‘গানের আড়ালে’ কবিতাটি কবির ‘চক্রবাক্’ (১৯২৯ খ্রিঃ) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ‘চক্রবাক’ কাব্যের মূল সুর প্রেম-বিরহ। প্রেমজনিত বেদনা থেকে এই কাব্যের জন্ম। রামায়ণে কথিত আছে, ব্যাধের শরে ক্রৌঞ্চমিথুনের একটি নিহিত হলে অপরটির শোক দেখে আদিকবি বাল্মীকির মুখে প্রথম শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল। চক্রবাকীর জন্য বিরহী চক্রবাকের দুঃখ আদিকবি অনুভব করেছিলেন। এখানেও প্রিয়াকে অপ্রাপ্তিজনিত কবিপ্রাণের যে বিরহ, যে বিপ্রলম্ভ-শৃঙ্গার তাই এই কাব্যান্তর্গত কবিতাগুলিতে উদ্গীত হয়েছে। চক্রবারূপ কবির ক্রন্দমান হৃদয়ের অপরুপ গীতিমূর্ছনা এই কাব্যের কবিতাগুলিতে সাধারণভাবে এবং ‘গানের আড়ালে’ কবিতায় বিশেষভাবে মূর্ত হয়েছে।
কবি নজরুলের ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিশেষ বাশী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণি-মনসা’, ‘জিঞ্জীর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয়শিখা’ কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে দেশপ্রেম, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবির বিক্ষোভ, নৈরাশ্য, আশা ইত্যাদি কাব্যরূপ পেয়েছে। আর ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ ও ‘চক্রবাকে’র মধ্যে কবির প্রেমিকরূপই বেশী মাত্রায় প্রতিফলিত। মানবিক প্রেম, বাৎসল্য, প্রকৃতি প্রেম প্রভৃতি বিষয়ই এইসব গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য।
‘চক্রবাকে’র কবিতাগুলিতে বিশেষভাবে ‘গানের আড়ালে’ কবিতায় প্রেমের এক রোমান্টিক বিষণ্ণতার ( romantic melancholy) সুর বেজে উঠেছে। বাংলা কাব্যে এই রোমান্টিক বিষণ্ণতার সুর বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাছেই প্রথম শোনা যায়, আর এই সুরের চরম শিল্পোৎকর্ষ আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথে। পরবর্তীকালের কবিদের হাতে দেহকামনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই রোমান্টিক-বিষণ্ণ-প্রেম-ভাবনার সুর বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। বিষণ্ণ ব্যথার সকরুণ সুর নজরুলের অনেক প্রেমের কবিতাতেই ঝংকৃত হয়েছে। নিঃসঙ্গ একাকীত্বের দুঃসহ বেদনা কবির বহু কবিতাকে বিরহের দীর্ঘশ্বাসে ভরে দিয়েছে।
‘গানের আড়ালে’ কবিতাতে প্রেমিক হৃদয়ের বিচিত্র ভাব-কল্পনা ব্যস্ত হয়েছে। কবির রোমান্টিক বিষণ্ণতা দিয়ে ঘেরা প্রেমমূলক এই কবিতা রচনার পটভূমিকায় সমকালীন কোন ঘটনা হয়ত ক্রিয়াশীল ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষ্যে কবি ঢাকায় আসেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। নজরুল তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু ফজিলতুন্নেসা নজরুলের প্রেমে সাড়া দেন নি। এ সময়ে নজরুলের মানসিকতায় যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার পরিচয় রয়েছে ঐ সময়ে লিখিত ‘এর মোর অহংকার’ কবিতায়। আবার ঐ একই সময়ে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় নজরুল রাণু বা প্রতিভা সোমকে (পরবর্তীকালে প্রতিভা বসু) কয়েকটি গজল শিখিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই নজরুল প্রতিভা সোমকে আপন করে নেন। নজরুল তাঁর ‘চোখের চাতক’ গানের বইটি প্রতিভা সোমকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন, ‘কল্যাণীয়া বীণাকণ্ঠী শ্রীমতী প্রতিভা সোম জয়যুক্তাসু’। প্রতিভা সোমের ব্যাপারে পাড়ার ঈর্ষাতুর ছেলেদের হাতে কবির নিগৃহীত হবার মতো বেদনাদায়ক ঘটনাও ঘটেছিল। ফজিলতুন্নেসার কাছ থেকে পাওয়া বেদনা এবং প্রতিভা (রাণু) সোমের ব্যাপারে বেদনাদায়ক ঘটনা সম্ভবতঃ ‘গানের আড়ালে’ কবিতা রচনার পটভূমিকা।
কবি-মনের গোপন ব্যথাই এখানে কবিতাটির ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তি-বিশেষ থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যানের বেদনা কবিতাটিতে অনেকটা নির্বিশেষ রূপ লাভ করেছে। প্রেমিক হৃদয়ের চিরন্তন আবেদন ভাষা পেয়েছে। কবি নিজেকে নিঃশেষে উজাড় করে যাকে এই গান শিখিয়েছেন, তার কাছে কবির প্রশ্ন, এই গানের সুর ও কথা নিয়ে তার যে বহিরঙ্গ পরিচয়, সেই পরিচয়টুকুই কি থাকবে? হৃদয়ের উৎসস্থল হতে সেই যে সুর ও কথা উঠে এসেছে, সেই গহন মনের গোপন পুরের অন্তরঙ্গ পরিচয় তা কি অনুদ্ঘাটিতই থাকবে? কবি-মনে এই গান শোনানোর ও শেখানোর বেশী হয়তো আরো কিছু প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশা ছিল হয়তো শুধু সুরে সুরে যোগ সাধনই নয়, সুরের মধ্য দিয়ে হৃদয়ে হৃদয়ে যোগ সাধন, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের আলাপন। কিন্তু কবির সে প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। এর ফলে কবি নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করছেন এবং তারই বেদনা কবিতার ছত্রে ছত্রে রণিত হয়েছে। একটা ব্যর্থতার বিষণ্ণতা কবি মনকে পেয়ে বসেছে।
এই ব্যক্তিগত ব্যথা-বেদনার স্তর ছাড়িয়ে আর একটা গভীরতর ও সর্বজনীন স্তরের ইংগিতও কবিতাটির মধ্য দিয়ে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত আবেদন নয়, কবি-মনের চিরন্তন আবেদনই কবিতাটিতে ভাষা পেয়েছে। কবির গানকে লোকে গ্রহণ করে, কিন্তু সে গান সৃষ্টির পেছনে তাঁর ব্যথা-বেদনা ও ক্রন্দনকে কেউ লক্ষ্য করে না। ধূপ নিজে পুড়ে যে সুগন্ধ সৃষ্টি করে, লোকে তার গন্ধটুকু গ্রহণ করে, ধূপের দহন-জ্বালার কথা মনেও রাখে না। কবি-হৃদয়ের দহন-জ্বালাসৃষ্ট গান বহুলোকের আদরের সামগ্রী হলেও কবি-হৃদয় তাদের হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে ওঠে না। তাই কবির মিনতি, অন্তরঙ্গ ভক্তপাঠক বা প্রেমিকার কাছে, তাঁর গানের ভিতর দিয়ে তিনি যেন প্রেমিকার অন্তরের নিকটবর্তী হন।
“ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়,
আমি শুধু এর কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়।
জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি
কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।”
‘গানের আড়ালে’ কবিতার সঙ্গে সঙ্গে জড়ানো আছে কবির যে রোমান্টিক বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতার বেদনা প্রত্যাখ্যানের বেদনা তা তার ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘চক্রবাক্’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রেম-প্রিয়া-প্রকৃতিমূলক অনেক কবিতাতেই পাওয়া যাবে। কবির ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’ কবিতায় দ্বিতীয় প্রজাপতিরূপ কবি সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছেন, বিষণ্ণতা ও নিঃসঙ্গতাকে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেন নি।
“ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ……..
মোর ডাইনে শিশু সদ্যজাত জরায়-মরা বাম পাশে।
মন ছুট্ছে গো আজ বল্লা-হারা অশ্ব যেন পাগলা সে!”
বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে ছুটে গেলেও প্রেমিকার প্রত্যাখ্যানে কবি বেদনাহত। তাঁর সেই অভিমান-ক্ষুব্ধ হৃদয় বেদনা প্রকাশ পেয়েছে ‘অভিশাপ’ কবিতায়-
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে
বুঝবে সেদিন বুঝবে!”
রবীন্দ্রনাথও অনুভব করেছেন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ না হলে গানের পশরা ব্যর্থ হয়ে যায়। “Fall upon the thorns of life, I bleed’ রোমান্টিক কবি শেলির এই বেদনাহত অনুভবও একই সুরে বাঁধা। রোমান্টিক কবি নজরুলও একের সঙ্গে অপর হৃদয়ের সুর, অন্তরতর পরিচয়ের সুর মেলাতে না পেরেই নিঃসঙ্গতার বেদনা অনুভব করেছেন, এককথায় এ বেদনা রোমান্টিক কবি হৃদয়ের বেদনা।
Leave a comment