নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের কবি বলেই পরিচিত। বাংলা কাব্যে তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ তাঁকে বিদ্রোহী কবির দীপ্ত ভূমিকায় এক অমর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু তাঁর কাব্যে অসাম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যত প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়ে উঠুক কবির কাব্যে প্রেমের চিত্রও কম সার্থকভাবে প্রকাশিত হয় নি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কয়েকটি স্তবকে কবির প্রমত্ত কল্পনা (wild imagination) যখন প্রকৃতি-জগতে নানা ধ্বংসাত্মক ও প্রলয়ঙ্কর চিত্র রচনা করেছে, তখন রোমান্টিক প্রেমানুভূতির চিত্রও সার্থকভাবে অঙ্কিত হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় কবি-কল্পনায় বিদ্রোহ ও প্রেম দুই রাগই সমভাবে ঝংকৃত হয়েছে।
‘অভিশাপ’ প্রেমের কবিতা। এই প্রেমের কবিতার বিষয়বস্তুর বর্ণনায় কবি প্রেম ও নিসর্গ থেকে নানা অনুভূতি ও চিত্রকল্প রচনা করেছেন। কবির একটি স্বকীয় অনুভূতি যা অভিমানের নামান্তর তা এই কবিতায় বর্ণিত হয়েছে। কবি মনে করেন যে কবিপ্রিয়া তাঁকে উপলব্ধি করতে পারেননি তাঁকে তার প্রাপ্য সমাদর ও স্বীকৃতি দেননি। তাই কবি কল্পনা করেছেন তাঁর অবর্তমানে কবিপ্রিয়ার জীবনে কোনো কোনো প্রহর কীভাবে তার স্মৃতি দুঃখদহন দান করবে। এই কল্পনাবৃত চিত্রমালা কবিতাটির এগারোটি স্তবকে ফুটে উঠেছে। এর প্রতিটি চিত্রমালায় কবি ও কবিপ্রিয়ার প্রেমলীলার স্মৃতি অনুষঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। এই সব চিত্রকল্প কবির প্রেমানুভূতি ও যুগল জীবনের ‘togetherness’-এর সুরে মণ্ডিত। কিন্তু কবির মনে যে বেদনাবোধ যে বঞ্চনার সুর ধ্বনিত হয়েছে তাই কবিতায় অনুরণিত হয়ে কবিতাটিকে রোমান্টিক বেদনাবাদের কবিতায় পরিণত করেছে।
আর্ভিং ব্যবিট্ তাঁর ‘Roussean and Romanticism’ গ্রন্থে ‘Romantic Love’ অধ্যায়ে রোমান্টিক প্রেমের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি রোমান্টিক প্রেম গভীর বাসনা ও বাসনাভঙ্গজনিত বেদনার কথা বলেছেন। ‘অভিশাপ’ কবিতায় কবিমনে যে অপ্রাপ্তির সুর আছে, তাও কবিতার এক বিষণ্ণ আভা দান করেছে।
কবির অবর্তমানে কবিপ্রিয়া হয়তো তার মূল্য বুঝে তাকে অস্তপারের সন্ধ্যাতারার কাছে খুঁজবে। তাকে খুঁজতে গিয়ে অরণ্য-পর্বত, সমুদ্র-মরুভূমিতে যাত্রা করবে। গানের আসরে যখন কবি-দয়িতার বন্ধুজন তাঁকে কবিকৃত গানটি গাইতে বলবে তখন হয়ত কবিপ্রিয়ার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠবে। নিশীথ রাতে স্বপ্নভঙ্গে কবিপ্রিয়ার চোখে জল আসবে তাঁর মনে পড়বে কতরাত্রে কবির বাহুবন্ধনে গোপন-নিবিড় হয়ে সে ধরা দিয়েছে। এই সুখস্মৃতি হয়তো দয়িতাকে একদিন ব্যাকুল করে তুলবে। তখনই সেই নারী তার অবহেলার ফলশ্রুতি বুঝতে পারবে। কবির সমাধির বুকে ফুল দিতে গিয়ে কবিপ্রিয়ার মনে পড়বে কবিকে ‘শিউলি-চাপা সমাধি’ দেখে তার কবির কথা মনে পড়ে অন্তর কেঁদে উঠবে। দয়িতার বুকের মালা তাকে জ্বালা দেবে। তখন চোখের জলে তার বুক ভেসে যাবে, মুখের হাসি মিলিয়ে যাবে। শিশির-ভেজা রাত্রি যখন আশ্বিনের বুকে নেমে আসবে তখন অন্য বন্ধুর স্পর্শানুভূতির সঙ্গে কবির সঙ্গে তার দয়িতার সোহাগ-স্পর্শের স্মৃতি কবিপ্রিয়াকে বিদ্ধ করবে। বার বার শীতের রাত পৃথিবীতে আসবে, কিন্তু তার প্রেয়সী কোনোদিন আর আসবে না। কবি অভিমান করে বলেছেন—
‘তোমার সুখে পড়ত বাধা থাকলে যে জন পার্শ্বে
আস্বে নাক’ আর সে!
এই উক্তির মধ্যে প্রেমিকের অভিমান ধ্বনিত হয়েছে।
কবি প্রেমের যুগল-জীবনের রমণীয় চিত্র পরিস্ফুট করেছেন। এই যুগল-চিত্র বর্ণনায় কবির রোমান্টিক অনুভূতি সার্থক হয়ে ফুটে উঠেছে—
আবার গাঙে আস্বে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে,
সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে
দুলবে তরী রঙ্গে।
প’ড়বে মনে, সে কোন্ রাতে
এক তরীতে ছিলে সাথে
এম্নি গাঙে ছিল জোয়ার,
নদীর দু’ধার এম্নি আঁধার
তেমনি তরী ছুটবে বুঝবে সেদিন বুঝবে।
–এই চিত্র প্রেমিক ও প্রেমিকার যুগল নৌ-যাত্রার চিত্র। এই চিত্র রচনা স্মরণ করিয়ে দেয় শেলীর প্রেমের কবিতার চিত্র। সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্টিক প্রেমের কবি এইভাবে প্রেমের অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন। নদীর দুধার তখন হয়তো অন্ধকারে পূর্ণ থাকবে, গাঙে থাকবে জোয়ার । সেই জোয়ারের বুক চিরে নৌকা ছুটে চলবে, তার সেই আনন্দিত অভিসারে নায়ক নায়িকার প্রেমলীলা হবে অকুণ্ঠ। এই আনন্দ-যাত্রায় কবির সঙ্গে অনুরূপ যুগল-স্মৃতি হয়তো কবিপ্রিয়াকে বিদ্ধ করবে। কবিপ্রিয়া হয়তো সে-কথা স্মরণ করে দুঃখে আকুল হয়ে উঠবে।
নিসর্গচিত্রের সঙ্গে মানস-সংযোগ রোমান্টিক প্রেম কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
Herford এই রোমান্টিক কবিতাকে বলেছেন, ‘poetry of man and nature’ । রোমান্টিক কবিতায় প্রকৃতির অনুষঙ্গে তাই প্রেমের স্পন্দন জেগে উঠেছে—
ফুট্বে আবার দোলন-চাঁপা চৈতি-রাতের চাঁদনী
আকাশ ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদনী
চৈতি-রাতের চাঁদনী।
নীল আকাশের বুকে অশ্রু-ভরা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কবিপ্রিয়ার চোখে জল ভরে আসবে। কবি সেই মুহূর্ত স্মরণ করে বলেছেন ‘বুঝবে সেদিন বুঝবে’–এই উক্তির মধ্যে কবিচিত্তের প্রেমানুভূতি-জাগা অভিমানই ফুটে উঠেছে।
প্রেমের কবিতায় কবিরা প্রেমের নানাচারী চিত্র অঙ্কন করেন। সেই সব চিত্রমালায় প্রেমের নানা অভিজ্ঞতা, শরীরী সম্পর্কের নানা অনুরাগ চিত্রিত হয়ে উঠেছে। ‘অভিশাপ’ তার ব্যতিক্রম হয়নি—
প’ড়বে মনে, নেই সে সাথে
বাঁধৃতে বুকে দুঃখ-রাতে-
আপ্নি গালে যাচ্বে চুমা,
চাইবে আদর, মাগ্বে ছোঁওয়া,
আপনি যেচে চুম্বে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
এই চিত্র প্রেমের কবিতার সার্থক চিত্র।
Leave a comment