অভিজ্ঞতা বর্ণনা : রেল ভ্রমণ |
রেল ভ্রমণ
অনেক দিন ধরে ঢাকায় থেকে মনটা কেমন জানি বিষিয়ে উঠেছে। তাই এবারের গ্রীষ্মের ছুটি একশত ভাগ কাজে লাগাব বলে। প্রতিজ্ঞা করলাম। বাবাকে কয়েকদিন আগ থেকেই বলেছিলাম, শাওনদের বাসায় বেড়াতে যাব, অতএব আমাকে বেশ কিছু টাকা দিতে হবে। বাবা হাসলেন, বেশ কিছু মানে… এত টাকা কী করবি? আমি বললাম, একদম দেশের উত্তর সীমান্তে লালমনিরহাট জেলায় যাবাে। শাওনের বাড়ি ওখানে। আমরা কীভাবে যাবাে, বাবা তা ভালােভাবে শুনলেন। কয়েকদিনের মধ্যে কলেজ ছুটি হলাে । সেদিন শাওন আমাদের বাসায় আসলাে। আমরা সব গুছিয়ে নিয়ে রাতে বের হলাম; একটি সিএনজি নিয়ে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পৌছে দেখি প্ল্যাটফরমে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়; শাওন অনেক কষ্টে দুটো টিকিট জোগাড় করল । এরপর আমরা মূল ফটক পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্লটফরমের স্ক্রিনে দেখলাম লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রায় ২ ঘণ্টা পরে ঢাকায় পৌছবে। কী আর করা, শাওন বলল ট্রেন লেট হলে, বাদাম খেতে হয়। সামনেই হাঁকছেন, ‘এ… ই… বা… দা…ম। যাক বাদাম খেতে খেতে আর গল্প করতে করতে সময় কেটে গেল। প্রায় রাত ১২.৩০টায় ট্রেন এসে পৌছল । লােকজন সব তড়িঘড়ি করে ট্রেনে উঠল । আমরা ‘ঘ’ বগিতে চেয়ার কোচে উঠলাম, গদি সাঁটানাে চেয়ার বেশ ভালােই লাগলাে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমাদের পুরাে কামরা যাত্রীতে ভরে গেল। জানতে পারলাম এ অঞ্চলের আরেকটি ট্রেন ‘রংপুর এক্সপ্রে’ আজ বন্ধ থাকায় এমন ভিড়। তবুও আমরা আরামেই বসে গল্পে মজে গেলাম। কিছুক্ষণ পরেই যে ঘুমিয়ে গিয়েছি দুজনে তা মালুমই করতে পারিনি। হঠাৎ করে কানে শব্দ আসলাে— ‘পানি – পানি—’। শাওন বললাে আমরা বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌছেছি, এখানে প্রায় মিনিট দশেকের বিরতি। তাই যাত্রীরা নেমে অনেকেই চা খাচ্ছে, এত রাতেও দেখলাম দু’চারটি চায়ের দোকান, ডিমওয়ালা আর পাশের বাড়ি থেকে ছােটো ছেলেরা কলসভর্তি পানি আর গ্লাস এনেছে। পানি চাইতে ছােটো ছেলেগুলাে দৌড়ে যায়, টাকা-পয়সা চায় না; যাত্রীদের যেমন ইচ্ছে তাই দেয় আরকি। একটু খারাপ লাগলাে, এত রাতে ছােটো ছেলেরা না ঘুমিয়ে এভাবেই কাটায়; অন্যদিকে ভালাে লাগল এই জন্য যে, এরা তাে আর রীতিমতাে এটাকে ব্যবসায় হিসেবে নেয়নি বরং বলা যায়, এটাও এক ধরনের মানবসেবা। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল। আবার যেন আমাদের ট্রেনটি সরগরম হয়ে উঠল । বঙ্গবন্ধু সেতুটির ওপর দিয়ে যখন ট্রেনটি যাচ্ছিল অনেক নিচে যমুনা নদীর দৃশ্য দেখছিলাম। আরও ভালাে লেগেছিল সেদিন আকাশে পুরােমাত্রায় ঠাদ ছিল। ফলে নিচে নদীর স্রোত, উপরে চাঁদের আলাে, আর মাঝ দিয়ে মালার মতাে এ সেতুর ল্যাম্পপােস্টের আলােয় এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা হলাে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর আমরা নাটোর স্টেশনে পৌছলাম । নাটোর স্টেশন না দেখলেও নামটি বােধহয় কবি জীবনানন্দ দাশ তার বনলতা সেন’ কবিতায় ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি পরিচিত করেছেন। হঠাৎ করে শােরগােল শুনা গেল; জানতে পারলাম পাশের বগিতে এক বৃদ্ধার ব্যাগটি চুরি হয়েছে। বৃদ্ধ মহিলা জোরে কান্নাকাটি করছেন। কেননা তিনি গত মাস ছয়েক ঢাকায় কাজ করে যে টাকা-পয়সা উপার্জন করেছেন, তার প্রায় সব ঐ ব্যাগেই ছিল। যাক সকলেই সান্ত্বনা দিলেন। রেলের পুলিশ আসলেন। নানাজন বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলেন। তাই কথায় বলে, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ । পরের দিন সকাল ৯টায় আমরা লালমনিরহাট পৌছলাম। শাওনকে বললাম এখানেও এত ট্রেনের কারবার আর অফিস কেন? ও বললাে, লালমনিরহাট ট্রেনের একটা বিভাগীয় দপ্তর। ট্রেনকে বিদায় দিয়ে এবার অটোরিকশায় প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে মােগলহাটে শাওনদের বাসায় পৌছলাম। ওর বাবা-মা আর ভাই-বােনদের যে আদর-যত্ন তা বলার মতাে নয় । সত্যি গ্রামের মানুষের মন নরম-পলিমাটি দিয়ে গড়া । ৬/৭ দিন পর আবার ফিরলাম ঢাকার উদ্দেশে; মন কিছুতেই আসতে চায় না, কিন্তু বাবা ফোন করেছেন। সেদিন দিনের আলােয় ট্রেনে গ্রাম-বাংলার সবুজ-মাঠ দেখতে দেখতে রাত ৯টায় কমলাপুরে এসে পৌছলাম । এ ভ্রমণে শুধু একটি অনুভূতি কত সুন্দর এ আমাদের দেশ।
Leave a comment