একটি ভয়ংকর রাত

সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করেছি মাত্র । লুবসা বায়না ধরল নানাবাড়িতে যাবে । কী করি? আম্মাও বলল ‘যা বোনকে সাথে নিয়ে একটু ঘুরে আয় ।’ যাক মনটাও চাইল নানাবাড়িতে যেতে । দুদিন পরেই নানাবাড়িতে চলে আসলাম । কয়েকদিন ধরে পরীক্ষা; তাই বের হতে পারিনি । এখানে এসে মনে হলো মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াব সারা রাত-দিন ।

পড়ন্ত বিকেলেই বেরিয়ে পড়লাম । ‘লক্ষ্মীপুর হাইস্কুল’ এ এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান । অনেক আগ থেকে এ স্কুলের বিশাল মাঠে যাত্রা, সার্কাস প্রভৃতির আয়োজন হতো। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্যোগে এ ধরনের অনুষ্ঠানাদি প্রায় প্রতিবছরই হয়ে থাকে । বাজারের পাশে স্কুলটি । জানতে পারলাম যাত্রা নয় বরং এখানে কবিগানের আসর বসবে । আরও জানলাম মানিকগঞ্জ থেকে দুজন বয়াতি এসেছেন । মূলত শরিয়ত, তরিকত, হকিকত আর মারফতের বিষয় নিয়ে এ আয়োজন হবে । আমার অবশ্য এ বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই । তবুও যখন দেখলাম অনেক বয়োবৃদ্ধ মানুষ এসে ইতোমধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়েছে তখন একটু কৌতূহল জাগল আচ্ছা অন্তত কিছুক্ষণ দেখি কেমন লাগে? কিন্তু না এ এক বড়ো আয়োজন । কিছুক্ষণ পরেই কবি বা বয়াতিরা মঞ্চে উঠলেন; তারা দুটো দলে বিভক্ত হয়ে দুদিকে বসলেন । যাহোক মূল পর্ব শুরু হয়ে গেল । কিন্তু আমার কিছুতেই যেন মন বসছিল না । অথচ ঘনঘোর অন্ধকার । কীভাবে ফিরে যাব? বশির বাড়িতে থাকলে হয়তো এ ধরনের অসুবিধায় পড়তাম না । বড়ো মামা বলল ও আজ সকালে কলেজ হোস্টেলে চলে গেছে । কিন্তু কী করি, এখান থেকে প্রায় ৩ কি.মি. দূরে রাজিবপুর । নানাবাড়ির আশপাশের কোনো মানুষকেও দেখছি না । কাউকে বলতেও পারছি না কীভাবে এত রাতে যাব । লজ্জা, ভয়- দুটোই যেন আমাকে পেয়ে বসল । বড়ো মামা হয়তো জানেন না । অগত্যা আল্লাহ ভরসা করে সে অন্ধকার রাতে যখন পা বাড়ালাম; প্রথমেই শরীর শিউরে উঠল I তারপরেও আরও কিছুদূর এগিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টি আমাকে দুর্বল করল তা হচ্ছে— একটি বড়ো শিমুল গাছ । এটির আশপাশে তেমন কোনো বাড়ি নেই । সামনে-পেছনে আশায় থাকলাম যদি কাউকে সঙ্গী হিসেবে পাই । না ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়’ । কোথাও কাউকেও দেখতে পেলাম না । নানাবাড়িতে অনেক গল্প শুনেছি যে, এ শিমুল গাছের উপর এক সুন্দরী চুল ছাড়িয়ে বসে থাকে; অথচ কাছে গেলেই এত বিদঘুটে অন্ধকার কিছুই যেন দেখতে পায় না । আবার শুনেছি এক দৈত্য এই শিমুল গাছে বসে থাকে অথচ তার পা মাটি পর্যন্ত; এরপরেও কেউ যদি এ পাশ দিয়ে যায়— তার প্রচণ্ড জ্বর হয় এবং শেষ পর্যন্ত মারাও যায় । খুবই চেষ্টা করছি এসব গল্পের কথা মনে আনব না; অথচ ভয়ে এগুলো আরও যেন তীব্রভাবে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে । দেখতে দেখতে প্রায় শিমুল গাছের কাছাকাছি এসে পড়লাম । হঠাৎ যেন মনে একটু সাহস জাগল যে এগুলো আজগুবি কথা— আমি এগিয়েই যাব । সত্যি কথা বলতে কী শিমুল গাছটি নির্বিঘ্নে পার হলাম । কিন্তু আরও কিছু দূর যাবার পর দেখলাম ফাঁকা মাঠের মধ্যে একজন লোক দাঁড়িয়ে । প্রথমে ভাবলাম হয়তো গ্রামে অভ্যাসবশত বাইরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেই কেউ এসেছে। একটু সাহসও পেলাম । না তা নয়তো; লোকটির মোটেই কোনো ধরনের সাড়া নেই । আমার শরীর বেয়ে ঘাম ছুটলো, মনে মনে সকল দোয়া- দরুদ পড়তে লাগলাম । পা দুটো থরথর করে কাঁপতে লাগল । হায়! এ বিপদে কী করি? হঠাৎ কে যেন বলল— সবুজ! আমার জানে পানি আসল । পেছনে ফিরে দেখি বড়ো মামা । মামা বলল, ‘তোকে খুঁজতেই তো এসেছি। ভয় পেয়েছিস নাকি?’ আমার মুখ থেকে যেন কথা বের হচ্ছিল না ।