ভারতচন্দ্রের কাব্যে হাস্যরস :

বার্নার্ড শ’র পিটার কীগান বলেছিল – “My way of joking is to tell the truth. It’s the funniest joke of the world” একথা ‘প্রমোদের প্রভু’ ভারতচন্দ্রও হয়ত বলতে পারতেন। মঙ্গলকাব্যধারার মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি যাঁর কাব্যে wit বা শ্লেষের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।

রাজরুচি-শাসিত রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র দুটি রসের স্রষ্টা—রতিরস ও রঙ্গরস। কবি কল্পনার নিয়ন্ত্রণে দুটি রস যেন একই অনুভূতিতে যুগলবন্দী। সমালোচক প্রমথ চৌধুরীর মতে, “ভারতচন্দ্রের সাহিত্যের প্রধান রস কিন্তু আদিরস নয়, হাস্যরস। এ রস মধুর নয়। কারণ এ রসের জন্মস্থান হৃদয় নয়, মস্তিষ্ক। জীবন নয়, মন। ….এ হাসি সামাজিক মিথ্যার প্রতি সত্যের বক্রোক্তি।” একথা সত্য, যথার্থ humour বা হাস্যরসের মধ্যে একটি গভীরতা বিদ্যমান। আর প্রকৃত শ্লেষ বা wit-এর মধ্যে বুদ্ধিজাত দীপ্তি ও দাহ প্রকাশমান। কৈলাস শিখরের ললাটস্থ তুষারস্তূপে রৌদ্র প্রতিফলিত হলে যে দীপ্তি, দাহ ও প্রখর উজ্জ্বলতা উদ্ভূত হয় তাতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেদিকে তাকানো যায় না, শ্লেষ বা wit সেই দীপ্তি, দাহ ও তীব্রতা। আর কৈলাস শিখরের পদপ্রান্তে যে সুগভীর মানস হ্রদ বর্তমান, তাতেও রৌদ্র পড়ে প্রতিফলিত হয়, কিন্তু তা চোখকে চমকিত না করে সুস্নিগ্ধ করে তোলে, humour বা হাস্যরস সেই স্নেহময়, মোহময় মধুর ভাস্বরতা। দুটিই দীপ্তিমান। একটি জলে কোমল, অপরটি তুষারে কঠিন, একটি মোহকর, অপরটি দাহকর, একটি আকর্ষণ করে, অপরটি প্রত্যাখ্যান করে, একটি ললাটবহ্নি আর অপরটি অশ্রুর বাড়বানল। কৈলাস শিখরের ললটজ দীপ্তির মত wit বা শ্লেষের উদ্ভাস লেখকের ললাট বা বুদ্ধিতে। আর মানসের হৃদয়জাত দীপ্তির মতোই humour বা হাস্যরসের প্রকাশ লেখকের হৃদয়ের সমবেদনায়। তাই হাস্যরস হাসতে হাসতে কাদায়, শ্লেষ হাসতে হাসতে ভাবায়। হাস্যরসের গতি হৃদয় হতে হৃদয়ে, শ্লেষের গতি মস্তিষ্ক হতে মস্তিষ্কে, হাস্যরসিক পাঠকের সমবেদনার সমতলে স্থাপিত; হাস্যরসিক পাঠকদেরই একজন, শ্লৈষিক কিন্তু পাঠক হতে স্বতন্ত্র, হাস্যরসিক পাঠককে বলে তোমার আমার এই দোষ, আমাদের অবস্থা এক; শ্লৈষিক পাঠককে বলে, তোমার এই দোষ, আমি কত উচ্চে। হাস্যরসিক বন্ধু আর শ্লৈষিক শিক্ষক। হয় তো মূলতঃ দুই-ই এক, যেমন মূলতঃ দুই-ই এক তুষার ও জল; কিন্তু অবস্থাভেদে দুই স্বতন্ত্র। wit বা শ্লেষ ধূর্জটি, রুদ্র। হাস্যরস পার্বতী, কল্যাণী; তারা দুয়ে এক অর্ধনারীশ্বর, একই গৃহী। (দ্রষ্টব্য : ‘বঙ্কিম সরণী’ : প্রমথনাথ বিশী ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ, মিত্র ও ঘোষ) ভারতচন্দ্রের কাব্য wit-বা satire-এর প্রাধান্য। তার কাব্যের আবেদন শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্ত মানুষের কাছে। বিচিত্র সংস্কৃতির ঐতিহ্যে অজ্ঞ মানুষের জন্য তিনি তাঁর কাব্যের রসের উৎস খুলে দেননি। “Swifts satires appeal entirely to the intel lect” (নিকোলে)। ভারতচন্দ্রের কাব্যও তাই। তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিশ্বকে বিদ্ধ করায় তার প্রচুর উৎসাহ। তিনি একান্তভাবে খাঁচার পাখি ছিলেন না। চারিদিকের ভাঙ্গনে ভারতচন্দ্রের অন্তরেও নেমেছিল নিরাশা, নির্বেদের ধস্। তাই ব্যঙ্গের চাবুকেই তার লেখনী হয়েছে সোচ্চার।

বহু সমালোচকের সুচিন্তিত অভিমত, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যটির মধ্যে ইন্দ্রিয়ের উদ্ভ্রাক্ত উন্মত্ততা অভিব্যক্ত, ব্যভিচার-উন্মত্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নরনারীর চিত্রাঙ্কনেই কবি ছিলেন মুগ্ধবিবশ। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, যদিও কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা ছিল বহু বিদগ্ধ ও রসিকের মিলনকেন্দ্র, তবু তা ছিল আমোদপ্রমোদে মুখর, বিলাস-ব্যসনে উল্লোল। হাস্যভাণ্ডবহনকারী গোপাল ভাঁড় ছিল এ সভার মধ্যমণি। তার কুৎসিৎ রসিকতার প্রভাব ভারতচন্দ্রের কবি-মানসে দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়। কেননা বায়ুমণ্ডলে বাস করে বায়ুর চাপ এড়ানো যায় না। আবার এর সঙ্গে ছিল পূর্ববর্তী সাহিত্যধারার দৃষ্টাত্ত যেমন— ‘চর্যাপদে’র আসবমত্ততা, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ কৃষ্ণের যাযাবরী উন্মত্ততা, জয়দেব, বিদ্যাপতির শৃঙ্গার-বাসনা। তাই তাঁর কাব্যের পক্ষে অশ্লীলতা-বিনির্ভর হওয়া অসম্ভব। তাছাড়া অধ্যাপক নিকোলের মতানুযায়ী “The Satirist, however, is not a moralist in the sense that stills is a moralist.”

শিববিবাহের সম্বন্ধ-স্থাপনের অভিলাষে আগত নারদ ও সহচরী-সেবিত গৌরীর উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে স্নিগ্ধ হাস্যরস উচ্ছ্বসিত। বৃদ্ধ ও কিশোরীর অসম মিলন বর্ণনায় নারদের উক্তি নিঃসন্দেহে হাস্যানুলিপ্ত — “পাকা দাড়ি বুড়া বর ঘটাব তোমারে/আনিব এমন বর বাঁয়ে লড়ে দাঁত”। বিয়ের নামে বাঙালী ঘরের সাধারণ কুমারীর মত গৌরীর লজ্জিত আচরণ আরও কৌতুককর— “বিবাহের নামে দেবী ছলে লজ্জা পেয়ে /… আল্যা করি কোলে বসি কেঁদে ধরি গলে/ওমা ওমা বলি উমা কথা কন ছলে।” হরগৌরীর বিবাহের সময় নারীদের পরস্পর কোন্দল সমস্ত মঙ্গলকাব্যেই করুণ মূৰ্চ্ছনায় প্রকাশিত। কিন্তু ভারতচন্দ্রের কাব্যে সেই প্রথানুকূল বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। “সে বলে লো বটে বটে আমি ঢেঁটা।/ গোবিন্দে সুন্দর দেখি চেয়ে রৈল কেটা।” “চারিমুখা রাঙ্গাটা বরের ভাই হেন।/ তার দিকে তোর দিদি চেয়ে রইলে কেন?” “চঁাঁদে দেখি দেখিয়াছি তোর সতীপনা” প্রভৃতি পক্তির মধ্য দিয়ে হয়ত বাঙালী নারীর সতীত্ব অসম্মানিত। তবু কন্যা নয়, বধূ নয়, মাতা নয়, শুধু নারীরূপে যে তরুণী সত্তা উপেক্ষায় অনাদৃত, জরাপ্রাপ্ত স্বামীর সহচর্যে যার মিলনলগ্ন সুতৃপ্ত হয় না, সেই নারী-মনের আসঙ্গ কামনার উন্মুখ-মুখর চিত্র এখানে রূপ ও রেখায় অঙ্কিত। “সামাজিক জড়তার প্রতি সত্যের বক্রোক্তি”; (প্রমথ চৌধুরী) এখানে প্রকাশিত। ব্যর্থ যৌবনের পঙ্গু উপভোগ তৃষ্ণা করুণ ও হাস্যকরভাবে ফুটে উঠেছে। আবার হরগৌরীর কথোপকথনের সময় গৌরীর উক্তি

“পুরুষেরা দেখ যদি নারী মরি যায়

অন্য নারী ঘরে আনে নাহি স্মরে তায় ৷৷”

পুরুষ-কেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার মর্মান্তিক জীবনসত্য এখানে উদ্‌ঘাটিত। এখানে কিন্তু বিদ্রূপ নয়, মমতামথিত humour-এরই প্রাধান্য।

মনীষী কার্লাইলের স্মরণ সুন্দর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য : “True humour springs not mere from the head, than from the heart.” হরগৌরীর বিবাদ-বর্ণনা ও শিবের ভিক্ষাযাত্রার মধ্য দিয়ে আটপৌরে জীবনের অনাবিল হাস্যরস তরঙ্গিত।

শিবের অভিযোগে শিবার “গুণের নাহিক সীমা রূপে ততোধিক / বয়স না দেখি গাছ পাথর বল্মীক । সম্পদের সীমা নাই বুড়া গরু পুঁজি।/ রসনা কেবল কথা সিন্দুকের কুঁজি ।।/… তৈল বিনা চুলে জটা অঙ্গ গেল ফেটে। / শাখা শাড়ী সিন্দুর চন্দন পান ওয়া।/ নাহি দেখি আয়তি কেবল আচাভুয়া ।।”

আবার শিবের উক্তি: “বেলা হৈল অতিরিক্ত পিত্ত হৈল গলা তিক্ত / বৃদ্ধ লোকে ক্ষুধা নাহি সহে / বৃদ্ধকাল আপনার নাহি জানি রোজগার / চাষবাস বাণিজ্য ব্যাপার” প্রভৃতি স্তবকের মধ্য দিয়ে শুধু হাসি নয়, বেদনার ফল্গুধারাও প্রবাহিত। এখানে “Humour verges on pathoes” হয়ে উঠেছে। অন্নদার জরতী বেশে ব্যাস ছলনার দৃশ্যটিতে ছদ্মবেশী অন্নদার নিজেকে যুবতীরূপে প্রমাণ করার প্রয়াস যথার্থই হাস্যকর

“উর্দ্ধগ বিকারে মোর পড়িয়াছে দাঁত।

অন্ন বিনা অন্নদার সুখায়েছে আঁত।

বায়ুতে পাকিয়া চুল হৈল শোণ নুড়ি।

বাতে করিয়াছে খোঁড়া চলি গুড়িগুড়ি ॥”

ভারতচন্দ্রের কাব্য বুদ্ধিগ্রাহ্য হাস্যরসে উজ্জ্বল। অষ্টাদশ শতকের সামাজিক অবক্ষয়, আদর্শ-বিচ্যুতি ও অস্থির জীবন পরিবেশ এবং ভারতচন্দ্রের ব্যক্তিজীবন ও কবিসত্তার বিশিষ্টতার সমন্বয়ে এই ব্যঙ্গদৃষ্টি গঠিত। ব্যাধিজীর্ণ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তিনি কোথাও আশার ক্ষীণাভাসও, দেখতে পান নি। ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাহিনীতে তিনি যেন হেসে হেসে সমাজভিতে সুড়ঙ্গ কেটেছেন। শুধু মাত্র সমাজভিতেই নয়, মঙ্গলকাব্যের বাচনভঙ্গীর ব্যঙ্গাত্মক রূপ এঁকেছেন তাঁর কাব্যের ক্যানভাসে, চরিত্র গড়তে গিয়ে ‘ক্যারিকেচার কে প্রশ্রয় দিয়েছেন। সুযোগ পেলেই ধর্মধ্বজী, সমাজকে সুশাণিত বিদ্রূপের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। এমন কি প্রতিপালক কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিও ব্যঙ্গবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছে, যদিও তা অলঙ্কারে আচ্ছাদিত : “চন্দ্রের হৃদয়ে কালি কলঙ্ক কেবল/ কৃষ্ণচন্দ্র হৃদে কালী সর্ব্বদা উজ্জ্বল।” প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ কবি বিষ্ণু দে-ও তার “স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ” কাব্যে বর্তমানে ফাঁকি যুগের কাছে ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন—

“এ নরকে

মনে হয় আশা নেই জীবনের ভাষা নেই,

যেখানে রয়েছি আজ সে কোনো গ্রামও নয়, শহর তো নয়,

প্রাত্তর পাহাড় নয়, নদী নয়, দুঃস্বপ্ন কেবল।”

সম্ভবত ভারতচন্দ্রের কবিমানসেও এ বোধ দেখা দিয়েছিল।

কিন্তু তবু ভারতচন্দ্রের কাব্যের অশ্লীলতা অনুপেক্ষণীয়। মদনভস্মের পর থেকে আদিরসাত্মক হাস্যরসের রঙীন চিত্রাল্পনা পরিস্ফুট। মদনের পুষ্পশর নিক্ষেপে—“কাম শরে ত্রস্ত নারী লাগি ব্যস্ত”, “কামে মত্ত হর দেখিয়া অপ্সর কিন্নর দেবী সকল যায় পলাইয়া পশ্চাৎ তাড়িয়া—ফিরেন শিব চঞ্চল”। এমন সময় নারদ বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এলে “কহেন শঙ্কর বিলম্ব না কর—আজি কেন মোর বাবা”। ধূলিময় মাটির কলঙ্কে মসীলিপ্ত শিবের এই বর্ণনায় ভক্ত-সমালোচক বেদনাহত। এরূপ বিকৃত হাস্যরসের বর্ণনা পাওয়া যায় বিবাহ-সভায় শিবকে বিবস্ত্র করার মধ্যে। কেশবের কৌতুক প্রচেষ্টায় গরুড়ের হুঙ্কারে “মাথা গুঁজে যত সাপ যায় পলাইয়া বাঘছাল খসিল উলঙ্গ হৈলা হর” ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। শৃঙ্গার রস এখানে ইন্দ্রিয়ের শৃঙ্খলে বন্দী। তাই তাঁর কাব্য এখানে দেহজ বাসনার পঙ্কে নিমজ্জিত, সেখানে শ্বেতপদ্মের সন্ধান পাওয়া যায় না।

ভারতচন্দ্র যুগসন্ধির কবি:

“দেশ, ভাবো সুজলা সুফলা এই মলয়শীতলা মাতা দেশ, 

ছিন্নভিন্ন, অথচ প্রাচীন পরিচয়ে সত্তার চৈতন্যে ধনী

প্রজ্ঞায় সংহত স্মৃতির শিকড়ে ধন্য কালের বাগানে। 

অথচ বিচ্ছিন্ন ছারখার হাজার দাগায় আহত বিকল 

যেন বা দেহের সব আছে, শুধু স্নায়ু স্নায়ুকোষ, 

অভুক্ত, অসুস্থ, কাটা পঙ্গু শত শত স্নায়ুকোষ, 

তাই আমাদের মনে, বাস্তব জীবনে কবন্ধের ছড়াছড়ি 

বাঙলায় হাজার রূপের হাজার রাক্ষস,

বহুদল ক্ষমতার হরেক কৌশল। 

তাই আত্মপরিচয় নেই, ব্যক্তি নেই সত্তা নেই, 

লাল নীল কমলের দেশে আজ বর নেই, 

বিধবার দেশে অরক্ষণীয়া সুন্দরীর বর নেই, সত্তা নেই”

অনেকটা এই ধরনের অবস্থা অষ্টাদশ শতকের যুগদর্পণেও পরিলক্ষিত হয়। মহাপ্রভুর আজীবন আচরিত মহতী ভক্তিসাধনার ফলে বৃহতী গ্রামীণ সমাজ যে ‘বিবিধের মাঝে মহামিলনে’র মন্ত্রোচারণে ছিল নিষ্ঠাবান্—যুগের প্রভাবে, রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ে ভেঙ্গে পড়ল সেই মিলন-মাঙ্গল্যের পুণ্যবেদী। বিলীন হল প্রাচীন মূল্যবোধ আর ঐতিহ্যচেতনতা। সংসার সরতে সরতে থমকে দাঁড়াল পাতালের গুহামুখে। কুখ্যাত বর্গীর স্পর্ধিত আচরণ ক্রমেই হল বর্ধিত। তাদের আক্রমণে গ্রাম-বাংলার বুকে জ্বলে উঠল অত্যাচারের দাবানল। ঘুমস্ত ব্রতকথার মত শান্ত পল্লীগ্রামের জনমানসে নেমে এল আশঙ্কার ধস্। আয়ের ঘরে শস্যহীন মাঠ, ব্যয়ের ঘরের লবণাক্ত বন্যায় মানুষ হল দিশেহারা। হিংসা-অত্যাচার অবিচারের বেসাতিতে সমগ্র যুগ হল আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রঘুনাথ, ভাস্কর পণ্ডিতের সৈন্যবাহিনীর বিষ নিঃশ্বাসে দেবতার দেউল হল অত্যাচারে বিপর্যস্ত। পণ্যায়িতা নারীদেহ আর সোনার বাংলার ঐশ্বর্য-সম্ভারে তাদের কোষাগার হল সমৃদ্ধ। যুগটি “মসিল দিয়ে তসিল” করার যুগ। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের তীক্ষ্ণধী মন্তব্য— “Everybody and everything was on sale.”

একদিকে গ্রাম-বাংলার এই রক্তলাঞ্ছিত রূপ, অন্যদিকে নগর-সভ্যতা তখন নতুন জৌলুষে, বিলাস-ব্যসনে আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রায় ফেনিলোচ্ছল। মোগল অধিকারে সমাজে তখন প্রবাহিত হচ্ছে বাদশাহী বিলাসের চিহ্ন কুরুচিপূর্ণ কেলি-বিলাস আর আসব-মত্ততার হুঙ্কার। নিখিল বাংলার পীঠস্থান নবদ্বীপ তখন দরবারী আদর্শের পরিবেশ শাসিত। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় তখন তরঙ্গিত মোগল-সংস্কৃতির উন্মত্ত বাতাস আর লালসা-লাঞ্ছিত জীবনযাত্রার আপাতমধুর সুরধ্বনি। নবদ্বীপ কৃষ্ণনগরের অদূরে সুবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে তখন নবাব আলিবর্দীর শাসনব্যবস্থায় চিতানল ধূমায়মান। দৌহিত্র সিরাজদ্দৌল্লার কেলি-বিলাস-কলায় তখন রাজসভা গরলে প্রলিপ্ত। চতুর্দিকে শুধু মালিন্য আর আবিল্য, বক্রতা আর শীর্ণতা, দেহজ কামনার উন্মত্ততা। সেই জীবনযাপন লীলায় আকৃষ্ট হয়ে সমাজের ধনিক সম্প্রদায় তখন পল্লীকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার সমাধি রচিত করে নগর জীবনযাপনে মনোযোগী হলেন। Chamfort বলেছিলেন: “Society is composed of two great classes, those who have more dinner than appetite, and those who have more appetite than dinner.” এখানেও তাই দেখি, একদিকে গ্রাম্য জীবনের অপাংক্তেয় মানুষের রক্তাক্ত আলেখ্য।

অপরদিকে অবাধ কাম-কেলী, অসংযত জীবনের বিফল বাসনায় আসক্ত অভিজাত সম্প্রদায় নারীকে প্রেমিকা রূপে নয়, দাহিকারূপে লাভ করার আসঙ্গ কামনার উন্মুখ-মুখর। ধনী নাগরিক শ্রেণীর কাছে তখন দেশ, জাতি, সমাজজীবনের উচ্চতর আদর্শ বৃত্তিগুলি হাস্যকর প্রলাপমাত্র। মুর্শিদাবাদের নবাবের রাজদরবারের বিলাস-কলা-কুতুহলের যৌনাচার তখন বিত্তবান ভূস্বামীদের রাজসভায়ও প্রতিফলিত। তাই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা হয়ে উঠেছিল যদিও বহু বিদগ্ধ ও রসিকের মিলনবীথি, তবু তা ছিল বিলাস-ব্যসনে মুখর, আমোদ-প্রমোদে উল্লোল। নিষ্ঠার চেয়ে চাতুর্য, অনুভূতির চেয়ে বৈদগ্ধ্য, আর ভাবগভীরতার চেয়ে চটুল বাগ্-দীপ্তির ছিল সসম্মান প্রাধান্য। নৈষধচরিত’, ‘দশকুমারচরিত’, ‘হর্ষচরিত’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের এ সভায় পেয়েছে অবাধ ছাড়পত্র। কেননা ঐসব কাব্য ছিল আলঙ্করিক কারুকার্য ও সূক্ষ্ম পারিপাট্য-প্রধান।

‘অন্নদামঙ্গল’-এর পটভূমি ছিল এই রাজসভা, আর রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ছিলেন তারই সভাকবি। তাই মনে হয়, বিদ্যা বিদগ্ধ ‘বিদ্যাসুন্দরের’ যে সম্ভোগময় চিত্রাল্পনা ও বাক্-নির্মিতির বিস্ময়কর পরিমার্জনা ভারত-কণ্ঠের মুখ্য রাগিণী, তা এই রাজসভারই পরিবেশ-শাসিত রুচি-নিষ্ঠার অভিজ্ঞান।

ভারতচন্দ্র মুসলমান যুগের অন্তিম লগ্নের কবি। তার পর থেকেই মঙ্গলকাব্যের দীপনির্বাণ। দীর্ঘকাল বাংলা কাব্যজগতে উচ্চতর কবি-প্রতিভার বনবাস। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যাহ্ন পর্যন্ত কাব্যাকাশে তাঁর অদৃশ্য আবির্ভাব অনুপেক্ষণীয়। পলাশী যুদ্ধ হতে সিপাহী বিদ্রোহের সেই সংকটকাল পর্যন্ত ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর’-এর কাম কেলির মিথুন-মূর্তিই হয়ে উঠেছিল বাঙালী জনমানসের সম্পদহীন রুচি-বিচারের একক প্রতিনিধি। কবিগান ও টপ্পার মধ্যেও আছে তার প্রভাবের প্রথম উদ্ভাস। ধ্বনিঝঙ্কারের সঙ্গে অশালীন রুচির সংযোগে কবিগানে ভারতচন্দ্রে অক্ষম অনুকরণের প্রয়াস লক্ষণীয়—

“আজ বাঁধবো তোমায় বনমালি

ধরিয়ে সখীমণ্ডলী

নাগরালি তোমার যত    করব হত,

দিয়ে অঙ্গেতে ধূলি।

গোরসের অবশেষ দিব মস্তকে ঢালি।”

নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলে প্রচলিত খেঁড় বা খেউর সঙ্গীত ভারতচন্দ্রের কাব্যের কারুকার্যে মণ্ডিত হয়ে নাগরিক আভিজাত্য লাভ করে চুঁচুড়া ঘুরে কলকাতায় নিধুবাবুর গানে পরিশোধিত রূপ ধারণ করে। একাধিক বিদেশী গ্রন্থকর্তার পুস্তকে অর্থাৎ ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যাল্‌হ্ডে ও লেবেডফের ব্যাকরণে, হেনরী ফরস্টারের অভিধানেও বিবিধ সঙ্কলন গ্রন্থে ভারতচন্দ্রের উদ্ধৃতি দেখা যায়। ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর ইংরেজী অনুবাদও (১৮৯০ খ্রীঃ) দেখা যায়।

ঈশ্বর গুপ্তের অধিকাংশ কবিতাও ভারত-কবির কামনার চাঞ্চল্যে উদ্‌ভ্রান্ত। তাঁর অনুপ্রাসের চকিত চমক, শ্লেষ ও যমকের ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি ও ভারতচন্দ্রের আদর্শানুসারী। ভারত-রস-প্রবাহ থেকেই তাঁর ‘য়ারকী’র খাল খনিত। ভারতচন্দ্রের অনুভাবনায় রঙ্গলালও ‘ভুজঙ্গপ্রয়াত’ ও ‘মালঝাপ’ পয়ারের প্রতি অনুরক্ত হন। তাঁর ‘কাঞ্চী কাবেরী’ কাব্যের মণিকা গোয়ালিনী হীরা মালিনীরই প্রতিবিম্ব। হীরা মালিনীর চয়ন করা ফুলে বাংলা কাব্য-মালঞ্চে দীর্ঘকাল ধরে যে সারস্বতার্ঘ সজ্জিত হয়েছে একথা অবশ্যস্বীকার্য। মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনাকাব্যে’ ও তাঁর ‘অন্নপূর্ণার ঝাপি’ সনেটটিতে ভারতচন্দ্রের প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া পৃথ্বীচন্দ্রের ‘গৌরমঙ্গল’, দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী’, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘বাসবদত্তা’, অক্ষয়কুমার দত্তের ‘অনঙ্গমোহন’ কাব্যে ভারতচন্দ্রের ভাবনা উপস্থিত।

ভারতচন্দ্রের কাব্যে পয়ারের যতিস্থাপনের স্বাধীনতার মধ্যেও অমিত্রছন্দের ক্ষীণাভাস পাওয়া যেতে পারে। ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বর দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতচন্দ্রের কাব্যের বাক্রীতি প্রায় নব্য ভারতীয় আর্যভাষারই অনুগামী। তাছাড়া হ্যালহেডের ব্যাকরণে (১৭৭৮ খ্রীঃ), ফরস্টারের ব্যাকরণে (১৭৯৯-১৮০২ খ্রীস্টাব্দ) ও লেবেডফের ব্যাকরণে (১৭৯৫ খ্রীঃ) ভারতচন্দ্রের গ্রন্থ থেকে বহু উদ্ধৃতির উল্লেখ গ্রন্থটির পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে ভাষাগত প্রভাব প্রমাণ করে।

কিন্তু তবু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্য নিয়ে বলা যায় ভারতচন্দ্র ‘যুগসন্ধির কবি’ নন। কেননা ‘যুগসন্ধি’ অর্থ পুরাতন ও নবীনের মালাবদল। নবযুগের বহ্নিকুণ্ডে পুরাতন সংস্কৃতির আত্মবিসর্জন। আর রাত্রির শেষ যাম অতিক্রম করে নবীন ভাবনার দীপ্তি ও দাহ নিয়ে নবযুগের পরিচয় পরিস্ফুট হয়। সেই যুগের কবিশ্রেষ্ঠই ‘যুগসন্ধির কবি’ আখ্যা প্রাপ্ত। স্বর্গের অমৃতসন্ধান নয়, মর্ত্যমৃত্তিকার প্রতি ভালবাসাতেই সেই কবি হন মুগ্ধবিবশ। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ভারতচন্দ্র ‘যুগসন্ধির কবি’ নন। বিপর্যয়ের বিষপান করে তিনি হয়েছিলেন নীলকণ্ঠ, তাই সেই বিষবেদনার রক্তবিন্দুতে তার কাব্যের একাংশ ছায়াছন্ন। দেশ ও সমাজের প্রতি মমতামথিত অনুরাগ সেখানে অনেকক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বরং জীবন ও জীবনাতীত সম্বন্ধে অম্লাক্ত তির্যকতা সেখানে প্রকাশিত। গ্রাম বাংলা তাঁর কাব্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। অথচ কাব্যে উপেক্ষিতা এই দুয়োরানীর মর্মবেদনা ঈশ্বরগুপ্তের কাব্যে হয়েছে উদ্ভাসিত। তাছাড়া আধুনিক জীবনবোধের যে সকল প্রধান লক্ষ্য—যুক্তিবাদের জয়ঘোষণা, মানবতাবোধের অভিজ্ঞতা, ভৌগোলিক সীমা সম্প্রসারণ, স্বদেশচেতনা, রাষ্ট্র-ধর্ম-সমাজ সম্বন্ধে বাস্তব-চেতনা-লব্ধ হিতৈষণার যথাযথ আলেখ্য ভারতচন্দ্রের কাব্যে বিরল। সেই সময় ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড’ রাজদণ্ডের রূপ ধারণে অগ্রসর হয়। কিন্তু ভারতচন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্রের সভা, সৈন্যবাহিনী বিস্তৃত বিবরণ দিলে মুর্শিদাবাদের ইংরেজ সম্বন্ধে নীরব।

অষ্টাদশ শতকে গ্রামবাংলার যে শোষিত মূর্তির নিষ্করুণ চিত্রাঙ্কনে সমসাময়িক যুগের সাধক কবি রামপ্রসাদ বেদনার ক্ষতে মাতৃনামের সম্মোহিনী প্রলেপ দিতে প্রয়াসী, ভারতচন্দ্রে তার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি অবশ্যই সমালোচনার অপেক্ষা রাখে। আসলে তিনি যুগস্রষ্টা নন, ব্যভিচার-লিপ্ত রাজসভা ও রাজবাসনার নিপুণ অনুকারী কবি। সেই কামনাস্মিত আনন্দবাজারের তিনি একজন প্রধান হোতা। শুধু জরাজীর্ণ পঙ্গু সমাজকেই নয়, রাজসভা, রাজশক্তিও হয়েছে তাঁর সুশাণিত ব্যঙ্গের আয়ুধে বিমথিত, যদিও তা অলঙ্কারের ছদ্মাবরণে আবৃত—

“চন্দ্রের হৃদয়ে কালী কলঙ্ক কেবল।

কৃষ্ণচন্দ্র হৃদে কালী সৰ্ব্বদা উজ্জ্বল ॥”

তাই বলা যেতে পারে তিনি ‘যুগসন্ধির কবি’ নন; হঠাৎ আলোর ঝলকানি। তার প্রভাব পরবর্তীকালে হয়ত আছে, যেমন আছে সুবন্ধু, ভাস প্রভৃতির উপর কালিদাসের প্রভাব, কিংবা করুণানিধান, কিরণধন, যতীন্দ্রমোহন প্রমুখের উপর রবীন্দ্রপ্রভাব। কিন্তু তাঁর জন্য তাঁকে সমগ্র যুগের বাণীবাহী বলতে অনেকেই অপারগ। বরং সে দাবী ঈশ্বর গুপ্তের পক্ষে সম্ভব। ভারতচন্দ্র তাই ‘যুগসন্ধির কবি’ নন। আধুনিক যুগের যে দু-একটি লক্ষণ এ কাব্যে দেখা যায় তা অনেকটা অকালে বা প্রাক্-বসন্তে হঠাৎ ডেকে ওঠা কোকিল কণ্ঠস্বরের মত। তা সুন্দর, কিন্তু তাতে বসন্তের আবির্ভাব হয়েছে একথা মনে করা যায় না।