সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবী থেকে পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির আধিপত্য লুপ্ত হওয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল।
[1] রাজনৈতিক দিগন্তের প্রসার: এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করলে বিশ্ব রাজনীতির দিগন্ত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি আরও প্রসারিত হয়। সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
[2] তৃতীয় বিশ্বের উত্থান: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু উপনিবেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এসব দেশ তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দেশগুলি পৃথিবী থেকে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য দূর করতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য দূর করতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাহায্য নেয়।
[3] জাতিপুঞ্জের প্রসার: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত সদ্য স্বাধীন এসব দেশ জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জাতিপুঞ্জের ১৭৯টি সদস্যের মধ্যে ১০০টি সদস্য রাষ্ট্রই ছিল ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্র। সদস্য সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধির ফলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গুরুত্ব, পরিধি ও কার্যাবলির যথেষ্ট প্রসার ঘটে।
[4] জাতিভিত্তিক নতুন বিশ্ব: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে পুরােনাে ইউরােপীয় সাম্রাজ্যগুলির অধীনতা ছিন্ন করে জাতিভিত্তিক ক্ষুদ্র বৃহৎ অসংখ্য রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। স্বাধীনতা লাভের পর এসব জাতি নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়ােগ করার সুযােগ পায়।
[5] সাম্রাজ্যবাদের গতিরােধ: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। সদ্য স্বাধীন এসব রাষ্ট্র ইতিপূর্বে দীর্ঘকাল ধরে সাম্রাজ্যবাদের শােষণ ও আধিপত্যের যন্ত্রণা ভােগ করেছে। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত এসব দেশ স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরােধী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা লাভের পর এসব দেশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতির বিজয়রথ অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
[6] ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রসার: ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির কবল থেকে মুক্ত হলেও সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব পড়ে। এসব রাষ্ট্রে সােভিয়েত রাশিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে সমাজতন্ত্রের প্রসারে এবং আমেরিকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন পুঁজিবাদের প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।
[7] বৃহৎ শক্তিদ্বায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, প্রভৃতি দেশের আধিপত্যের অবসান ঘটে। এর ফলে সদ্য-স্বাধীন এসব দেশে যে শক্তি শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করতে বিশ্বের দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত রাশিয়া এগিয়ে আসে। ফলে এই বৃহৎ শক্তি দুটির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পায়।
[8] নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: সদ্য-স্বাধীন বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত শুরু হয় এবং মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ক্ষমতার নতুন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, ভারত-চিন যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রভৃতি এসব নতুন আঞ্চলিক সংঘাতের উদাহরণ।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর তৃতীয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
Leave a comment