শান্তিনিকেতনে একদিন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শান্তিনিকেতন একসূত্রে গাঁথা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-শিল্প সাধনা আর আরাধনার তীর্থস্থান শান্তিনিকেতন । সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়তে পড়তে শান্তিনিকেতন দেখার তীব্র বাসনা মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগল । অবশেষে সুযোগ পাওয়া গেল; সুযোগ মানে একেবারে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! ছোট মামা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একদম জাত ভক্ত; তাই তিনি বললেন— ‘চল আমরা শান্তিনিকেতন ঘুরে আসি ।’ প্রস্তাবটি এমন যে সত্যি আমার হ্যাঁ বলতেও কিছুটা সময় লেগেছিল । মামা হাসলেন— ‘কিরে খুশি হয়েছিস’ । একটু তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ালাম । মামা বললো তোর পাসপোর্ট, ভিসা– সব আমার দায়িত্ব । মনটা যেন সেদিন থেকে অন্যরকম হয়ে গেল; মামা প্রায় সব কাগজপত্রাদি তৈরি করে আমাকে বললো— “শুধু এখানে স্বাক্ষর কর’ । প্রায় মাস দেড়েক পরে মামা ফোন দিলেন— ভিসা হয়ে গেছে । আমরা রওনা হলাম । যাক অনেকটা পথ পেরিয়ে শান্তিনিকেতনের পথে প্রথম আমরা কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছলাম । তারপর হাওড়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে বোলপুরের উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু হলো । কলকাতা থেকে প্রায় দুশো কি.মি. উত্তরে বীরভূম জেলার বোলপুরে শান্তিনিকেতন । একসময় এ অঞ্চলের নাম ভুবনডাঙা ছিল, জমিদার ভুবন সিংহের নামানুসারে । জনশ্রুতি আছে যে, কোনো এক নিমন্ত্রণে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভুবনডাঙায় গেলে রাত হয়; সে রাতে আকাশে চমৎকার জ্যোৎস্নার আলোয়, মাঠের মাঝে একটি ছাতিম গাছের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে তিনি অভিভূত হয়ে এখানে কুড়ি বিঘা জমি মাত্র পাঁচ টাকায় পাট্টা নিয়েছিলেন । আর এখান থেকেই শুরু । আমরা যখন বোলপুরে পৌঁছলাম; তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে । শান্তিনিকেতনে প্রবেশ করতেই সবচেয়ে যে বিষয়টি আমাকে দারুনভাবে আন্দোলিত করল— তা হলো অসংখ্য বৃক্ষের এক বড়ো সমাহার, কবি যেন এগুলো আপন হাতে থরেবিথরে সাজিয়েছেন । কবির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি যেন এর সর্বত্রই অনুভব করলাম । উদয়ন, কোনারক, শ্যামলী, পুনশ্চ ও উদীচী— এগুলো নিয়েই কমপ্লেক্স । সময়-সুযোগ ঘটলেই রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে থাকতেন । তাঁর অসংখ্য মূল্যবান রচনা এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে । আরও আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো— রবীন্দ্রভবন । এই ভবনের মূল নকশাটি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন । এটি একটি জাদুঘরের মতো । এখানে দেখতে পেলাম কবির ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামগ্রী, তাঁর নিজ হাতে অঙ্কিত বিভিন্ন ধরনের চিত্র । আর একটু ভেতরে চোখ পড়তেই দেখলাম উপাসনাগৃহ । ১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপাসনাগৃহ নির্মাণ করেন । বেলজিয়াম কাচ আর মার্বেল পাথরের চমৎকার কারুকার্যময় ভবনটি । উপাসনার জন্য সূর্যাস্তের পর মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় । তখন মনে হয়, সমস্ত শান্তিনিকেতন যেন এক নীরব ধ্যান আর প্রার্থনায় মগ্ন । সত্যি এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য । এ দৃশ্য অন্তরে ধারণ করে একটু এগিয়ে আমরা দেখলাম দেহলি; দুতলা একটি বাড়ি । এখানেই কবি তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে বসবাস করতেন। এরপরে আরও একটি বাড়ি, যার দেওয়াল নানা ধরনের শিল্পকর্মে উৎকীর্ণ । এবার আসা যাক এখানকার শিক্ষা-দীক্ষার কথায় । শিক্ষা-বছরের শেষে এখানে স্নাতকদের সমাবর্তনের আয়োজন করা হয় । মজার বিষয় হলো— সমাবর্তনে স্নাতকদের সপ্তপর্ণী গাছের পাঁচটি পাতার গুচ্ছ উপহার দেওয়া হয় । এ প্রসঙ্গে মামা এক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বললেন; তিনি আমাদের শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-সংক্রান্ত আরও অনেক তথ্য দিলেন । তাঁরা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শ অনুযায়ী শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করতে। তবে কিছুটা নিরাশার কথাও তিনি শোনালেন । সে যাহোক, যখন ফিরতে চাইলাম তখন মনে হলো আরও কিছুক্ষণ থেকে যাই এমন সুন্দর পরিবেশে । কেননা, শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে যেন আরও আপন করে পেলাম, আসলে কে বলে এখানে তিনি নেই? 

তাইতো স্পষ্টভাবে কবির সেই আহবান শুনতে পেলাম—
তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই – আমি ।