অপরাধ 

[Offence]


অপরাধ (Offence) বলতে সাধারণত এমন কার্যকে(acts) বােঝায় যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর, আইন দ্বারা নিষিদ্ধ এবং যে কাজ করলে বা বিরত থাকলে(omission) একটি দেশের দন্ড সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী অনুযায়ী শাস্তিযােগ্য অপরাধ। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪০ ধারায় বলা হয়েছে যে, অপরাধ বলতে  দন্ডবিধির ২ ও ৩ ধারায় উল্লিখিত অধ্যায় এবং ধারাগুলোর ব্যতীত এমন কার্যকে বােঝাবে যা দণ্ড বিধি অনুযায়ী শাস্তিযােগ্য বা দণ্ডযােগ্য।[Except in the chapters and sections mentioned in clauses 2 and 3 of this section, the word “offence” denotes a thing made punishable by this Code.]

The General Clauses Act, 1897 এর ৩(৩৭) ধারার সংজ্ঞানুসারে অপরাধ বলতে সেই কর্ম বা কর্ম বিরতিকে বুঝায় যা করলে বর্তমান বলবৎ কোন আইনে শাস্তির যোগ্য করা হয়েছে।[“offence” shall mean any act or omission made punishable by any law for the time being in force.] 


অপরাধের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য

[Elements or characteristics of Offences]

যেকোনো ধরনের অপরাধের ০২ ধরনের উপাদান থাকে। যেমন- 

(১) বস্তুগত উপাদান-দোষী কাজ (guilty act বা actus reus); এবং

(২) মানসিক উপাদান- Mens Rea (দুষ্টমন) (guilty mind)।


প্রতিটি অপরাধে actus reus এবং mens rea থাকতে বাধ্য এবং উভয়কেই প্রমাণ না করা পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। Mens Rea (দুষ্টমন) বলতে কোন অপরাধ সংঘটনের সময় অপরাধকারীর বা দোষী ব্যক্তির উদ্দেশ্য (Intention),দূরবর্তী উদ্দেশ্য (Motive),জ্ঞান (Knowledge) ইত্যাদি নিয়ে কাজ করাকে বুঝায়.


 যাহোক আমরা যদি অপরাধের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরি তাহলে দেখব যে-

১. অপরাধ একটি অন্যায় ও বেআইনি   এমন কাজ কিংবা আইনগতভাবে করতে বাধ্য এমন কাজ থেকে বিরত থাকা।

২. ওই কাজটি করা বা না করা আইনের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ  হবে।

৩.  ওই কাজটি করলে বা না করলে  ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র মোটকথা সবার জন্যই ক্ষতিকর হবে।

৪. এমন কাজ যা করা বা না করার জন্য দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে শাস্তির বিধান থাকবে।]\

৫. ওই অপরাধমূলক কাজ করার সময় অপরাধী মন [মেন্স রিয়া অথবা গিলটি মাইন্ড] থাকবে।

৬. আবার কাজটি করা বা না করা সমাজের নৈতিক  দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী হবে। 


সাধারণত মানুষ জেনেশুনে, ইচ্ছাকৃতভাবে, প্রতারণামূলকভাবে এবং অবহেলিতজনিত কাজের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন করে থাকে। উল্লেখ্য  ফৌজদারি কার্যবিধিতে অপরাধকে আমলযোগ্য অপরাধ(Cognizable offence) আমলের অযোগ্য অপরাধ- এই দুই ভাগে অপরাধের বিভক্তি দেখানো হয়েছে।

অভিপ্রায়(Intention) এবং Motive :

দন্ডবিধি অনুসারে অভিপ্রায়ের (Intention) অর্থ অপরাধ করার ইচ্ছা কিংবা সহজ কথায় তাৎক্ষণিকভাবে যা প্রত্যাশা করা হয় (desired directly and immediately) দন্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুসারে একই অভিপ্রায় পূরণ কল্পে একাধিক ব্যক্তি যখন কোন অপরাধমূলক কার্য করে তখন  তাদের  প্রত্যেককেইসেই অপরাধের জন্য দায়ী হবেন।

৩২ ডিএলআর ২৮২  তে বলা হয়েছে, অভিপ্রায় হল পূর্ব পরিকল্পনার ফল। এই পূর্ব পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ বা অবস্থানগত সাক্ষ্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

দন্ডবিধি ৮১ ধারা অনুসারে ক্ষতি সাধন করতে পারে এইরূপ সম্ভাবনা রয়েছে জেনে কোন কিছু করা অপরাধ নয়। যদি তা ক্ষতি সাধনের অভিপ্রায় ব্যতিরেকে এবং মানুষ বা সম্পত্তির প্রতি অন্য কোন ক্ষতি এড়ানাের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। 

সুতরাং অভিপ্রায় তখনই অপরাধমূলক হয় যখন অসৎ উদ্দেশ্যে উক্ত অভিপ্রায় পরিচালিত হয়ে থাকে। পরিচালিত হয়। ফৌজদারি মামলায় অভিপ্রায় একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত অপরাধকারীর অপরাধ করার অভিপ্রায় না থাকলে তা শাস্তিযােগ্য হবে না।


অন্যদিকে, Motive হল অভিপ্রায়(Intention) এর পরবতী অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ, কোন ব্যক্তি যদি কিছু টাকা চুরি করে তবে এখানে চুরির Intention হলাে টাকার আইনগত অধিকারীকে উক্ত টাকা থেকে বঞ্চিত করা অথবা টাকা নিয়ে নেওয়া। অন্যদিকে, যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কেন লােকটি চুরি করল তাহলে চোর হয়ত জবাব দিবে যে, সে খাবার কেনার জন্য টাকাটা চুরি করেছিল। সুতরাং এখানে দূরবর্তী উদ্দেশ্য বা motive হলাে খাবার কেনা। সুতরাং, যে কোন অপরাধকর্ম দুটি আলাদা প্রশ্নের জন্ম দেয়- 

  • প্রথমত, অপরাধটি উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল কিনা? এবং
  • দ্বিতীয়ত যদি উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছিল তাহলে সে উদ্দেশ্যের পেছনে দূরবর্তী উদ্দেশ্য বা motive কি ছিল?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলাে অপরাধের মানসিক উপাদান (mens trea) এবং এক্ষেত্রে আপরাধ প্রমাণের জন্য আবশ্যক। অন্যদিকে, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর তথা Motive অপরাধ প্রমাণ তথা শাস্তি প্রদানের জন্য আবশ্যক নয়। অর্থাৎ অপরাধের Motive যাই থাকুক না কেন উদ্দেশ্য প্রমাণ করা গেলে অপরাধটির জন্য শাস্তি দেয়া যাবে।


অপরাধ প্রমাণের জন্য সরকারকে (prosecution) অপরাধের শুধুমাত্র উদ্দেশ্য (intention) প্রমাণ করতে হয়; Motive বা দূরবর্তী উদ্দেশ্য প্রমাণের আবশ্যকতা নেই।

দূরবর্তী উদ্দেশ্যের প্রাসঙ্গিকতা (When motive is relevant)

উপরের আলােচনায় প্রতীয়মান যে Motive অপরাধ প্রমাণে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে দণ্ড। বিধির নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহে Motive প্রাসঙ্গিক হবে এবং প্রমাণ করতে হবেঃ

(১) অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা (Attempt to commit an offence)

দণ্ড বিধির ৫১১ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি দণ্ডবিধিতে কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোন অপরাধ সংঘটন করার চেষ্টা করে এবং অনুরূপ চেষ্টার মাধ্যমে অপরাধটি সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোন কার্য করে তবে  সেই অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা নামক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

সুতরাং, প্রত্যেক অপরাধ সংঘটনের চেষ্টার (attempt) ক্ষেত্রে অভিপ্রায় বা intention হলাে মূল অপরাধটি করা; কিন্তু এটা হলাে attempt এর motive। উদাহরণস্বরূপ, কোন এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির কুড়েঘরে আগুন লাগানাের উদ্দেশ্যে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরালাে এবং জ্বলন্ত কাঠিটি দিয়ে কুড়েঘরের চালায় আগুন লাগানাের মুহূর্তে যদি তাকে ধরে ফেলা হয় তবে এখানে অপরাধী অপরাধের চেষ্টা তথা attempt করেছে কিনা তা প্রমাণ করতে হলে তার motive জানা দরকার। কারণ কুড়েঘরে আগুন লাগানাের  দূরবর্তী উদ্দেশ্য (motive) না নিয়ে যদি সে এমনিই উদ্দেশ্যমূলকভাবে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বালায় তাহলে  তা কোন অপরাধ হবে না। কিন্তু যদি প্রমাণ করা যায় যে, ঘরে আগুন লাগানাের উদ্দেশ্যেই সে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়েছিল তবে তাকে অপরাধজনক চেষ্টায় (attempt to criminal mischief) অভিযুক্ত করা যাবে। সুতরাং, এখানে motive প্রমাণ ব্যতীত attempt প্রমাণ করা অসম্ভব।


(২) যেখানে Motive একটি অপরাধের সংজ্ঞাভুক্ত উপাদান সেখানে motive প্রাসঙ্গিক এবং প্রমাণ করা অত্যাবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ, ৪৪২ ধারায় অনধিকার গৃহ প্রবেশ(house trespass) এর ক্ষেত্রে Criminal respass এর motive নিয়ে কোন বাড়ী, দালান বা ঘরে ঢুকতে হবে। এ প্রসঙ্গে পিএলডি ১৯৫৮ ঢাকা ৩৫০তে বলা হয়েছে যে, দন্ডবিধির  ৪৪২ ধারার অধীনে শাস্তি দিতে হলে দন্ডবিধির ৪৪১ ধারায় বর্ণিত অভিপ্রায়ের যেকোনো একটির প্রকাশ্য উপস্থিত থাকতে হবে।


তেমনিভাবে, দন্ডবিধির ৪৬৩ ধারায় জালিয়াতির (Forgery) সংজ্ঞায়ও motive হিসেবে কারাের সম্পত্তির ক্ষতি বা জনসাধারণের ক্ষতি করতে হবে। জালিয়াতির দু’টা উপাদান রয়েছে; (১) জাল দলিল বা কাগজপত্র তৈরী করা; এবং (২) উক্ত জাল দলিলের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা জনসম্পদের ক্ষতিসাধন করার Motive থাকতে হবে। জাল দলিল বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বা বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে বা হতে পারে কিন্তু যখন উহার motive হিসেবে কারাের সম্পদ বিনষ্ট বা জনসম্পদের ক্ষতি প্রমাণ করা যাবে তখনই তা জালিয়াতি প্রমাণিত হবে। এ প্রসঙ্গে ২২ডিএলআর (ডব্লিউপি) ১৭৮ (ডিবি) তে  মতামত প্রদান করা হয়েছে যে, প্রতারণা করার কোন উপাদান না থাকলে শুধুমাত্র মিথ্যা দলিল বানাইতা জালিয়াতি হিসেবে গণ্য হয় না। কারণ দন্ডবিধির ৪৬৩ ধারায় যে অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে তা অবশ্যই প্রতারণা  করার অভিপ্রায় সৃষ্টি করতে হবে। 

……………………………………..