‘অভিশাপ’ কবিতাটির অন্তর্নিহিত অর্থটি প্রকাশ করো।

কবি নজরুল রচিত ‘অভিশাপ’ কবিতাটির অন্তর্নিহিত অর্থটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কবি এখানে শোষিত শ্রেণির প্রতীকরূপে নিজেকে দাঁড় করাইয়াছেন এবং শোষকশ্রেণির প্রতীক হিসাবে ‘বিধি’, ‘ভগবান’ বা ‘জগৎ-স্বামী’ এইরূপ অভিধা ব্যবহার করিয়াছেন। যুগপরম্পরায় এই শোষক বা শাসকশ্রেণিগণ-মানুষকে শাসনের অজুহাতে অন্যায়ভাবে অকথ্য লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচার ইত্যাদি দিয়া আসিতেছিল। কবি অকস্মাৎ আত্মোপলব্ধির দ্বারা নিজের অসীম শক্তির পরিচয় পাইলেন এবং অমিত বিক্রমে শত্রুরূপী শাসকশ্রেণিকে বিদ্রোহ, বিপ্লবের মাধ্যমে প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানিয়া ধরাশায়ী করিতে পারিবেন এ বিষয়ে স্থির-নিশ্চিন্ত হইলেন। কারণ তাঁহার এই শক্তি কত যে ভীষণ তাহা কল্পনাও করা যায় না। এই শক্তির পরিচয় পাইয়া বিরুদ্ধ শত্রুপক্ষ ভীষণভাবে ভীত হইয়া নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নতমস্তকে আত্মসমর্পণ করিল। ইহাতে কবি বিজয়ীর গর্ব বোধ করিলেন বটে তবে এই অবিশ্বাসী শাসকগোষ্ঠির প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখিলেন এবং প্রয়োজনে কঠিন হাতে দমন করিতে লাগিলেন। কেননা ইহাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করাই কবির কাম্য। কবি নিজেকে ‘কালশাপ’ বলিয়া মনে করেন কেননা কঠিন কলুষিত উচ্ছৃঙ্খল সময়ই তাঁহাকে এই অবস্থায় রূপান্তরিত করিয়াছে—অন্য কিছু নহে। সম্ভবত এইভাবে কবি সাম্যবাদের ছবিটি আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছেন।

“আমি বিধির বিধান ভাঙ্গিয়াছি আমি এমনি শক্তিমান”–এই ‘আমি’ কে? ‘বিধির বিধান’ কীভাবে তিনি ভাঙ্গিলেন। বিশ্লেষণ করিয়া বুঝাও।

এখানে ‘আমি’ শব্দটি দ্বিমুখী অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে। একদিকে ‘আমি’ অর্থে ‘অভিশাপ’ কবিতাটির রচয়িতা কবি নজরুল নিজে এবং অন্যদিকে শোষিত শ্রেণির প্রতীক। কবি নিজে শোষিত গণ-মানুষের প্রতীক হিসাবে কবিতাটিতে পরোক্ষে উপস্থিত হইয়াছেন।

‘বিধির বিধান’ এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণ অর্থে ঈশ্বর সৃষ্ট প্রচলিত নিয়মধারা বুঝায়। কিন্তু কবি এখানে ‘বিধি’ অর্থে শাসকশ্রেণিকে বুঝাইতেছেন। ‘বিধি’ বা ‘ঈশ্বর’ যেমন তাঁহার সৃষ্ট পৃথিবীতে নিয়মধারা বাঁধিয়া দিয়াছেন তেমনি শাসকশ্রেণি শাসিতদের জন্য নানারূপ আইন-কানুন বাঁধিয়া দেয় এবং এই আইন-কানুনের মাধ্যমে শাসকশ্রেণি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করিয়া থাকে।

গণমানুষের প্রতীক কবি অকসম্মাৎ কোনো একদিন বুঝিতে পারিলেন তাঁহার অমিত শক্তির কথা আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে। সে শক্তির রূপ অতি ভয়ানক। এই বীর্যবান শক্তির বলে বলীয়ান হইয়া তিনি বিদ্রোহ বা বিপ্লবের দ্বারা শাসকশ্রেণির যাবতীয় অন্যায় অনুশাসন বা শাসনযন্ত্র নষ্ট করিয়া দিলেন—যাহার ফলে শাসকশ্রেণি নতমস্তকে আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হইল।

প্রথম যেদিন আপনার মাঝে আপনি জাগিনু আমি, কে আপনার মাঝে আপনি জাগিল? এই জাগরণের অর্থ কি? জাগিবার পর কী ফলপ্রাপ্তিই বা ঘটিল? বিস্তারিতভাবে বুঝাও।

‘অভিশাপ’ শীর্ষক গীতিকবিতার রচয়িতা কাজি নজরুল ইসলামকে এখানে ‘আপনি’ অর্থে বুঝিতে হইবে। আবার এই ‘আপনি’র অন্য অর্থ বা অন্তর্নিহিত অর্থ হইতেছে শোষিত গণ-মানুষের সামগ্রিক রূপের প্রতীক অর্থাৎ কবি নজরুল গণ মানুষের প্রতীক হিসাবে কবিতাটির মধ্যে নিজেকে দাঁড় করাইয়াছেন।

শাসকশ্রেণি যুগ-যুগান্তর ধরিয়া গণ মানুষকে নানারূপ অত্যাচার লাঞ্ছনার মাধ্যমে শোষণ করিয়া আসিতেছে। অকস্মাৎ কোনো একদিন কবি শাসকশ্রেণির এই নিষ্ঠুর অন্যায় কার্যাবলি আত্মোপলব্ধি করিলেন এবং নিজের অমিত শক্তির পরিচয় পাইলেন। এই আত্মোপলব্ধিই ‘আপনার মাঝে আপনার জাগরণ। অর্থাৎ শাসকশ্রেণির অশালীন কার্যাবলি সম্পর্কে কবি এতদিন ঘুমন্ত বা উদাসীন ছিলেন। এখন তিনি এই সব কার্য্যাবলীর বিষয় নিজে উপলব্ধি করিলেন অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থা হইতে জাগরিত হইলেন। ঘুমস্ত অবস্থা হইতে জাগরিত হইয়া যেমন সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখা, বুঝা এবং প্রয়োজনমতো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তেমনি আত্মোপলব্ধির পর কবি শত্রুপক্ষ বা শাসকশ্রেণির যাবতীয় অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার বা মোকাবিলা করিতে উদ্বুদ্ধ হইলেন।

কবির এই জাগরণে বা প্রবল শক্তির পরিচয় পাইয়া শাসকশ্রেণি ভয়ে অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িল এবং আপন অস্তিত্ব রক্ষার্থে নতশিরে আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হইল। শুধু ইহাই নহে, প্রবল আর্তনাদ করিয়া নিজেদের প্রাণ ভিক্ষা প্রার্থনা করিল এবং তাহাদেরই নিয়মকানুন বা শাসনতন্ত্রের অধীনস্থ গণ-মানুষকেই নিজেদের প্রভু বা পরিচালক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাহিল। অর্থাৎ গণ-মানুষের সমস্ত অধিকারের স্বীকৃতি দিল। অন্য কথায় বলা চলে শাসকশ্রেণি সম্পূর্ণভাবে গণমানুষের প্রচণ্ড শক্তির কাছে পরাজয় বা বশ্যতা স্বীকার করিল। ইহাই জাগরণের পরবর্তী ফলপ্রাপ্তি।

“শুনি খল খল খল অট্টহাসিনু, আজিও সে হাসি বাজে’– কাহার কী শুনিয়া কে অট্টহাসি হাসিল? সে অট্টহাসির সহিত কীসের তুলনা করা চলে? বিশদভাবে বুঝাইবার চেষ্টা করো।

গণ বা মানুষের প্রতীক হিসাবে ‘অভিশাপ’ কবিতার রচনাকার কবি নজরুল প্রথম যখন নিজের মধ্যেকার প্রচণ্ড শক্তির উপলব্ধি করিলেন তখন সেই শক্তির ভয়ে অত্যাচারী শাসকশ্রেণি ভয়ে ভীষণ ভীত হইয়া সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিল আপন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং গণমানুষকেই নিজেদের প্রভু বা পরিচালক বলিয়া স্বীকার করিল। অর্থাৎ শাসকশ্রেণি শোষিতশ্রেণির অমিত শক্তির কাছে সম্পূর্ণ পরাভূত হইল।

শাসকশ্রেণির মুখে গণ মানুষকে নিজেদের প্রভু হিসাবে গ্রহণ করিতে চায় এই কথা শুনিয়া শোষিতশ্রেণির প্রতীক কবি বিরাট শব্দে অট্টহাসি হাসিলেন। এই অট্টহাসি অতি ভীষণ বা ভয়ংকর—যাহার তুলনা করা চলে আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ লাভাস্রোেত কিংবা গ্রীষ্মকালীন খরতাপের মধ্যে বিনা মেঘে যদি ব্রজপাত হয় তবে সেই ভয়াবহ বজ্রের শব্দের সহিত। সুতরাং এই অট্টহাসি যে কী বীভৎস ও বিরাট ধন্যাত্মক তাহা সহজেই এই তুলনার দ্বারা অনুমেয়।

‘স্রষ্টার বুকে আমি সেই দিন প্রথম জাগানু ভীতি’—স্রষ্টা কে? কোন্‌দিন হইতে কে তাহার বুকে ভীতি জাগাইল এবং কীসের ভীতি ? সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

‘স্রষ্টা’ কথাটি দ্বৈত অর্থে এখানে ব্যবহৃত হইয়াছে। একটি অর্থ সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর। অপর অর্থটি অত্যাচারী শাসকশ্রেণি। দ্বিতীয় অর্থটিই এখানে অধিকতর সমীচিন।

গণ-মানুষের প্রতীক হিসাবে কবি এই স্রষ্টা বা শাসকশ্রেণির বুকে ভীতি জাগাইয়াছেন। তবে কোন্ দিন হইতে সঠিক ভাবে তাহা বলা যায় না; কেননা ইহা ‘আদি ও অন্তহীন’। কবি প্রথম যেদিন নিজের অসীম ক্ষমতা বা শক্তি সম্বন্ধে প্রথম আত্মোপলব্ধি করিলেন এবং শাসকশ্রেণি সেই শক্তির পরিচয় পাইয়া অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িল এবং অবশেষে নতশিরে আত্মসমর্পণ করিয়া প্রাণ ভিক্ষা প্রার্থনা করিল এবং গণ-মানুষকেই নিজেদের স্বামী বা প্রভু বলিয়া স্বীকার করিতে চাহিল—সেই সময় বা দিনটি এই প্রসঙ্গে ধরা যাইতে পারে। আর শাসকশ্রেণির বুকে যে ভীতি জাগিল তাহা তাহাদের নিজেদের অস্তিত্ব লোপে ভীতি। বহুকাল ধরিয়া তাহারা গণ-মানুষকে যে প্রতারণা পূর্বক শোষণ করিয়া নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করিয়া আসিতেছিল সেই সুবিধাবাদী সুযোগের অবলুপ্তির ভয়ের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

‘এই কালশাপ আমি, লোকে ভুল করে মোরে অভিশাপ বলে’—এই উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাও।
কে ‘কালশাপ’ এবং কেন? ‘অভিশাপই’ বা নয় কেন? লোকের ভুলটা কোথায়? বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করো।

নজরুলের ‘অভিশাপ’ শীর্ষক কবিতার মধ্যে কবি নিজেকে ‘কালশাপ’ বলিয়া চিহ্নিত করিয়া বলিতেছেন যে, সাধারণ লোকে তাঁহাকে যে ‘অভিশাপ’ বলে সে কথাটি ভুল। সুতরাং ‘কালশাপ’ ও ‘অভিশাপ’ এই শব্দ দুইটির ব্যবহার এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

‘প্রভু’ তথা ‘জগৎ-স্বামী’ তথা ‘স্রষ্টা’—এই শব্দগুলি কবিতাটির মধ্যে কবি বিশেষ অর্থ মূলত ব্যবহার করিয়াছেন। উৎপীড়ক শাসকশ্রেণির প্রতীক হিসাবেই এই শব্দগুলি গ্রহণ করা হইয়াছে—সাধারণ অর্থে নহে। কবি গণ-মানুষের প্রতীক হিসাবে নিজেকে দাঁড় করাইয়াছেন। প্রথমেই আমাদের এই বিষয়টুকু হইবে।

কোনো একদিন অকস্মাৎ কবি নিজেকে আবিষ্কার করিলেন—আবিষ্কার করিলেন নিজেকে অমিত শক্তিধররূপে। তাঁহার বীর্যবত্তা দর্শনে উৎপীড়ক শাসকশ্রেণি ভয়ে ভীত হইয়া কবিকে অর্থাৎ গণমানুষকেই নিজেদের প্রভু বা পরিচালক হিসাবে গ্রহণ করিতে চাহিল। শাসকশ্রেণি রচিত সমস্ত অনুশাসন কবি ভাঙিয়া চুরমার করিয়া ফেলিলেন বৈপ্লবিক ভয়ংকর শক্তির মাধ্যমে। এই যে ভাঙাচুরা-এই যে উত্থান-পতন—এই যে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণ ও উদ্দেশ্য তাহা সাধারণ মানুষ এমনকি শাসকশ্রেণিও সম্যক উপলব্ধি করিতে পারে নাই৷ ‘হে মোর সৃষ্টি ! অভিশাপ মোর’—এই উক্তিটি স্রষ্টা বা শাসকশ্রেণির। সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় যেহেতু শাসকের প্রচলিত নিয়ম-কানুন ভাঙিয়া কবি নৃতন দিগন্ত উন্মোচন করিলেন সেইহেতু কবির প্রতি রাগ, অভিমান, বিদ্বেষবশত সাধারণভাবে তাঁহাকে ‘অভিশাপ’ আখ্যা দেওয়া হইয়াছে । পরিশেষে অবশ্য কবি নিজেই এই অপব্যাখ্যা ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন সাধারণ ভাবে তাঁহাকে ‘অভিশাপ’ আখ্যা দেওয়া ভুল। কারণ কাহারও প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা হিংসাবশত তিনি এই প্রচণ্ড শক্তিধর বৈপ্লবিক পন্থা গ্রহণ করেন নাই। বরঞ, তাঁহাকে ‘কালশাপ’ আখ্যা দেওয়া উচিত। কারণ, সময়ই তাঁহাকে এইরূপ দুর্বিনীত করিয়াছে—এইরূপ ভাঙাগড়ার পথে নামাইয়াছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিশৃঙ্খল উচ্ছৃঙ্খলতা যে যুগে মানবতাকে পদদলিত করিতেছে সেই যুগই তাঁহাকে এইরূপ ভয়ংকর বিদ্রোহী বা বিপ্লবী করিয়া তুলিয়াছে। সুতরাং তাঁহাকে সাধারণ অর্থবহ ‘অভিশাপ’ বলা ঠিক নয়—তাঁহাকে আখ্যা দেওয়াই প্রকৃতপক্ষে সত্য এবং সুসঙ্গতিপূর্ণ।