‘অভিশাপ’ কবিতাটিতে কবি তাঁর প্রিয়ার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। কিন্তু একে যথার্থ অভিশাপ বলা যায় না, কারণ অভিশাপের মধ্যে অভিশাপদাতার যে অনিষ্ট কামনা থাকে, আলোচ্য কবিতায় তা নেই। বরং যাকে অভিশাপ দিতে চান কবি তার প্রতি নিজের নিবিড় ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছেন। অভিশাপের ছলে কবি নিজের অভিমানকেই ব্যক্ত করেছেন।

কবিপ্রিয়ার প্রতি অভিমানবশত কবি হারিয়ে যেতে চান যাতে তাঁর অভাবে তাঁর যথার্থ ভালোবাসার স্বরূপ উন্মোচিত হয় প্রিয়ার কাছে। বস্তুত কবি বিশ্বাস করেন যে তার প্রিয়া সাময়িকভাবে তাঁর প্রতি উপেক্ষা দেখালেও কবি-প্রিয়া হৃদয়ের গভীরে যে নিবিড় ভালোবাসা লালন করেন, কবির অবর্তমানে কবিকল্পিত তাঁর নানা আচরণের প্রকাশে ও চিত্তের উপলব্ধিতে তা বোঝা যায়। সেই বিশ্বাস নিয়ে কবি বলে ওঠেন,—

“যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে।”

তিনি এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলে তাঁর ভালোবাসার মূল্য কবিপ্রিয়ার হৃদয়ঙ্গম হবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তাই তিনি প্রিয়াকে বলেন—

“ছবি আমার বুকে বেঁধে 

পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে

ফিরবে মরু কানন গিরি 

সাগর আকাশ বাতাস চিরি’

যেদিন আমায় খুঁজবে

বুঝবে সেদিন বুঝবে।”

কবিতাটির মধ্য দিয়ে কবির রোমান্টিক মানসিকতাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কল্পনাশক্তির অসাধারণ বিকাশ যেমন রোমান্টিসিজমের প্রধান ধর্ম তেমনি একটা বেদনাবোধ এবং অপ্রাপণীয়তার হতাশাও তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। আলোচ্য কবিতায় রোমান্টিক কল্পনা ও বেদনাবোধের আশ্চর্য সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। কবি কল্পনা করছেন তাঁর অবর্তমানে শিউলি ফুল দিয়ে মালা গাঁথার সময়ে শিউলি ফুল ঢাকা তাঁর কবরের কথা মনে পড়ে কবিপ্রিয়ার হৃদয় বেদনার্ত হয়ে উঠবে—

“শিউলি-ঢাকা মোর সমাধি 

পড়বে মনে উঠবে কাদি’। 

বুকের মালা ক’রবে জ্বালা 

চোখের জলে সেদিন বালা

মুখের হাসি ঘুচবে

বুঝবে সেদিন বুঝবে।”

কিন্তু কবির এই রোমাণ্টিক আত্মবিলুপ্তির আকাঙ্ক্ষার উৎস কি, তার কি কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে? কবির জীবনী পর্যালোচনা করলে বোধ হয় তার উত্তর পাওয়া যেতে পারে।

নজরুলের প্রথম বিবাহ সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যিক আলি আকবর খানের সঙ্গে তাঁদের দৌলতপুরের গ্রামের বাড়িয়ে গিয়ে কিছুদিন ছিলেন। এই সময়ে তাঁর ভাগিনেয়ীর সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থির হয়। এই বিবাহ সম্পর্কে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ লিখেছেন, “শোনা যায়, তাঁর আপন-ভোলা স্বভাব ও বিষয়-বিরাগ নিয়ে তাঁর দৌলতপুরের ভাবী শ্বশুরালয়ের দাসদাসীরাও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে ছাড়ে নি। আহত অভিমানে বিবাহ বাসর ত্যাগ করে নজরুল সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লা চলে যান। অবোধ বালিকার যখন চৈতন্যের উদয় হত, বাঁধনহারা কবি তখন নাগালের অনেক বাইরে। শোনা যায়, যতই দিন কেটেছে, পলাতক প্রিয়ের পথ চেয়ে বিরহিণী আপনার মনে তিলে তিলে পুড়ে মরেছে অনুতাপের আগুনে, কিন্তু উদাসী পথিক সে পথে আর ফিরে আসেননি কোনদিন।

…..শোনা যায় এই মর্মস্তুদ ঘটনা কবির কাব্যসৃষ্টিতে প্রেরণা দিয়েছিল প্রচুর। এই বেদনা করুণ-মধুর ছায়া বিস্তার করেছিল তাঁর সৃষ্টির পরে।” এই কবিতাটি রচনার পিছনেও অন্যান্য ভাবনার সঙ্গে এই ঘটনাও কবি-মনে পশ্চাৎপট হিসেবে কাজ করতে পারে।

আলোচ্য কবিতাটিতে সম্ভবতঃ কবির বাগদত্তা প্রথম প্রিয়ার প্রতি এই অভিমানের অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। বস্তুত ‘অভিশাপ’ নাম দেওয়া সত্ত্বেও কবিতার কোথাও কবির রোষ বা বিরাগ প্রকাশিত হয় নি, পক্ষান্তরে গভীর অভিমান ও ভালোবাসার করুণ বেদনাই প্রকাশিত হয়েছে।