প্রশ্নঃ অপরাধ এর সংজ্ঞা দাও। এ প্রসঙ্গে ‘মেনসরীয়া’ নীতি আলোচনা কর। দন্ডবিধির বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে এই নীতি কতদূর প্রযোজ্য?

Define crime and discuss the doctrine of ‘mens rea’ How far this doctrine is applicable to offenses under the penal code?

অপরাধঃ ক্রাইম বা অপরাধের কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধিতেও এটা দেয়া হয় নি সাধারণ অর্থে ক্রাইম বলতে দন্ডনীয় অপরাধ বুঝায় যা একটি আপেক্ষিক শব্দ এবং মূলত সামাজিক মূল্যবোধের উপর ইহা নির্ভরশীল। যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধ সকল সমাজে এক নয় এবং এক সমাজে ও সময়ের বিবর্তনে ইহা পরিবর্তনশীল, তাই এর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব হয় না। তাই বিভিন্ন অপরাধ বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সংজ্ঞা হতে এর বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করতে হয়। অপরাধ বিজ্ঞানী ট্যাপেন (Paul W. Tappen)-এর মতে, ফৌজদারী আইনের বিধান ইচ্ছাকৃত লংঘনকারী কোন কাজ বা নিবৃত্তি হচ্ছে অপরাধ। (Crime is an intentional act or omission in violation of criminal law)

ক্রশ জোনস ( Cross jones) বলেন যে, ক্রাইম হচ্ছে একটা আইনগত অন্যায় যার প্রতিকার হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক অন্যায়কারীকে শাস্তি প্রদান।

অপরাধবিজ্ঞানী পারমিলীর মতে, অপরাধ হচ্ছে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য কোন কাজ যা প্রচলিত নৈতিক মানদন্ড অনুযায়ী সমাজের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর এবং প্রচলিত সামাজিক অবস্থা অক্ষুন্ন রাখার জন্য শাস্তিই হচ্ছে একমাত্র প্রতিকার।

অপরাধবিজ্ঞানী অসবর্ণের (Osborn) সংজ্ঞানুসারে, অপরাধ বলতে এমন ক্ষতিকর কার্য সংঘটন বুঝায় যা শুধু মাত্র ব্যক্তি বিশেষের জন্যই ক্ষতিকর নয় বরং সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে তা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তাই রাষ্ট্রকেই অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হয়।

এ সকল সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে অপরাধের নিম্নোক্ত উপাদানগুলি লক্ষ্য করা যায়ঃ-

প্রথমতঃ একটি কার্য সংঘটন। সংঘটনের ইচ্ছাই যথেষ্ট নয় ইচ্ছার বাস্তবায়ন ও প্রয়োজন। 

দ্বিতীয়তঃ এই কার্যটি সংঘটনে সংঘটনকারীর দূষনীয় অভিপ্রায় থাকতে হবে যাকে আইনের পরিভাষায় মেনস্ রিয়া বলে। 

তৃতীয়তঃ সেই কার্যটি প্রচলিত আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হতে হবে। 

চতুর্থতঃ এর জন্য শাস্তির বিধান থাকতে হবে।

মেনসরিয়া (Mens rea): কোন অন্যায় বা নিষিদ্ধ কাজ যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘটন করে কিংবা অবহেলা ক্রমে করে থাকে তবে তাকে সে কাজের জন্য দায়ী হতে হয়। ইচ্ছাকৃত কাজের ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে, অন্যায়কারীর একটি অসৎ অভিপ্রায় বা দোষী মন ছিল।

অবহেলার ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় যে, সংঘটনকারী সাবধানতা অবলম্বনে আইনগত কর্তব্য ভঙ্গ করেছে। কাজেই মেন্‌স রিয়া হচ্ছে একটা মানসিক উপাদান যা একটি অপরাধ সংঘটনের জন্য আবশ্যকীয় বলে ব্রিটিশ কমন ল’য়ে সর্বদা বিবেচিত হয়েছে। তবে কোন বিধিবদ্ধ আইনে এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারে। কেননা এ সকল ক্ষেত্রে বলা হয় যে, কাজটি যদি বেআইনী হয় তবে তার সংঘটনের জন্য দায়ী হতে হবে। এতে সংঘটনকারীর মানসিক উপাদান যাই থাকুক না কেন তা বিবেচ্য বিষয় নয়। তবে সুষ্পষ্টভাবে এর আবশ্যকতা অস্বীকার না করা পর্যন্ত মেনস্ রিয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুমান করা হয়। ১৯৪৬ সালে লর্ড গোড্ডার্ড (62 T.L.R 482 (D.C.) যে নীতিটি’ প্রতিষ্ঠিত করেন তা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন যে, জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করবেন না যতক্ষণ না তার একটি দোষী মন থাকে। অবশ্য যদি কোন সংবিধি দ্বারা এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয় তবে তা স্বতন্ত্র বিষয় হবে।

মেনস রিয়া মতবাদটি অপরাধ বিজ্ঞানে বেশ আলোচ্য বিষয়। এই মতবাদটি যেমন সকল ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করা যায় না। তেমন এর প্রয়োজনীয়তা ও সকল ক্ষেত্রে অস্বীকার করা যায় না। যেমন কোন ব্যক্তি যদি তার বাগানে তীর ধনুক চালনা অনুশীলন করে এবং ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোন ব্যক্তি এর দ্বারা আহত হয় তাহলে কি তীর ধনুক চালনাকারী দায়ী হবে, ‘মেনস্‌ রিয়া’কে অস্বীকার করে শুধু কাজের জন্য দায়ী হলে সে ব্যক্তি অবশ্য দায়ী হবে। কিন্তু যেহেতু আঘাত করার মত দোষী মত এখানে অবর্তমান সেহেতু আঘাতকারী এক্ষেত্রে অব্যাহতি পেতে পারে। আবার গণ উৎপাতের ক্ষেত্রে উৎপাত সৃষ্টিকারীর অন্যের অসুবিধা বা ক্ষতি করার মত ‘মেনস্ রিয়া’ না থাকলেও শুধু কাজটির জন্য তাকে দায়ী করা হয়। স্যার ষ্টিফেন সনের মতে ‘মেনস্ রিয়া’ মতবাদটি বিভ্রান্তিকর এবং বর্তমানে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই মতবাদটির যখন উদ্ভব হয় তখন ফৌজদারী আইনে বিভিন্ন অপরাধের নাম শুধু উল্লেখ থাকতো। বর্তমানে বিভিন্ন অপরাধের স্বতন্ত্র সংজ্ঞা এবং এর উপাদান দেয়া থাকে। তাই বর্তমানে এই মতবাদটি অবান্তর মনে হয়৷

বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে ‘মেনসরিয়া’র প্রয়োগঃ বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে প্রত্যেক অপরাধের সংজ্ঞা ও এর উপাদান দেয়া হয়েছে। এছাড়া এরূপ অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। এ সকল উপাদানের মধ্যে রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে, সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়, অসদুপায়ে, বেপরোয়াভাবে, অবহেলাক্রমে, প্রতারনামূলকভাবে, ইত্যাদি। এগুলি মেনস রিয়ার বিভিন্ন রূপ। তাই বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে মেনস্‌ রিয়া মতবাদটির সাধারণভাবে প্রয়োগ না থাকলেও প্রকারান্তরে তা বিভিন্ন নামে প্রয়োগ করা হয়।