ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে বড়াে সমস্যা হল অপচয় ও অনুন্নয়নের সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষা যে কাঙ্ক্ষিত বিস্তার লাভ করতে পারেন, তার নানা কারণের মধ্যে এই দুটি হল অন্যতম।
অপচয় (Wastage) হল, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের শেষ ধাপে পৌঁছানোর আগেই বহু ছেলে মেয়ে পিতা-মাতার দারিদ্র্য, সামাজিক কারণ বা শিক্ষার প্রতি অনীহার দরুন শিক্ষা সমাপ্ত করার পূর্বেই বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে যায়। একেই বলে অপচয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই অপচয় শুধু ব্যক্তি জীবনের সমস্যা নয়, সমগ্র জাতির জীবনের সমস্যা বলা যায়।
প্রাথমিক শিক্ষায় কোনাে একটি শ্রেণিতে পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার দরুন বহু ছাত্রছাত্রী বছরের পর বছর একই শ্রেণিতে থেকে যায় এবং পরের শ্রেণিতে উন্নীত না হওয়ায় অনেকেই পড়া ছেড়ে দেয়। যার ফলে তাদের বিকাশ ব্যাহত হয় এবং শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্র উভয়েরই অর্থ, শ্রম ও সময় নষ্ট হয়। একেই শিক্ষাক্ষেত্রে অনুন্নয়ন (Stagnation) বলে।
(১) এর একটা বড় কারণ হল দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণে অধিকাংশ পরিবারে পিতা-মাতার ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতাই থাকবে না।
(২) শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য এখনও সেভাবে সরকারি আইন প্রণয়ন করা যায়নি, যার ফলে প্রায় ৬০ লক্ষ শিশুশ্রমিক এখনও শ্রমের দ্বারা নিজের পরিবারকে সাহায্য করে।
(৩) অশিক্ষিত পিতা-মাতার শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে বোঝানো যায় না।
(৪) বিদ্যালয়গুলির পরিবেশ, গতানুগতিক পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহী করে তােলে।
তাই সবশেষে বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের এরূপ বড়াে দুটি সমস্যা দূর করতে হলে, শিশুশ্রম বন্ধ করা, অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা, বিনামূল্যে পুস্তক-পপাশাক বিতরণ, মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা, মূল্যায়ন ব্যবস্থার পরিবর্তন। সর্বোপরি বাস্তবধর্মী পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক ব্যবস্থা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে অপচয় ও অনুন্নয়ন মতো বড়ো দুটি অভিশাপকে দূর করতে হবে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে UNO মানবাধিকার বিশ্বজনীন ঘোষণা ২৬ নং অনুচ্ছেদে প্রতিটি মানুষের শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। সেইমতো ভারতের শিক্ষায় সংবিধানের ৪৫ নং ধারায় শিক্ষাকে অবৈতনিক সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করেছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে (১৯৬৪-৬৬ খ্রি.) কোঠারি কমিশনের শিক্ষার উদ্দেশ্য হল সকলকে সমান সুযােগ দান করা, পিছিয়ে পড়া মানুষ ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষের শিক্ষার সুযোগ দিয়ে আমাদের জীবনমান উন্নত করা। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষায় সমতা আনা, অসাম্য দূর করা। শিক্ষায় সমতা আনতে গেলে যে-সমস্ত পদক্ষেপগুলি নিতে হবে সেগুলি হল—
- জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিশুর জন্য শিক্ষার সমান সুযােগ। থাকবে। কমিশন কমন স্কুল’ ব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
- উচ্চতর মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বেতন নেওয়া চলবে না।
- শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করতে হবে।
- প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দিতে হবে।
- বিদ্যালয়ে পাঠাগারের ব্যবস্থা করতে হবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের জন্য।
- বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
- প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীদের জন্য (শতকরা ১০%) পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্যান্য বই কেনার জন্য টাকা দিতে হবে।
বর্তমানে শিক্ষা একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অপরিণত শিশু মানবসম্পদে পরিণত হয়। শিক্ষাকে জাতীয় উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। শিক্ষাকে উৎপাদনের সঙ্গে জুড়তে হলে যে-সমস্ত পদক্ষেপ নিতে হবে সেগুলি হল—
- দেশের শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য মাধ্যমিক স্তর থেকে বৃত্তিশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
- বিজ্ঞান শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে হবে।
- বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক শিক্ষা ও গবেষণার উপর জোর দিতে হবে। কৃষিবিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে।
- বিদ্যালয় স্তর থেকে কর্মশিক্ষার উপর জোর দিতে হবে।
ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বাস। তাই শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল সামাজিক ও জাতীয় সংহতি সাধন করে। এই দেশে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এর জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাষা, ধর্মের জাতিভেদ প্রথার মধ্যে বিরোধ বাধে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দেশের সংহতিকে নষ্ট করে। তাই যাতে জাতীয় সংহতি ও ঐক্য বৃদ্ধি পায় সেজন্য কোঠারি কমিশন কিছু পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছে। সেগুলো যথাক্রমে —
- শিক্ষার পাঠক্রম এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ, জাতীয় সংহতি দৃঢ় হয়।
- শিক্ষায় পাঠ্যসূচি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়।
- বিভিন্নরকম দিবস পালন যেমন ১৫ আগস্ট, ২৬ জানুয়ারি, ২ অক্টোবর গান্ধির জন্মদিন, ১২ জানুয়ারি বিবেকানন্দের জন্মদিন ইত্যাদি পালনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে দেশের প্রতি সেন্টিমেন্ট তৈরি করতে হবে, শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে।
- সারাদেশের লােকের শিক্ষার জন্য সাধারণ বিদ্যালয় বা Common School স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- পাঠক্রমে সমাজসেবামূলক কাজ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ভাষা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
- উৎপাদনমুখী প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক ব্যবহার করার শিক্ষা দিতে হবে।
- বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে কর্মের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দান করতে হবে।
Leave a comment