গীতিকবিতা কবিতার একটি প্রকারভেদ। গীতিকবিতায় কবি-মনের একান্ত অনুভূতি প্রকাশিত হয়। কবিহৃদয়ের ব্যক্তিগত ভাব যে স্বল্পপরিসরের কবিতায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তাই গীতিকবিতা। গীতিকবিতায় অহংতন্ত্রী ভাবের প্রকাশ ঘটে বলেই গীতিকবিতা Subjective বা মন্ময়-লক্ষণে লক্ষণাক্রান্ত। গীতিকবিতার মধ্যে কবিকে চেনা যায়। কারণ কবিমনের ব্যক্তিগত পরিচয় গীতিকবিতায় প্রতিফলিত হয়। এই আত্মভাব প্রাধান্যের জন্য গীতিকবিতায় একটিমাত্র ভাবের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। গীতিকবিতায় আবেগের তীব্রতা প্রকাশ পায় বলেই গীতিকাব্যের আঙ্গিক সংহত ও ঘনপিনদ্ধ রূপ লাভ করে। নজরুলের ‘অভিশাপ’ সার্থক গীতিকবিতা। নজরুলের কাব্যে আছে spontaneous overflow of powerful feelings’। আবেগের এই তটপ্লাবী প্রকাশ তাঁর গীতি-কবিতার সংহত কায়াকে কখনো কখনো ক্ষুণ্ণ করলেও গীতিকবিতার যে মৌল সাফল্য, তা থেকে নজরুলের কবিতা বঞ্ছিত নয়।

‘অভিশাপ’ নজরুলের একটি বিশিষ্ট প্রেমের কবিতা। প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস ও করুণ অভিমান এই কবিতার বিষয়বস্তু। রোমান্টিক প্রেমানুভূতির করুণ-মধুর অভিমানী অভিব্যক্তি আবেগের তীব্রতায় অভিশাপের রূপ গ্রহণ করেছে, তাই কবিতার নামকরণ হয়েছে ‘অভিশাপ’। যে কবি প্রেমের যোগ্য সমাদরলাভে বঞ্চিত, সেই কবিতার মর্মানুভূতি তীব্র আবেগে প্রকাশ পেয়েছে। গীত-কবিতার মধ্যে গানের সম্পর্ক নিবিড়, তাই গানের মধ্যে যেমন ধ্রুপদ বা refrain থাকে, অভিশাপ কবিতাটিতেও তেমনি মূলভাবের সুর গীতিসুরে ঝঙ্কৃত থাকে

‘বুঝবে সেদিন বুঝবে’

প্রতিটি স্তবকের শেষে এই ‘বুঝবে সেদিন বুঝবে’ একটি গীতিসুর ধ্বনিত করেছে।

গীতিকবিতার মূলভাবটি প্রেমের যে অভিমান, যে দুঃখবোদ, তা গীতিসুরে বর্ধিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রেমাবেগকে কবি নানা ভাবে প্রকাশ করেছেন, কখনো নিসর্গচিত্রে, কখনও অনুভবের মধ্য দিয়ে। এর ফলে প্রেমের নানা চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। এই চিত্রগুলি আবেগ-স্পন্দী । মিথুনলীলার আবেগধর্মে রঞ্জিত হয়ে চিত্রগুলি গীতিকবিতাসুলভ গভীর ও তীব্র আবেগের প্রকাশে একনিষ্ঠ—

ভাব্‌বে, বুঝি আমিই এসে

বসনু বুকের কোটি ঘেঁসে

ধরতে গিয়ে দেখবে যখন-

শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন !

বেদনাতে চোখ বুজ্‌বে

বুঝবে সেদিন বুঝবে!

নিশীথরাত্রিতে প্রেমিকার ঘুম-ভাঙা বেদনায় যে আর্তি প্রকাশিত হয়েছে, সেই আর্তি গীতিকবিতার আবেগে গভীর। যুগল জীবনের চিত্রসৃষ্টিতে কবি সার্থক হয়েছেন, তার মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছে গীতিকবিতা সুলভ আবেগধর্ম—

আবার গাঙ্গে আস্‌বে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে

সেই তরীতে হয় তো কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে

দুলবে তরী রঙ্গে। 

প’ড়বে মনে, সে কোন্ রাতে 

এক তরীতে ছিলে সাথে, 

এম্‌নি গাঙে ছিল জোয়ার 

নদীর দু’ধার এম্‌নি আঁধার,

তেমনি তরী ছুটবে-

বুঝবে সেদিন বুঝবে।

এই রোমান্টিক চিত্র রবীন্দ্রনাথ ও শেলীর কবিতায় পাওয়া যায়। কিন্তু এই চিত্রগুলি গীতি আবেগে পূর্ণ। এই ধরনের আর একটি রোমান্টিক চিত্র গীতি-আবেগে অনুরঞ্জিত হয়ে আছে—

ফুট্‌বে আবার দোলন-চাঁপা চৈতি-রাতের চাঁদনী,

আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদনী

চৈতি-রাতের চাঁদনী।

‘চৈতি রাতের চাঁদনী’—বাক্যটির পুনরাবৃত্তি এখানে ফুটিয়ে তুলেছে আবেগের দোলা, এই আবেগের দোলার মধ্যে ধ্বনিত হয়ে সুরের স্পর্শ। এই সুরধর্মিতা বার বার কবিতাটিতে প্রকাশিত হয়েছে বলে কবিতাটিকে বলা চলে সার্থক গীতিকবিতা।