নৌকা ভ্রমণ

তখন ক্লাস শেষ হয়নি, জানতে পারলাম আনােয়ার স্যার আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষেই আনােয়ার স্যার বসেছিলেন; আমাদের দেখামাত্রই তিনি বের হয়ে আসলেন— আমরা অবশ্য কারণ এর আগেই জানতে পেরেছি। তবে স্যার যখন নেকী এমণের কথা বললেন তখন বিষয়টি বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল। আমাদের সিদ্ধান্ত হলাে আগামী ১২ তারিখ সকাল ৮টায় নৌকায় করে সেই বিখ্যাত চিলমারির বন্দর’ দেখতে যাব। কাজেই আমাদের প্রস্তুতির জন্য আরও দুদিন সময় পাওয়া গেল। কিন্তু পরের দিন থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাই প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের বললেন- শুধু ভ্ৰমণ নয় আমরা এর সঙ্গে কিছু ত্রাণসামগ্রীও বন্যার্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করব । যে যার মতাে কাপড়-চোপড়, চাল-ডাল, মােমবাতি, চিড়া-মুড়ি, গুড়-চিনি সংগ্রহ করলাম। পরের দিনই আমাদের যাত্রা শুরু। খুব সকালেই গােসল সেরে তৈরি হয়ে রিকশা করে আসলাম বিধুবাবুর ঘাটে। এসেই দেখি চারদিক শুধু পানি আর পানি। দেখলাম ঘাটে বড়াে বড়াে দুটি নৌকা। কিন্তু তবুও কেন জানি ভয় হচ্ছিল। শায়লা, রাবেয়া ও অঞ্জনাসহ আরও চার-পাঁচজন তাে এত পানি দেখে ওরা চলেই গেল । আমরা যারা থাকলাম, বলা যায় তারা সাহসী। কওঁ তবুও অনন্ত বলল, কেন্ জানি ভয় লাগে। সে কথাকে শেষ পর্যন্ত কেউই যেন আর পাত্তা দিলাে না। তাই আমরা খুব তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠলাম। বড়াে নৌকার পেছনে বেশ মজবুত ছই দেওয়া এবং নৌকার মাঝিরা ভেতরে বড়াে পলিথিন রেখেছে, বৃষ্টিতে আমরা যেন। ভিজে না যাই। যতদূর সম্ভব আমাদের ত্রাণসামগ্রীগুলাে পলিথিন দিয়ে ভালােভাবে ঢেকে রাখা হলাে; আমাদের নৌকায় তিনজন মাঝি। মাত্র । একজন একটি বডাে লগি দিয়ে ঘাট থেকে নৌকা পানিতে ভাসিয়ে দিলাে। মুহূর্তে স্রোতের তীব্রতায় নৌকাটি যেন ভাটির দিকে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম নৌকায় পাল উঠল । তখন নৌকাটি দ্রুত বেগে উজান ধেয়ে চলছে। সামনেই সাতালঙ্করের চর। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার মাঝিদের পাল নামাতে বললেন, দেখতে পেলাম ছােট্ট একটি গ্রামে ঘরের মধ্যে পানি ঢুকেছে, বাড়ির আঙিনায় সেই পানিতে ছােটো ছেলেমেয়েরা ‘ঝামবলি’ খেলছে; বন্যা, পানি- এ নিয়ে তাদের কোনাে মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু বয়স্করা দারুণ উদ্বিগ্ন। আমাদের নৌকা দেখামাত্রই তাদের মধ্যে যেন একটু আশার সঞ্চার হলাে— আমরাও আমাদের যতটুকু ত্রাণসামগ্রী ছিল তা বিতরণ করলাম। তবে মনে হলাে চাহিদার তুলনায় সামান্য পরিমাণ মাত্র। জানলাম প্রায় সাত দিন ধরে তারা এভাবে পানিবন্দি হয়ে আছে। একে তাে বৃষ্টি তারপর পাহাড়ি ঢল । আমরা নৌকায় উঠতে না উঠতেই যেন বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেল। আমাদের অনেকে পলিথিনের নিচে ঢুকে পড়ল। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মনে হলাে জলেস্থলে সর্বত্রই জল আর জল। কিছুদূর এগিয়ে যেতে দেখলাম কচুরিপানা ভেসে আসছে, তার ওপর একটি সাদা বক মাছ শিকারের নেশায় বুদ হয়ে প্রায় আমাদের পাশাপাশি চলে এসেছে। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার একটা ছবিও তুলে নিলেন। আরও একটু অগ্রসর হয়ে দেখলাম নদীর তীরে একটা পাটখেতে প্রায় ডুবে ডুবে দশ-পনেরাে জন লােক পাট কাটছে; অথচ তাদের কণ্ঠে কী চমৎকার গান- ‘ঐ কইন্ন্যা কেনে করিস মুখ ভারী/অমপুর থাইক্যা আইন্যা দিমু পাটের শাড়ি। মনে হলাে এই তাে আবহমান বাংলার চিরচেনা রূপ। এবার আমাদের নৌকা পৌছল ব্রহ্মপুত্র নদে; সে কী বিশাল জলরাশি। যথারীতি এবার পালে হাওয়া লাগল আর আমরা পৌছলাম চিলমারির বন্দরে । কিন্তু ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/হাকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে বিখ্যাত গানের সেই বন্দর নেই । স্থানীয়রা বললেন— মূল বন্দরটি অনেক আগেই এ নদের গর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে। আমরা এবার জোড়গাছ নামক জায়গায় দেখলাম অনেক নৌকা বাঁধা, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়-বাণিজ্য করার জন্য এখানে একদিন অনেক মানুষ আসত। এখন এই এ ‘জোড়গাছ’ চিলমারি বন্দরের অভাব অনেকটাই পূরণ করেছে। দেখতে দেখতে পড়ন্ত বিকেল হয়ে গেল; সুতরাং এবার বিদায়ের পালা। এখন আর পাল তুলে নয়, দাঁড় বেয়ে নয় বরং একজন মাঝি শুধু হাল ধরে থাকল নৌকা ভাটির টানে চলছে। প্রবীণ মাঝি গলা ছেড়ে দিয়ে গাইল- নদীর কুল নাই/ কিনার নাইরে…’ সন্ধ্যার পর আমরা পৌছলাম। অনেকের অনেক কিছু ভালাে লেগেছে, কিন্তু কেন জানি ছােটো ছােটো শিশুগুলাের পানিতে সেই ঝামবলি’ খেলা আমি কোনাে দিনই ভুলতে পারব না।