শিলাইদহে একদিন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শিলাইদহ যেন এক অভিন্ন সত্তা । বাংলাদেশের শিলাইদহকে কেন্দ্র করে কবির অসংখ্য লেখা রয়েছে । এছাড়া শিলাইদহের পাশেই রয়েছে বাউল সাধক লালন শাহের আস্তানা; আছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল মীর মশাররফ হোসেনের পৈত্রিক ভিটামাটি । এছাড়াও রয়েছে তৎকালীন গ্রামবার্তা সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের নানা স্মৃতি । সুতরাং শিলাইদহ পৌঁছতে পারলে অনেক কিছু জানা যাবে । কিন্তু রহমান এ ব্যাপারে বরাবরই গররাজি । অবশ্য ওকে বেশ বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পারলাম; বলা যায় একটা যুদ্ধে বিজয়ী হলাম । জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে, সকাল বেলায় সাহেব বাজার থেকে বাসে কুষ্টিয়ার উদ্দেশে দুই বন্ধু রওনা দিলাম । রহমানের পিঠে একটি বড়ো ব্যাগ ছিল, বাসে উঠে দুজনে সেটি নামাতেই সুপারভাইজার এসে বললো— “ভাই আমাকে দেন, ওটি লকারে রাখি।’ ব্যাগটি লকারে রাখা হলো । ততক্ষণে আমরা বেশ আরাম করে বসলাম । সাঁ সাঁ গতিতে বাস চলতে লাগল । প্রচণ্ড শীতের পর গাছপালা যেন কেমন মলিন হয়ে গেছে; তবুও একের পর এক সবুজের বেষ্টনী ভেদ করেই যেন আমরা চলছি । আমাদের সাথে পানি, বিস্কুট, লজেন্স ও চুইংগাম ছিল । কাজেই প্রায় সমস্ত রাস্তাই কিছু না কিছু খেয়েই যাচ্ছিলাম । আমাদের ডানদিকের সিটে একজন ভদ্রলোক তার ছোটো একটি বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছিলেন; আমরা বাচ্চাটিকে একটি লজেন্স দিতে চাইলাম । সে তার বাবাকে বললো— ‘আব্বু ওরা আমাকে লজেন্স দিতে চায়…’ ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন— ‘শুধু একটা দেন, এই লজেন্স খেয়ে ওর দাঁতগুলো পোকায় ধরেছে।’ আমরা বললাম, লজেন্স নয় তাহলে ওকে বিস্কুট দিচ্ছি।’ এর মধ্যে চোখ দুটিও কিছুটা বুজে গেছে বোধহয়; কেননা তীব্র শীতের পর এমন সূর্যের কোমল তাপ গায়ে আসামাত্রই ঘুম পেয়ে যায় । অবশ্য চোখ খুলে দেখি আমরা লালন সেতুতে পৌঁছেছি । দুজনে হাসলাম; ঘুমের মধ্যে এতদূর! শুধু আমরা না রবং ঐ ভদ্রলোক তার বাচ্চাটিকে নিয়েই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন । যাহোক, আমরা দুপুরের পর পরই কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছলাম । একটি আবাসিক হোটেলে উঠলাম । হাতমুখ ধুয়ে খেতে যাবো— নিচে নামতেই দেখি বড়ো একটি খাবার হোটেল । বোয়াল মাছ দিয়েই দুই বন্ধু খেয়ে নিলাম । বলা দরকার যে, এখানে তুলনামূলকভাবে কম দামেই খেলাম । এরপর হোটেলে ফিরে ম্যানেজারকে আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বললাম— তিনি বললেন ‘আজ আর যেয়ে ভালোভাবে দেখতে পারবেন না, বরং রেস্ট করেন, আগামীকাল সকালে যাবেন । আমরা তাই করলাম । পরের দিন সকালে উঠে নাশতা সেরে যখন বের হলাম, ম্যানেজার একজন বয়কে আমাদের কোথা থেকে বাসে উঠতে হবে তা দেখানোর জন্য পাঠালেন এবং শিলাইদহে যাবার একটি ম্যাপও তিনি অঙ্কন করে দিলেন । তাকে ধন্যবাদ দিয়ে শিলাইদহের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম । আমরা মীর মশাররফ হোসেন সেতু পার হয়ে আরও কিছুদূর যাওয়ার পর বাস থেকে নেমে ভ্যানে রওনা দিলাম । অবিশ্বাস্য! এখন গ্রামের মধ্য দিয়ে এভাবে রাস্তা দিয়ে আমাদের যেতে হয়; তাহলে রবীন্দ্রনাথের সময় এ গ্রামগুলোর দশা কী ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর আমরা শিলাইদহে পৌঁছলাম । সামনের বিশাল মাঠ দেখেই মনে হলো রবীন্দ্রনাথ তার বাসভবন থেকেই গগণ হরকরাকে আসতে দেখেছেন । শুধু তাই না; তিনি গগণের সেই বিখ্যাত গান ‘আমি কোথায় পাব তারে… আমার মনের মানুষ যে রে’- এখান থেকে শুনতেন । আমরা দশ টাকার টিকিট নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম । কী বিশাল বাসভবন; সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম এবং দেখলাম তাঁর ব্যবহৃত নানা ধরনের জিনিস এমনকি নৌকা পর্যন্ত । সবচেয়ে অবাক হলাম এত চিত্র তিনি এঁকেছেন; আমরা তো এগুলোর খবরই জানতাম না । কবি এ বাসভবনের ছাদ থেকে পদ্মানদীকে দেখতেন; আর এখান থেকেই বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ রচনা পাওয়া গেছে । বাসভবনের সীমানাপ্রাচীরও আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করলো । পদ্মার ঢেউয়ের মতো করে এ প্রাচীর সাজানো। আসলে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। বাসভবনের পেছনে পুকুরে পদ্মাবোট এখন ভাসছে, অথচ এই পদ্মাবোটে বসে কবি কতনা গান, কবিতা, ছোটোগল্প লিখেছেন । তাঁর অনেক বিখ্যাত রচনার মধ্যে ‘সোনার তরী’ কবিতাও এ বোটে বসে রচিত হয়েছে। রহমান বলল, সত্যি বন্ধু তোমাকে অনেক ধন্যবাদ; সময় এত দ্রুত চলে গেছে আমরা জানতেই পারিনি । অবশেষে শহরের উদ্দেশে চলে এলাম।
Leave a comment