নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র সুব্রত। গল্পে বর্ণিত মধ্যবিত্ত পরিবারটির আধুনিক প্রজন্মের শিক্ষিত পুরুষ সুব্রত। আপাতভাবে তার মধ্যে আধুনিকতার কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেলেও কার্যত সে তার পিতৃপুরুষের সামন্ততন্ত্রের ধারার কাছেই আত্মসমর্পণ করে। ‘অবতরণিকা’ গল্পের যে মূল প্রতিপাদ্য, অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে আপাত আধুনিকতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পুরোনো সংস্কার, অন্তঃসারহীন বংশমর্যাদাবোধ, সুবিধাবাদ, দোলাচল, মানসিক সংকীর্ণতা, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা এবং নারীর প্রতি সেই সামন্ততান্ত্রিক কর্তৃত্ববিস্তারের প্রবণতা, এ সবই যেন শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীভূত হয়েছে সুব্রত চরিত্রে।
পূর্ববঙ্গের জমিদারি সেরেস্তার কর্তৃত্বময় কর্মী প্রাচীনপন্থী প্রিয়গোপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র সে। পিতা মাতা দেশের বাড়িতে থাকলেও সুব্রতর শিক্ষা ও কর্মজীবন কলকাতায়। কিন্তু সেজন্য সে পরিবারের থেকে আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন বা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েনি। প্রিয়গোপালের চাকরি গেলে এবং পাকিস্তানে হাঙ্গামা শুরু হলে প্রিয়গোপাল আত্মীয় স্বজনদের কলকাতায় পাঠালে সুব্রতই তাদের আশ্রয় দেয়। এমনকি দুজায়গায় খরচ সামলানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লে সে বাবা-মাকেও তার কাছে চলে আসতে বলে। পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে এখানে তার কর্তব্যবোধের প্রশংসা করতে হয়।
পিতা মাতার প্রতি তার শ্রদ্ধা ও আনুগত্যও প্রশংসনীয়। কিন্তু বিবাহের পর তার নববিবাহিত স্ত্রী আরতিকে যখন প্রিয়গোপাল ও সরোজিনী আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে দিলেন না, তখন আধুনিক প্রজন্মের মানুষ হিসাবে সুব্রতর প্রতিবাদহীনতা কিছুটা ব্যক্তিত্বহীনতারই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য এ নিয়ে আরতিও কোনো দাবি না করায় সুব্রতর দাম্পত্য জীবন মোটামুটি নিরুপদ্রবই থাকে। তবে এত বড়ো সংসারের খরচ তার একার পক্ষে চালানো আসম্ভব হলে সে যখন আরতিকে পরোক্ষে উপার্জনের জন্য প্ররোচিত করে, তখন তার মধ্যে একটি আধুনিক যুক্তিবোধের প্রকাশ দেখতে পাই। আরতি চাকরির ব্যাপারে অনাগ্রহী হলে সুব্রত বলে-“পুরুষ হোক, মেয়ে হোক আজকাল বসে খাওয়ার কি জো আছে কারো?” এখানে যুগগত অবস্থার সঙ্গে মানসিকতার পরিবর্তনের সাক্ষ্য মেলে সুব্রতর চরিত্রে। একজন যোগ্য স্বামী বা জীবনসঙ্গী হিসাবে সে যখন তার স্ত্রীর মধ্যে আস্থা ও আত্মনির্ভরতা জাগিয়ে তুলতে পারে, তখন তার ব্যক্তিত্বের সবলতাটিকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। সে নিজে বিজ্ঞাপন দেখে আরতির চাকরির দরখাস্ত লিখে দেয়, নিজে হাতে করে সেইসব দরখাস্ত অফিসে জমা দিয়ে আসে, ইন্টারভিউয়ের সময়ও আরতিকে সাহস দেবার জন্য সঙ্গ দেয়। আরতি মুখার্জী অ্যান্ড মুখার্জী ফার্মে চাকরি পেয়ে গেলে প্রিয়গোপালের আপত্তির মোকাবিলা করে যুক্তির পথে এবং আরতির কর্মজীবনের প্রথমদিকে দুজনে একই সঙ্গে বাসে অফিস বেরোয়। এই আপাততুচ্ছ ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনের বোঝাপড়া ও পারস্পরিক সহযোগিতার ছবিটিই স্পষ্ট হয়।
কিন্তু সুব্রত চরিত্রের স্ববিরোধিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতাটি স্পষ্ট হতে থাকে কর্মজীবনে আরতি স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যস্ত হয়ে পড়লে। কাজের শর্ত অনুযায়ী সেলগার্লের কাজে বাইরে যেতে হওয়ায় মাঝে মাঝেই আরতির ফিরতে একটু রাত হতে থাকে। এতে আরতির শ্বশুর-শাশুড়ি বিরক্ত হতে শুরু করে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব ও প্রাচীনা কর্ত্রীর সাংসারিক চাপ বহনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে। কিন্তু সুব্রতর প্রতিক্রিয়াটি জটিলতর। তার সমস্যা স্বামী হিসাবে স্ত্রীর উপর কর্তৃত্বের অধিকার হারানোর আশঙ্কা থেকে জাত ঈর্ষা।
কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধ ছাড়া আরতি চরিত্রে পরিবারের পক্ষে গ্লানিকর কোনো আচরণ আমরা খুঁজে পাই না। সংসারের আর্থিক চাপ ও বাড়তি ইচ্ছাপূরণের জন্যই আরতি পরিশ্রম করে। পরিবারের প্রতি সাধারণ দায়িত্বপালন ও গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ব্যাপারেও তাকে যথেষ্ট সচেতন দেখতে পাই। কিন্তু সুব্রত ক্রমশ ‘সহজলভ্যা স্ত্রীর পরস্ত্রীর সুদূর দুর্ভেদ্য রহস্যময়তা অনুভব করে পীড়িত হয়। এখানেই শুরু হয় তার স্ত্রীর প্রতি কর্তৃত্বের অধিকার হারানোর যন্ত্রণা। তবে এই ক্ষণিক মানসিক দুর্বলতা সম্পর্কে এ পর্যন্ত যথেষ্ট সচেতন থাকে সুব্রত। “কেবল ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার জন্য মন খারাপ করবার ছেলে সুব্রত নয়। বউ যদি চাকরি করে, আর সে চাকরিতে যদি সময় আর সামর্থ্য দুইই বেশি দিতে হয়, দাম্পত্য জীবনের চেহারা তো একটু আধটু বদলাবেই। তাতে আপত্তি নেই সুব্রতর।”—এ হল সুব্রতর সচেতন শিক্ষিত রুচিশীল মনের যুক্তিসহ চিন্তা। কিন্তু সচেতন মনের আড়ালে গোপন কন্দরে লুকিয়ে থাকে যে স্বার্থপর মন, সেই মন হয়তো সুব্রতর অগোচরেই মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করে। সেই স্বার্থপরতা ও অধিকারগত ঈর্ষার কারণেই তখন সে তার সামন্ততান্ত্রিক প্রাচীনপন্থী বাবার মতো আরতিকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসারে মনোনিবেশ করতে বলে। আরতি আপত্তি জানালে সে অসংগত আচরণ করে। তার মন অদ্ভুতভাবে সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়ে আরতির প্রতি। তাই আরতি ব্যাগ থেকে বাড়তি টাকা বের করলে তার মনে প্রশ্ন জাগে। এক মাড়োয়ারি ক্লেতার গাড়িতে আরতি চেপেছিল শুনে মৃদু আপত্তি তোলে। পড়শির মুখে অপরিচিত লোকের সঙ্গে আরতিকে চা খেতে দেখা গেছে শুনে বিচলিত হয়। আর আরতির সাক্ষ্য শুনেও সুব্রতর মনে হয় আরতির যেন দিনের পর দিন টাকার পিছনে ছোটার একটা নেশা তৈরি হচ্ছে।
আত্মনির্ভরতার যে মন্ত্র একদিন সুব্রতই দিয়েছিল আরতিকে, এবার সেই আরতির কাছেই যেন পরাজিত হতে হয় তাকে। এখানেই সুব্রতর দোলাচল এবং স্ববিরোধিতা। এবার সে সংসারের টাকার দরকারের থেকে শাস্তির প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আরতি তার সিদ্ধান্তে অটল। ফলে পরাজিত কর্তৃত্বহীন সুব্রত ক্রমশ হিংস্র হয়ে ওঠে। দাম্পত্য জীবনকে অস্বীকার করে সে অন্যায়ভাবে আরতিকে পৃথক থাকার প্রস্তাব দেয়, ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে আরতির বাবার কাছে অভিযোগ করে। এ সব আচরণ সুব্রতর রুচি ও শিক্ষার অধঃপতনকেই সূচিত করে। এ তার মনের গভীর স্বার্থপর ঈর্ষা ও সন্দেহপ্রবণতার কাছে তার শিক্ষিত আধুনিক মনস্কতার পরাজয়।
কিন্তু গল্পের সমাপ্তি অংশে সুব্রতর চারিত্রিক দোলাচল ও স্ববিরোধের আরও এক দৃষ্টান্ত রেখে যান গল্পকার। সুব্রতর চাকরি যায়। তখন আরতির উপার্জনটিই ভরসাস্থল হয়ে ওঠে গোটা সংসারের। সুব্রতর মনোভাব বদলে যায়। ঠিক এই সময় আত্মসম্মানের প্রশ্নে আরতি চাকরি ছেড়ে দিলে আশ্চর্যজনকভাবে বিস্মিত হয় সুব্রত। কেননা আরতির চাকরি ছেড়ে দেওয়াটাই তার কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু এখন সংসারের আর্থিক ভরকেন্দ্রের বদল ঘটে যাওয়ায় আরতির চাকরি রাখাটাই সুব্রতর স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বোঝা যায়, কোনো নৈতিক বা যুক্তির উপর সুব্রত চরিত্রের মন বা মত প্রতিষ্ঠিত নয়, তার সমস্ত চিত্তাই স্বাৰ্থচালিত।
লক্ষণীয়, সুব্রত বা তার বাবা যে বংশমর্যাদা বা সম্মানবোধের কথা বলত, তার অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে যায়, যখন নারীর প্রতি মালিকের অন্যায় অমর্যাদাকর আচরণের বিরুদ্ধে আরতির প্রতিবাদ সুব্রতর কাছে মূল্য পায় না। সে তখন নিজের পূর্ব অবস্থান বিস্মৃত হয়ে আরতিকে মালিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পরামর্শ দেয়। এডিথের মতো কোনো মেয়ের অমর্যাদাকে স্বার্থপরের মতো উপেক্ষা করে নিজের চাকরি বাঁচাতে উৎসাহিত করে। আরতি নিজের স্বামীর এই নীচ স্বার্থপরতা ও মূল্যবোধের হীনতা দেখে বেদনার্ত হয়। তবে গল্পটি আমাদের কাছে উন্মোচিত করে দিয়ে যায় সুব্রত চরিত্রটির অন্তর্গত স্বার্থপরতা, স্ববিরোধ, সংকীর্ণতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা।
Leave a comment