বাহমনী রাজ্যের রাজনীতিতে অভিজাতদের দ্বি-মেরুকরণ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এই রাজ্যকে কালক্রমে সংকটাকীর্ণ করে তুলেছিল। বাহমনী রাজ্যের সূচনা থেকেই গোষ্ঠী-রাজনীতির উপাদান লক্ষ্য করা যায়। প্রতিষ্ঠাতা শাসক বাহমন শাহ (হাসান) এই রাজ্যকে প্রথম চারটি তরফে বিভক্ত করে একজন করে তরফদারের অধীনে তা পরিচালনা করার যে রীতি প্রবর্তন করেছিলেন, পরবর্তীকালে সেখান থেকেই অভিজাতদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তরফদাররা মোটামুটিভাবে স্বাধীনতা ভোগ করতেন। কেন্দ্রে শক্তিশালী সুলতান কিংবা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকালে এই সকল তরফদার ক্ষমতার অপব্যবহার বা কেন্দ্রের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার সাহস বা সুযোগ পাননি। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এইসব ক্ষমতালোভী প্রাদেশিক শাসক স্থানীয়ভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশ্যে অভিজাতদের মধ্যে গোষ্ঠী-রাজনীতিকে পুষ্ট করেন।

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাহমনী রাজ্যের মুসলমান অভিজাতরা ক্রমশ দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়লে তরফদারদের বিচ্ছিন্নতাকামী প্রবণতা জোরদার হয়ে ওঠে। এই সময় মুসলমান অভিজাতরা—(১) দক্ষিণী মুসলমান ও (২) বিদেশি মুসলমান—এই দু-দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। বিদেশিরা ‘পরদেশি’ বা ‘আফাকি’ বা ‘ঘরিব’ বা ‘খরাবি’ নামেও অভিহিত হতেন। দক্ষিণী মুসলমান বলতে তাঁদের বোঝাত যাঁরা দীর্ঘকাল আগে বহির্ভারত থেকে এদেশে এসে বসবাস করছেন। দীর্ঘকাল এদেশে থাকার ফলে এঁদের রীতিনীতি, আদবকায়দা, কথাবার্তা এমনকি গাত্রবর্ণের ক্ষেত্রেও এদেশীয় প্রভাব ছিল স্পষ্ট। এই সকল বহিরাগত মুসলমান এদেশের মহিলাদের বিবাহ করে এদেশের মাটির সঙ্গে প্রায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। বাহমনী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকালে হাসান বাহমন যাঁদের রাজকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন, কালক্রমে তাঁরা সবাই দক্ষিণী মুসলমান হিসেবে পরিচিত হন। এই গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরিত হিন্দুরাও ছিলেন। যেমন, বেরারের ফতাউল্লা ইমাদ শাহ এবং আহম্মদনগরের আহমদ নিজাম শাহ আদিতে ছিলেন ব্রাহ্মণসন্তান। দক্ষিণী গোষ্ঠী স্বাভাবিক কারণেই নিজেদের এই রাজ্যের বৈধ দাবিদার, ধারক ও বাহক বলে মনে করতেন। নতুনভাবে বিদেশি মুসলমানদের আগমন ও বাহমনী রাজ্যের উচ্চপদে নিযুক্তি দক্ষিণীদের কাছে আদৌ কাম্য ছিল না।

অন্যদিকে রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে বহিরাগত মুসলমানরা পরদেশি (বিদেশি) বা ‘আফাফি নামে পরিচিত হন। এদের অনেকেই বণিক হিসেবে এদেশে আসেন এবং অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ বণিকদের মতোই, বণিকের মানদণ্ড ত্যাগ করে শাসকের রাজদণ্ড হাতে তুলে নেন। বাহমনী সুলতানরা বহিরাগত বিদেশিদের বেশি পছন্দ করতেন তাদের শৌর্য, বীর্য এবং দক্ষতার জন্য। ফলে পারস্য, তুরস্ক, আরব, আফগানিস্তান ও মধ্য-এশিয়ার ভাগ্যান্বেষী সৈনিকেরা দলে দলে ভারতে এসে বাহমনী রাজ্যে আশ্রয় নেন। বাহমনী সুলতানদের বদান্যতায় রাজ্য প্রশাসনে পরদেশিদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকে। সুলতান মুজাহিদ শাহ (১৩৭৫-‘৭৮ খ্রিঃ) পারসিক ও তুর্কি মুসলমানদের প্রকাশ্য অগ্রাধিকার প্রদান করে দক্ষিণীদের ক্ষুব্ধ করে তোলেন।

দক্ষিণ গোষ্ঠী ‘পরদেশি’দের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকলেও, প্রথমদিকে তাঁরা এঁদের বিপজ্জনক বলে মনে করতেন না। কারণ দক্ষিণীদের তুলনায় ‘পরদেশি’-দের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরদেশিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধও বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে সংখ্যাল্পতার কারণে পরদেশিরা অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষিণীদের সাথে মিলেমিশে থাকতে আগ্রহী ছিলেন। উভয়পক্ষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে সমন্বয়ের সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। কিন্তু ক্রমে পরদেশিদের সংখ্যা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেলে তাঁরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও উচ্চমার্গ সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়ে ওঠেন এবং দক্ষিণীদের প্রতি উন্নাসিক আচরণ শুরু করেন। ফলে দ্বি-মেরুকরণ চূড়ান্ত হয়।

ধর্মীয় কারণেও উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্রতর বিরোধ ছিল। পরদেশিদের অধিকাংশই ছিলেন ‘শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান। অন্যদিকে দক্ষিণীদের অধিকাংশ ছিলেন ‘সুন্নি’ মতবাদের সমর্থক। সুলতান আহম্মদ শাহ প্রকাশ্যে ‘শিয়া’ মুসলমানদের সমর্থন করতেন এবং দরবারে উপস্থিত হবার জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানান। এই ধর্মীয় কারণে সুন্নি মতবাদের অন্তর্ভুক্ত আবিসিনীয়রা দক্ষিণীদের পক্ষ গ্রহণ করে। শিক্ষিত, সুদর্শন পারসিক বা তুর্কি মুসলমানদের কাছে অশিক্ষিত, কৃষ্ণবর্ণ হাবশিরা সর্বদাই অবহেলার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হত। স্বভাবতই ধর্মকে সামনে রেখে এরা দক্ষিণীদের পক্ষ নেয়।

ক্ষমতার দৌড়ে টিকে থাকার জন্য দক্ষিণীরা সুযোগের সন্ধানে থাকে। আহমদ শাহ’র রাজত্বের শেষদিকে সেই সুযোগ উপস্থিত হয়। ১৪৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের বিরুদ্ধে বাহমনীদের তিনটি উপর্যুপরি আক্রমণ ব্যর্থ হয়। দক্ষিণীরা এই ব্যর্থতার জন্য দায়িত্বপ্রার্থী মন্ত্রী খালাফ হাসানের (মালিক উত্‌-তুজ্জার) অপদার্থতাকে দায়ী করে। ইনি ছিলেন ‘পরদেশি’ গোষ্ঠীর লোক। সুলতান দক্ষিণীদের কথা বিশ্বাস করেন এবং এদের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। দক্ষিণী অভিজাত মিঞা মইন্‌উল্লাহ নিজাম-উল-মুলক উপাধিসহ মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতায় ফিরে এসেই দক্ষিণীরা প্রতিপক্ষকে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণীদের হাতে বহু পরদেশি নিহত হন। অতঃপর কোঙ্কনের বিরুদ্ধে এক সংঘর্ষে বাহমনী বাহিনীর ব্যর্থতার জন্য দক্ষিণীরা খালাফ হাসান ও পরদেশি মুসলমানদের বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করে সুলতানের (দ্বিতীয় আলাউদ্দিন) কান ভারী করেন। ক্রুদ্ধ সুলতান কোনোরূপ অনুসন্ধান ছাড়াই, পরাজিত পরদেশিদের একাংশকে হত্যার নির্দেশ দেন। অবশ্য পরমুহূর্তেই সুলতান দক্ষিণীদের মিথ্যাচার বুঝতে পেরে তাদেরও শাস্তি দেন এবং ক্ষমতাচ্যুত করেন।

এইভাবে অভিজাতদের পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ বাড়তেই থাকে এবং সমঝোতার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। এখন একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। এই মানসিকতায় দুঃখজনক পরিণতিস্বরূপ সুলতান তৃতীয় মহম্মদ শাহ (লস্করী) বাহমনী রাজ্যের সম্ভবত সর্বাধিক শুভানুধ্যায়ী ও দক্ষতম সংগঠক মামুদ গাওয়ান-এর প্রাণদণ্ড দেন। পি. এম. যোশী এই প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “The false accusation and violent death of this upright minister constitute one of the tragedies of medieval India.”

মামুদ গাওয়ান-এর হত্যাকাণ্ড বাহমনী রাজ্যের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী করে দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির মত্ততা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জাতীয়তাবোধবর্জিত, ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের মধ্যে সংঘাত নগ্নরূপ ধারণ করে। এমতাবস্থায় রাজ্যের সংহতি ও সমন্বয়সাধনের জন্যে প্রয়োজন ছিল মামুদ গাওয়ান-এর মতো আর একজন প্রশাসকের। কিন্তু তেমন কেউ আর বাহমনী রাজ্যে ছিলেন না। তাই বাহমনী সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। অধ্যাপক শেরওয়ানী লিখেছেন: “Another Mahmud Gawan might have slammed the door to egotism, intrigue and disorder, but as no such statesman was forthcoming, the kingdom fell at the first rush of the wind like a house of cards.”

সত্যই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল হাসান গঙ্গুর স্বপ্নরাজ্য। মামুদ গাওয়ানের প্রাণদণ্ডের এক বছরের মধ্যেই শোকদগ্ধ তৃতীয় মহম্মদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর নাবালক পুত্র মামুদ শাহ সিংহাসনে বসলে অভিজাতদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে। অযোগ্য মামুদ শাহর পক্ষে তার মোকাবিলা ছিল অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত সুলতান রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা কাশিম বারিদ নামক জনৈক তুর্কি অভিজাতদের হাতে তুলে দেন। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নররা কাশিম বারিদ-এর কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করেন, এবং একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মালিক আমদ নিজাম-উল মুল্ক সর্বপ্রথম আহম্মদনগরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন (১৪৯০ খ্রিঃ)। তাঁর পথে অগ্রসর হয়ে আদিল খাঁ বিজাপুরে এবং ইমাদ-উল্‌-মুল্ক বেরারে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অবশ্য এই মুহূর্তে এরা কেউই ‘সুলতান’ উপাধি গ্রহণ করেননি। ভঙ্গুর অবস্থায় নামসর্বস্ব বাহমনী রাজ্য আরও কিছুকাল টিকেছিল। বাহমনী রাজ্যের শেষ শাসক কলিমউল্লাহ ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মারা যান। ইতিমধ্যে আরও দুটি অঞ্চলে রাজ্য গড়ে ওঠে— গোলকুণ্ডায় কুতুবশাহি বংশ ও বিদারে বারিদশাহি বংশের শাসন শুরু হয়। এদের মধ্যে তিনটি রাজ্য—গোলকুণ্ডা, আহম্মদনগর ও বিজাপুর দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে বেশ প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এই রাজ্য-পঞ্চকের রাজনৈতিক ইতিহাস পারস্পরিক বিরোধ ও সংঘর্ষের এক ক্লান্তিকর ঘটনামাত্র। শেষ পর্যন্ত এগুলি মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে দাক্ষিণাত্যে স্বাধীন সুলতানির অবসান ঘটে।