সেদিন সকলে তাঁকে বুঝতে পারবে। তার অবর্তমানের শূন্যতায় তার প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। কবির এই আশা অভিমানের সুরে বাঁধা। কিন্তু এই অভিমানের মধ্যে আছে অভিশাপের ইঙ্গিত। তাই এই কবিতার ভাববস্তুর সঙ্গে নামকরণটি সার্থক হয়ে উঠেছে।
‘অভিশাপ’ কবিতায় কবির স্মৃতি কবিপ্রিয়ার যে বেসুরো ব্যবহার, যে দয়াহীন হৃদয়ের উচ্চারণের চিত্র বর্ণিত আছে, তার কথা বার বার নানা ইঙ্গিতে বলা হয়েছে। কবিপ্রিয়া জীবনের নবপর্বে নতুন বন্ধুর সঙ্গে প্রেম ও প্রীতির ডোরে বাঁধা পড়ে সে যে তাকে বিস্মৃত হয়েছে। এ বেদনা কবির কাছে অবিস্মরণীয়। কবি তাই মনে করেন তাঁর এই বন্ধুত্ব বর্জিত জীবনে তার অতীত স্মৃতি এক করাল ছায়া বিকীর্ণ করবে। এই করাল ছায়া তাকে সুখ দেবে না, তার জীবনের স্বর্ণমুহূর্তে সে সৃষ্টি করবে নিরানন্দের চিত্র। কবির এই অনুভূতি এখানে অভিশাপের মতো ধ্বনিত হয়েছে।
কবির রোমান্টিক মন বিশ্বাস করে যে জ্যোৎস্নায় যেদিন দোলন-চাঁপা ফুটবে, যেদিন কবিপ্রিয়া নীল আকাশ ভরে এক হারিয়ে যাওয়া তারার মধ্যে তাকে সন্ধান করবে। সোহাগ ভীরু কবিপ্রিয়া তখন অনুতাপে দগ্ধ হবে। তার স্মৃতিপথে উদিত হবে কবির সোহাগের স্মৃতি। এই স্মৃতি তাকে দগ্ধ করবে, তাকে অনুতপ্ত করবে। দুঃসময়ের রাত্রে কবি তাকে যে নিরাপত্তা দান করেছিলেন, তার কথা বার বার কবিপ্রিয়ার মনে হবে। শেষে একদিন কবিপ্রিয়ার ভুল ভাঙবে। তাঁর দেওয়া আঘাতের স্মৃতির মধ্য থেকে ক্লান্ত হয়ে শেষে দয়িতা তাঁকে বাহুবন্ধনে বাঁধার আগ্রহ অনুভব করবেন। সেদিন কবিপ্রিয়া তাকে সম্যক উপলব্ধি করবেন।
কবির প্রতি কবিপ্রিয়ার এই হৃদয়হীন ব্যবহারের কথা এই কবিতায় নানা আভাসে বর্ণনা করা হয়েছে। কবির বেদনাবোধ সেই ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি। এই বেদনাবোধ থেকেই কবির মনে এক দুঃখময় অনুভূতি জেগেছে। এই অনুভূতিই কবিপ্রিয়ার জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে। এইভাবেই কবির মনোভাব, কবিকল্পনা, অভিশাপের বর্ণে বর্ণে অনুরঞ্জিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাই ‘অভিশাপ’ নামকরণের কাব্যমাধুর্য অসাধারণ।
Leave a comment