যে অনুবর্তন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কোন উদ্দীপক থাকে না, যে কোনো উদ্দীপকের সাথে প্রাণের আচরণকে যুক্ত করা যায় তাকে অপারেন্ট অনুবর্তন বলে। এটি আবার সক্রিয় অনুবর্তন নামে পরিচিত। এই অনুবর্তনের উদাহরণ হল – চোখে উজ্জ্বল আলো পড়লে স্বাভাবিকভাবে চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

অপারেন্ট অনুবর্তন

বিখ্যাত আমেরিকান মনােবিদ বি এফ স্কিনার অপারেন্ট অনুবর্তনের স্রষ্টা। তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে একটি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে অপারেন্ট অনুবর্তনের ধারণা দেন।

 

Operant কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘ফললাৎপাদনের জন্য প্রতিক্রিয়া। কিনারের মতে, প্রতিক্রিয়া করার ক্ষেত্রে সবসময় উদ্দীপকের প্রয়ােজন নেই। তাই কিছু প্রাণীর কিছু কিছু আচরণের সঙ্গে নির্দিষ্ট উদ্দীপক যুক্ত থাকে, স্কিনার যার নাম দিয়েছেন Respondent (রেসপনডেন্ট)। আর যে আচরণের সঙ্গে কোনাে নির্দিষ্ট উদ্দীপক যুক্ত থাকে না তার নাম Operant (অপারেন্ট)। এক্ষেত্রে পরিবেশ শক্তিদায়ক সত্র (Reinforcement) রঙ্গে কাজ করে।

 

সুতরাং যে অনুবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনাে উদ্দীপক ছাড়া প্রতিক্রিয়া সম্ভব এবং প্রাণীর সক্রিয়তা যেখানে আবশ্যক, তাকে বলে সক্রিয় বা অপারেন্ট অনুবর্তন। যেমন— চাহিদা, আগ্রহ, তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি, বেদনাদায়ক অনুভূতি প্রভৃতি প্রাণীর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ সৃষ্টি করে। এই আচরণই হল সক্রিয় বা অপারেন্ট অনুবর্তন।

 

সক্রিয় অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য

স্কিনার তার সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বে ফলপ্রাপ্তি, পুরস্কার, শাস্তিদায়ক উদ্দীপকের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সক্রিয় অনুবর্তনে প্রাণী তার আকাঙ্ক্ষিত ফললাভের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। প্যাভলভের পরীক্ষায় আচরণের জন্য নির্দিষ্ট উদ্দীপক যুক্ত থাকত, যাকে স্কিনার Respondent বলেছেন। তবে যখন উদ্দীপক যুক্ত থাকে না সেই অপারেন্ট জাতীয় আচরণ নিয়ে গবেষণা করে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন স্কিনার। তিনি তার সিদ্ধান্তের সপক্ষে সক্রিয় অনুবর্তনের উপর যে পরীক্ষা করেন, তার ভিত্তিতে নিম্নে কিছু বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হল一

 

(১) প্রাণীর প্রস্তুতি:সক্রিয় অনুবর্তনের জন্য প্রাণীর প্রস্তুতি প্রয়ােজন। স্কিনার তার পরীক্ষায় প্রথম দুদিন (পর্যায়) ইদুরটিকে বাক্সের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষামূলক পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে প্রস্তুত করেন।

 

(২) প্রাণীর সক্রিয়তা: স্কিনারীয় অনুবর্তনে প্রাণী স্বাধীনভাবে প্রতিক্রিয়া করার সুযােগ পেয়ে থাকে। স্বাধীন প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রাণী বা শিক্ষার্থীর আত্মসক্রিয় থাকা একান্তভাবে প্রয়ােজন। আত্মসক্রিয়তা না থাকলে উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার যে শৃঙ্খল, তা তৈরি হবে না।

 

(৩) শক্তিদায়ক উদ্দীপক: অপারেন্ট বা সক্রিয় অনুবর্তনের জন্য শক্তিদায়ক উদ্দীপক বিশেষভাবে প্রয়ােজন। স্কিনার তিন ধরনের শক্তিদায়ক উদ্দীপকের কথা বলেছেন। যেমন— ধনাত্মক, ঋণাত্মক। ধনাত্মক শক্তিদায়ক উদ্দীপক আচরণ সম্পাদনের হারকে বাড়াতে পারে।যেমন :

  • কাউকে দৈহিক শাস্তিদান হল শাস্তিদায়ক উদ্দীপক। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ঋণাত্মক শক্তিদায়ক উদ্দীপক। ক্ষুধার্ত ইদুরের কাছে খাদ্য ধনাত্মক শক্তিদায়ক উদ্দীপক।

 
  • স্কিনারের পরীক্ষায় শক্তিদায়ক উদ্দীপক হিসেবে খাদ্যবস্তুর প্রাপ্তি ইঁদুরটিকে লিভারে চাপ দেওয়ার আচরণ সম্পাদনের হারকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

 

(৪) আচরণের শক্তি হ্রাস বা বিলোপ সাধন: ধনাত্মক উদ্দীপকের পরিবর্তে যদি ঋণাত্মক উদ্দীপক উপস্থাপিত হয়, তাহলে আচরণ সম্পাদনের শক্তি হ্রাস পাবে। লিভারে চাপ দেওয়ার পর যদি খাদ্যবস্তুর প্রাপ্তি না ঘটত, তাহলে ইদুরটি পরবর্তী ক্ষেত্রে আচরণ সম্পাদন বন্ধ করে দিত।

 

(৫) আচরণের স্বতঃস্ফুর্ততা: অনুবর্তনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল প্রাণীর আচরণের স্বতঃস্ফুর্ততা। প্রাণীর এই স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ উদ্দীপকের সাহায্যে জোর করে সৃষ্টি করা হয় না। প্রাণী নিজের চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে আচরণ করে থাকে।

 

(৬) স্বতঃস্ফূর্ত পুনরাবির্ভাব: সক্রিয় অনুবর্তনের আচরণ সম্পাদনের শক্তি অবলুপ্ত হলে প্রাণীটির উপর কিছুদিন আচরণ সম্পাদন বন্ধ রাখলে পুনরায় প্রাণীটির মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ওই আচরণের পুনরাবির্ভাব ঘটবে।

 

(৭) আকৃতিদান: যে পরিস্থিতিতে প্রাণী কাঙ্ক্ষিত আচরণগুলি সম্পাদনের জন্য পর্যায়ক্রমে আচরণের শৃঙ্খল তৈরি করে, সেই মূহুর্তে প্রাণীর মধ্যে সমস্ত আচরণের একটি আকৃতিদান ঘটে থাকে। আকৃতিদান সম্পর্কে স্কিনার তিনটি নীতির কথা বলেছেন। সেগুলি যথাক্রমে 一

  • সামান্যীকরণ : এক্ষেত্রে প্রাণী অর্জিত শিখনকে পরবর্তী কোনাে শিখনে প্রয়ােগ করে। এই পদ্ধতিকে সামান্যীকরণ বলে যা দুটি পদ্ধতিতে হয়一 (a) উদ্দীপকের সামান্যীকরণ: কোনাে নির্দিষ্ট উদ্দীপকে প্রাণী যেরূপ আচরণ করে সেইরকম অন্য কোনাে উদ্দীপকের একই রূপ প্রতিক্রিয়া করে। (b) প্রতিক্রিয়া সামান্যীকরণ: কোনাে অভিজ্ঞতায় প্রাণী যেমন প্রতিক্রিয়া করেছে পরবর্তী অন্য কোনাে অভিজ্ঞতায় সেই প্রতিক্রিয়াকে কাজে লাগায়।

  • খন্ডাংশের ধারাবাহিক শঙ্খল গঠন: কোনাে আচরণকে খণ্ডাংশের মাধ্যমে শেখাতে গেলে প্রতিটি আচরণকে পরবর্তী আচরণের সঙ্গে শৃঙ্খলিত হতে হবে।

 
  • প্রতিযােগী স্বভাব: অনেকগুলি আচরণের মধ্যে প্রাণী সঠিক আচরণটি জানতে পারলে অন্য আচরণগুলির প্রতিযােগিতা শুরু হয়।

 

(৮) স্থায়ী প্রক্রিয়া: সক্রিয় অনুবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রাণী সক্রিয় থাকে এবং | স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ সম্পাদন করে। তাই সক্রিয় অনুবর্তনের দ্বারা প্রাণীর যে শিখন, তা স্থায়ী হয়।

 

(৯) স্থায়িত্ব: শক্তিদায়ী উদ্দীপকের উপস্থিতি অপারেন্ট অনুবর্তনের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে বিষয়ে স্কিনার তিন ধরনের শক্তিদায়ী উদ্দীপক বা সিডিউল (Schedule)-এর কথা বলেছেন। যথা—

  • নিরবচ্ছিন্ন সিডিউল: প্রত্যেকবার প্রতিক্রিয়ার জন্য শক্তিশালী উদ্দীপক দেওয়া হয়। এই সিডিউল দু-ভাগে বিভক্ত—(a) ক্রমাগত: শক্তিদায়ক সত্তা দিলে সঠিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিখন দ্রুত হয়। (b) বিলুপ্ত: শক্তিদায়ক সত্তার অনুপস্থিতিতে উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া সংযােগ বিচ্ছিন্ন হয়।

  • বিরতিপূর্ণ বা সময়-অন্তরভিত্তিক: মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে উদ্দীপক ব্যবহার করলে তাকে বলা হয় সময়-অন্তর বা বিরতিপূর্ণ সিডিউল। এই সিডিউল ৪ প্রকার। যথা—(a) স্থির অনুপাত সিডিউল, (b) পরিবর্তনীয় অনুপাত সিডিউল, (c) নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানভিত্তিক সিডিউল ও (d) পরিবর্তনীয় সময় ব্যবধানভিত্তিক সিডিউল।

  • পার্থক্যজনিত: কোনাে প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করতে পারা বা না পারা পার্থক্যজনিত সিডিউল-এর মধ্যে পড়ে। এই সিডিউল দু-প্রকার। যথা—(a) নিম্ন হার ও (b) উচ্চ হার।

 

(১০) সক্রিয়তার শৃঙ্খল: সক্রিয় অনুবর্তন প্রক্রিয়ায় পূর্বের সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া পরবর্তী পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়াকে সক্রিয়তার শঙ্খল বলা হয়।

 

আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে সক্রিয় অনুবর্তন প্রক্রিয়া প্রয়ােগ করে শিক্ষার্থীদের খারাপ আচরণের সংশােধন ঘটিয়ে ভালাে ও গ্রহণযােগ্য আচরণ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।