প্রশ্নঃ অপরাধমূলক নরহত্যা কখন খুনে পরিণত হয়? অপরাধমূলক নরহত্যা ও খুনের মধ্যে পার্থক্য কি? 

When does culpable homicide amount to murder? What is the difference between culpable homicide and murder?

অপরাধমূলক নরহত্যা (Culpable homicide): মানুষ কর্তৃক অপর মানুষের প্রাণহানিকে নরহত্যা বলে। নরহত্যা একটা সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যাপার যা সুস্থ ও স্থির মস্তিষ্কে অচিন্তনীয় মনে হয়। কিন্তু সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রয়োজনে কখনো কখনো মানুষ হত্যার দরকার হয়ে পড়ে। এরূপ নরহত্যাকে আইনানুগ নরহত্যা বলে। যে সকল নরহত্যাকে আইন সমর্থন করে না এবং এজন্য দণ্ডবিধিতে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। সেগুলিকে অপরাধমূলক নরহত্যা বলে। অপরাধমূলক নরহত্যার মধ্যে কতগুলি একেবারে খুনের পর্যায়ে পড়ে আর কতগুলি খুনের পর্যায়ে পড়ে না। দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারায় অপরাধমূলক নরহত্যা এবং ৩০০ ধারায় খুনের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ ধারা অনুসারে মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজ দ্বারা কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে, বা যে দৈহিক জখম মৃত্যু ঘটাতে পারে তেমন দৈহিক জখম ঘটানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজ দ্বারা মৃত্যু ঘটালে বা যে কাজের ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে তা জানা সত্ত্বেও সে কাজের দ্বারা কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানো হলে তাকে অপরাধমূলক নরহত্যা বলা হয়।

অপরাধমূলক নরহত্যা কখন খুনের পর্যায়ে পড়েঃ দণ্ডবিধির ৩০০ ধারায় বর্ণিত ব্যতিক্রম সাপেক্ষে সকল অপরাধমূলক নরহত্যাই খুন হিসেবে গণ্য হবে। যদি,

প্রথমতঃ যে কাজের ফলে মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে তা মৃত্যু ঘটানোর জন্যই করা হয়ে থাকে। যেমন— ক, খ কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার প্রতি গুলিবর্ষণ করে। খ এতে মারা যায়। এক্ষেত্রে ক খুনের অপরাধ করেছে।

দ্বিতীয়তঃ যদি কাজটি এমন দৈহিক আঘাত দেয়ার জন্য করা হয়ে থাকে যে আঘাতের ফলে মৃত্যু হতে পারে বলে আসামী জানে। যেমন—ক জানে খ এমন একটি অসুখে ভুগছে যে, একটিমাত্র আঘাতেই তার মৃত্যু হতে পারে। তা জানা সত্ত্বেও সে খ কে আহত করার উদ্দেশ্যে আঘাত করে এবং এতে খ মারা যায়। ক খুনের অপরাধে দোষী।

তৃতীয়তঃ কোন ব্যক্তিকে দৈহিক আঘাত দেয়ার উদ্দেশ্যে কাজটি করা হলে এবং অভীষ্ট আঘাতটি যদি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট হয়। যেমন, ক ইচ্ছাকৃতভাবে খ এর শরীরে একটি ধারালো অস্ত্রের কোপ দেয় যা স্বাভাবিকভাবে কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। ক খুনের অপরাধ করেছে।

চতুর্থতঃ কোন আশু বিপজ্জনক কাজ যার ফলে সম্ভবত মৃত্যু ঘটতে পারে বা এরূপ কাজের ফলে এমন দৈহিক আঘাত ঘটবে যার ফলে মৃত্যু হতে পারে। এ রকম জানা সত্ত্বেও বা মৃত্যু ঘটানোর বা এরূপ দৈহিক আঘাত দেয়ার জন্য কোন অজুহাত ছাড়া যদি কাজটি করা হয়। যেমন, ক কোন অজুহাত ছাড়া জনতার প্রতি গুলি ছুড়লো, জনতার একজন মারা গেল। ক খুনের জন্য দায়ী হবে।

কতিপয় আদালতের সিদ্ধান্তঃ মোমিন মালিথা বনাম রাষ্ট্র (41 DLR 37) মামলায় এরূপ অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, হত্যা করা অভিপ্রায়ে যদি কোন অপরাধমূলক কাজ করা হয় এবং এতে কারো মৃত্যু হয় তবে তা অবশ্যই খুন, অপরাধমূলক নরহত্যা নয়। যে দৈহিক জখমের ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে কিন্তু মৃত্যু হওয়াটা স্বাভাবিক নয় তা অপরাধমূলক নরহত্যা।

ধর্ম রুও বনাম বিহার রাজ্য (AIR 1964 Pat 334) মামলায় হাইকোর্ট বলেন যে, যেক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না যে, সংশ্লিষ্ট জখমটি হত্যা করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল অথবা এমন জখম করার উদ্দেশ্যে আঘাত করা হয়েছিল যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যু হবার জন্য যথেষ্ট কিংবা এরূপ জখমে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে তা জেনে আঘাত করা হয়েছে তবে তা অপরাধমূলক নরহত্যা।

অপরাধমুলক নরহত্যা এবং খুনের মধ্যে পার্থক্যঃ মানুষ হত্যা করা নিঃসন্দেহে একটা সাংঘাতিক এবং স্পর্শকাতর ব্যাপার। কিন্তু সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কারণে কখনো কখনো এরূপ নরহত্যার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই নরহত্যা মূলত দু’ভাবে বিভক্ত। যেমন, (ক) আইনানুগ নরহত্যা এবং (খ) দণ্ডনীয় নরহত্যা। আইনানুগ নরহত্যা আবার মাফযোগ্য এবং সমর্থনযোগ্য এই দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি পাগল বা উন্মাদ ব্যক্তি কর্তৃক নরহত্যা মাফযোগ্য এবং আদালতের রায় কার্যকরী করতে গিয়ে জল্লাদ কর্তৃক নরহত্যা সমর্থনযোগ্য। দণ্ডনীয় নরহত্যা দু’ভাগে বিভক্ত যথাঃ 

অপরাধমূলক নরহত্যা যা খুনের পর্যায়ে পড়ে না এবং অপরাধমূলক নরহত্যা যা খুনের পর্যায়ে পড়ে। এই দুটোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হচ্ছে নিম্নরূপ-

১. দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারা অনুসারে মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজ দ্বারা কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে বা যে দৈহিক জখম মৃত্যু ঘটাতে পারে তেমন দৈহিক জখম ঘটানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজ দ্বারা মৃত্যু ঘটালে বা যে কাজের ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে তা জানা সত্ত্বেও সে কাজের দ্বারা কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানো হলে তাকে অপরাধমূলক নরহত্যা হলে।

দণ্ডবিধির ৩০০ ধারা অনুসারে কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া অপরাধমূলক নরহত্যা খুন বলে গণ্য হবে যদি মৃত্যু সঙ্ঘটনকারী কাজটি নিম্নোক্তভাবে করা হয়ে থাকে-

(ক) মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যেই তা করা হয়েছে; অথবা,

(খ) অপরাধকারীর জানা আছে যে, এরূপ দৈহিক আঘাতের ফলে স্বাভাবিকভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; অথবা, 

(গ) দৈহিক আঘাতটি স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট এরূপ উদ্দেশ্য নিয়ে আঘাত করা হয়েছে; অথবা, 

(ঘ) কার্য সম্পাদনকারী জানে যে, ঐ কার্যটি এমনই আশু বিপজ্জনক যে এর ফলে খুব সম্ভব মৃত্যু ঘটবে কিংবা এর ফলে অবশ্যই এমন দৈহিক জখম করবে যার ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে।

২. উপরি উক্ত সংজ্ঞা হতে বুঝা যায় যে, অপরাধজনক নরহত্যা হচ্ছে প্রধান বা মূল অপরাধ এবং খুন হচ্ছে তারই একটি শাখা স্বরূপ। তাই বলা যায় যে, সকল খুনই অপরাধজনক নরহত্যা কিন্তু সকল অপরাধজনক নরহত্যা খুন নয়।

৩. যে কার্য দ্বারা মৃত্যু হবার সম্ভাবনা থাকে সেই কার্যের ফলে কারো মৃত্যু হলে তা অপরাধজনক নরহত্যা। যেমন লাঠির আঘাতে কারো মৃত্যু হলে তা অপরাধজনক নরহত্যা।

কিন্তু যে কার্য দ্বারা মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই বেশী থাকে সেই কার্যের ফলে মৃত্যু হলে তা খুন হিসেবে গণ্য হবে। যেমন, তরবারীর আঘাতে কারো মৃত্যু হলে তা খুনের পর্যায়ে পড়বে।

এক্ষেত্রে অপরাধীর মনোভাব বা মোটিভই বেশী গুরুত্ব পায়।

৪. অপরাধজনক নরহত্যার শাস্তি তুলনামূলক কম হয় । অপরাধের গুরুত্ব বা অপরাধীর মোটিভ, পরিস্থিতি, বয়স ইত্যাদির বিবেচনায় অপরাধীর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড সহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে ।

৫. খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে এবং এর সাথে অর্থদণ্ডও হতে পারে।

মোটামুটি এভাবে অপরাধজনক নরহত্যার এবং খুনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়।