“ধর্মের বেলা আমরা বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছি। ভাষার বেলাও কী দিতে পারিনে?”- প্রসঙ্গ নির্দেশপূর্বক আলোচনাটি বিশদ করো।
বিশিষ্ট মনীষী প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা’ প্রবন্ধটিতে সমকালীন ভারতবর্ষের একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইংরেজাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজিই ছিল সরকারি ভাষা। স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধানে হিন্দিকেই সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দান করা হলেও স্থির হয় যে তার পাশাপাশি ইংরেজিও চলবে। তবে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হবে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে অন্নদাশঙ্কর রায় যখন প্রবন্ধটি রচনা করেন, তৎকালে ভাষার প্রশ্নে দেশময় প্রবল আলোড়ন বর্তমান ছিল। গোঁড়া হিন্দিওয়ালারা হিন্দির পক্ষে জোর প্রচার চালাচ্ছিল–আশঙ্কা হয়েছিল, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভোটের জোরে ইংরেজির বিতাড়ন ঘটরে এবং হিন্দিরই থাকবে একচ্ছত্র অধিকার। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই অন্নদাশঙ্কর প্রবন্ধটি রচনা করেন বলে তিনি সমসাময়িকতার ওপরই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন; কারণ সমাসন্ন বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাবার চিন্তাটাই ছিল প্রবল। আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন।
লেখক বলেন যে বহু ধর্মের দেশ ভারতবর্ষ কোনো একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি না দিয়ে এবং রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করে যথার্থ সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছে। ধর্মের মতোই ভারতবর্ষ বহুভাষী রাষ্ট্রও বটে, কাজেই এখানেও যদি বিশেষ কোনো একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি না দেওয়া হতো, তাহলে এখানেও অনুরূপ সুবিবেচনার পরিচয় পাওয়া যেত। বেশির ভাগ লোকের ইচ্ছা বলে হিন্দিকে এবং একমাত্র হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষার মর্যাদা দান করায় অপর সকল অহিন্দিভাষী ভারতীয়দের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়বার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অবশ্য একেবারেই সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে অত্যল্প কালের জন্য ইংরেজিকেও হিন্দির পাশে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অহিন্দিভাষীরা আতঙ্কিত পরবর্তী অবস্থার কথা চিন্তা করে।
মনীষী অন্নদাশঙ্কর এই ভাষা সমস্যার সমাধানকল্পে যে সূত্র দিয়েছেন, তা হল – হিন্দি যেমন রাষ্ট্রভাষা আছে, তেমনি থাক্ কিন্তু তার পাশাপাশি সহচর ভাষারূপে ইংরেজিও থাক আরো অন্তত পঞ্চাশ বৎসর কাল। কেন ইংরেজি থাকবে, তার কারণ বলতে গিয়ে তিনি স্বীকার করেছেন, নীতিগতভাবে উচিত ছিল সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম প্রভৃতির মতো ভারতেরও বহুভাষী রাষ্ট্র হওয়া; কিন্তু ১৪-১৫টি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষার মর্যাদা দিলে যে জটিলতা এবং অবাস্তব অবস্থার সৃষ্টি হবে, তা সামলানো সম্ভব নয়।
ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত আচরণীয় ব্যাপার, রাষ্ট্রের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নেই; কিন্তু ভাষার ভূমিকা সম্পূর্ণ পৃথক। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্ক সূত্র স্থাপিত হয় ভাষার মাধ্যমে। কাজেই রাষ্ট্র ও ব্যক্তির পারস্পরিক ভাষার আদান-প্রদানে ভাষার ভূমিকাই প্রধান—তাই ভাষার প্রশ্নটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার্য। সেদিক থেকে একভাষী রাষ্ট্রই আদর্শ ব্যবস্থা, কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কোন্ ভাষা গ্রহণযোগ্য? এখানে ১৪-১৫টি প্রধান ভাষার মধ্যে হিন্দিভাষীর সংখ্যা সর্বাধিক হলেও এককভাবে তা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা নয়। তবু মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে হিন্দির জয় সূচিত হওয়াতে তাকেই রাষ্ট্রভাষা করা হয়। এটি দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চলের ভারতবাসীর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, বস্তুত তারা এজন্য ক্ষুব্ধ বটে, তবু দ্বিতীয় অপর কোনো ভারতীয় ভাষার কথা প্রায় কেউ উচ্চারণ করছেন না।
হিন্দি একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে জন্মসূত্রেই হিন্দিভাষীরা এক কদম এগিয়ে থাকবে। উচ্চ পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অহিন্দি ভাষীদের একটি অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে—ন্যায় নীতিবোধের বিচারে যেটি কোনোক্রমেই সমীচীন নয়। তাই লেখকের প্রস্তাব—প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ইংরেজিই হবে একমাত্র পরীক্ষার মাধ্যম—প্রস্তাবটি নিশ্চিতই সমর্থনযোগ্য।
বিদেশি বলে যদি ইংরেজির বিরুদ্ধে আমাদের কোনো ক্ষোভ থাকে, তবে আন্তর্জাতিক ভাষারূপেও একে আমরা গ্রহণ করতে পারি। আমাদের ভাষার মান এবং গতি ঠিক রাখবার জন্যও ইংরেজির অপরিহার্যতা রয়েছে। পক্ষান্তরে হিন্দিতে এমন কিছু শিক্ষণীয় বিষয়ও নেই, পরন্তু এর ব্যাকরণও অতিশয় জটিল, ফলত এর এমন কোনো নিজস্ব আকর্ষণশক্তি নেই, যার জন্যে অহিন্দিভাষীরা হিন্দি শিক্ষায় আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। একমাত্র ইংরেজি যদি তার পাশে থাকে, তবেই অহিন্দিভাষীরা কিছুটা আশ্বাস পেতে পারে।
আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক দুটি সমস্যার প্রতি অঙ্গুলি সংকেত করলেও তাদের কোনো সমাধান সূত্রের দিক নির্দেশ করেননি, অথচ তাঁর মতো মনস্বীর কাছ থেকেই আমরা এ ধরনের ইঙ্গিত প্রত্যাশা করি। সমস্যা দুটির একটি—ইংরেজির ‘বদলে এমন একটি ভাষাকে হিন্দির সঙ্গে’ বন্ধনীভুক্ত করা যে ভাষা আমাদের ন্যায়বোধকে পীড়া দেবে না। সে ভাষাটি কোন ভাষা, অহিন্দিভাষীদেরই দ্বারাই সেটি স্থির হোক।’ লেখক এই ভাষা সম্বন্ধে কোনো ইঙ্গিত দেন নি। তিনি আর একটি সমস্যা—’একবিংশ শতাব্দীর ভাবনা একবিংশ শতাব্দী ভাববে। আমরা যারা বিংশ শতাব্দীতে বাস করছি তাদের ভাবনা বিংশ শতাব্দীকেই ঘিরে।’ আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীর দ্বারদেশে এসে পৌঁছে গেছি বলেই পরবর্তী ভাবনা ভাববার সময় এসে গেছে। ইংরেজির স্থিতাবস্থা এখনও বজায় রয়েছে, কিন্তু একটা সময় আসবে যখন ইংরেজিকে বিদায় দিতেই হবে, কারণ আপৎকাল বলে সাময়িকভাবে ভাষার ক্ষেত্রে একটা গোঁজামিল সাময়িকভাবেই চলতে পারে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এভাবে হতে পারে না। অতএব স্থায়ীভাবেই ইংরেজিকে গ্রহণ বা বর্জন, একটা নীতি গ্রহণ করতেই হবে। আশঙ্কা হয়, জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে একসময় ইংরেজিকে বর্জন করতেই হবে, সেইক্ষেত্রে হিন্দিই কি একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রভাষারূপে বিরাজ করবে। এক্ষেত্রেও যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ রয়েছে যে, সমস্ত ভারতবাসী একমত হয়ে হিন্দির আধিপত্য মেনে নেবে, এমন সম্ভাবনা সুদূর ভবিষ্যতেও দেখা যাবে না। অতএব, এর পাশে অপর এমন একটি ভারতীয় ভাষার স্থান করে দিতে হবে, যাতে অহিন্দিভাষীদের ন্যায়বোধ পীড়িত হবে না। তেমন ভাষা ভারতে একটিই আছে, সেটি সংস্কৃত। উত্তর ভারতের সমস্ত ভাষাই সংস্কৃত থেকেই প্রাকৃত মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে, অতএব প্রত্যেকের সঙ্গেই সংস্কৃতের সমান সম্পর্ক ; তাছাড়া উত্তর ভারতের প্রতি ভাষাতেই প্রচুর সংস্কৃত শব্দও ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ ভারতের ভাষাগুলি সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন না হলেও পরবর্তীকালে তা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। প্রতি ভাষাতেই প্রচুর সংস্কৃত শব্দও ব্যবহৃত হয়। অতএব সেই দিক থেকে কারোরই আপত্তি করার কারণ নেই। এর বিপক্ষে সাধারণ দুটি কারণ দেখানো হয়ে থাকে, এক–সংস্কৃত মৃত ভাষা, দুই—সংস্কৃত ব্যাকরণ বড়ো কঠিন ও জটিল। এর সম্ভাব্য উত্তর–সংস্কৃত মোটেও মৃত ভাষা নয়, য়ুরোপে লাতিনের যে স্থান, ভারতে সংস্কৃতের স্থান তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাষার চর্চা নিয়মিতভাবে সমস্ত দেশে চলছে, প্রতি বৎসর সংস্কৃতে অসংখ্য গ্রন্থাদিও রচিত হচ্ছে—বড়ো জোর বলা চলে, এটি কথ্যভাষা নয়; কিন্তু মৃত ভাষা একে বলা যায় না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর–সংস্কৃত ব্যাকরণ জটিল এবং কঠিন, এই অভিযোগ যথার্থ। কিন্তু এটিকে যুগোপযোগী করে কিছুটা সহজ করে নেওয়া নিশ্চয় দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। খ্রিস্টপূর্ব যুগেই মহাযানপন্থী বৌদ্ধগণ কিন্তু অনায়াসে সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাকৃত মিশিয়ে তাকে অনেক সহজ করে নিয়ে ‘বৌদ্ধ সংস্কৃত’ বা ‘মিশ্র সংস্কৃত’ সৃষ্টি করেছিল। একালের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—ভারতের স্বাধীনতার পরে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে উদ্ভূত ইজরায়েল মৃত হিব্রু ভাষাকে পুনর্জীবিত করে তাকে রাষ্ট্রভাষা করে নিয়েছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী নানা দিগ্দেশাগত ইহুদিগণ এক্ষণে এই হিব্রু ভাষাকেই নিজেদের ভাষারূপে যখন গ্রহণ করে নিয়েছে, তখন আমাদের পক্ষেই বা অসুবিধে হবে কেন?
অতএব সংস্কৃতকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা অথবা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করলেই অন্নদাশঙ্কর কথিত সমস্যা দুটির সহজ সমাধান হতে পারে। এতে যেমন হিন্দি বা অহিন্দিভাষী কার ন্যায়বোধ পীড়িত হবে না, তেমনি একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রভাষাসমস্যা নিয়েও আর দেশভাগের প্রয়োজন দেখা দেবে না।
Leave a comment