অন্তদৃষ্টি হল একটি সমস্যাসমাধানমূলক শিখন পদ্ধতি। প্রাণী সমস্যামূলক পরিস্থিতির স্বরূপ সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করার পর হঠাৎ করেই সমস্যার সমাধান করে ফেলে; তার জন্য প্রচেষ্টা ও ভুলের প্রয়ােজন হয় না। একেই অন্তদৃষ্টি বলে।

যে-সমস্ত সমগ্রতাবাদীরা অন্তদৃষ্টির কথা বলেন তারা হলেন কা , কোহলার, ওয়ারদাইমার প্রমুখ। এই তিনজন মনােবিদকে গেস্টান্টবাদী বা সমগ্রতাবাদী বলা হয়।

শিক্ষার্থী অন্তদৃষ্টিবা প্রত্যক্ষণ পদ্ধতিতে সমস্যামূলক পরিস্থিতির মধ্যে যতটুকু ব্যবধান রয়েছে, তাকে পূরণ করতে পারে।

অন্তর্দৃষ্টিমূলক শিখন

গেস্টাল্টবাদীদের মতে, শিখনের ক্ষেত্রে পৃথকীকরণ এবং সামান্যীকরণ— এই দুটি মানসিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা যে-কোনাে শিখনে প্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি সরিয়ে দিয়ে পৃথকীকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তারপর এর প্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে সামান্যধর্মী সূত্র গঠন করেছেন। প্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি সামান্যীকরণের ফলে প্রাণী সামগ্রিক রূপটি প্রত্যক্ষণ করতে পারে। সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে হঠাৎ প্রত্যক্ষণ মনােবিদদের ভাষায় অন্তদৃষ্টি এবং তার দ্বারা শিখনকে অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন বলে।

অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন কৌশলের মৌলিক প্রক্রিয়া

অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন কৌশলের জন্য সমগ্রতাবাদীরা যে দুটি মৌলিক পদ্ধতির কথা বলেছেন, তা হল一

(১) পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া : শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া হল পৃথকীকরণ। পৃথকীকরণে অপ্রয়ােজনীয় বা  অপ্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বাদ দেওয়া হয়।

(২) সামান্যীকরণ: প্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলি নির্বাচনের পর তার উপর ভিত্তি করে সাধারণ নীতি বা সূত্র তৈরি করার প্রক্রিয়াকে সামান্যীকরণ বলে।

উদাহরন: যে-কোনাে শিখনের সময় প্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি নির্বাচনের জন্য অপ্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি সরিয়ে দিতে হয় পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে। এরপর প্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে সামান্যধর্মী সূত্র গঠন করা হয়। প্রয়ােজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলির সামান্যীকরণের ফলে প্রাণী সামগ্রিক রূপটি প্রত্যক্ষণ করে। সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে হঠাৎ প্রত্যক্ষণকে গেস্টাল্ট মনােবিদগণ অন্তদৃষ্টি বলেছেন।

কোহলারের পরীক্ষা

গেস্টাল্ট মনােবিজ্ঞানী কোহলার শিম্পাঞ্জি নিয়ে পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন যে, প্রাণীর সামনে সমস্যামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, প্রথম অবস্থায় কিছুক্ষণ ধরে প্রচেষ্টা ও ভুলের পথে এগিয়ে গেলেও সে বেশিক্ষণ ওই পথে থাকতে পারে না। একটু পরে ওই প্রচেষ্টা ও ভুলের পথ ছেড়ে পরিস্থিতিকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষণ করে সমস্যাটির সমাধান করে। নীচে কোহলারের পরীক্ষাটি দেখানাে হল— 

পরীক্ষার উপকরণ: কোহলারর্তার পরীক্ষার জন্য নিয়েছিলেন সুলতান নামে শিম্পাঞ্জি, একটি খাঁচা, দুটি বাঁশের লাঠিযা একটির মধ্যে অন্যটি প্রবেশ করিয়ে জোড়া লাগানাে যায়, খাদ্যবস্তু হিসেবে কয়েকটি কলা।

পরীক্ষা: কোহলার তার পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সুলতান নামক শিম্পাঞ্জিটিকে কিছু খেতে না দিয়ে খাঁচার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। খাঁচার বাইরে খাদ্যবস্তু হিসেবে | কলাগুলিকে এমন দূরত্বে রাখলেন, যাতে একটি লাঠি কলা পর্যন্ত না যায়। লাঠি দুটিকে খাঁচার মধ্যে রাখলেন।

পর্যবেক্ষণ: এরপর কোহলার শিম্পাঞ্জির আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন— 

  • প্রথমে শিম্পাঞ্জিটি এক-একটি লাঠি দিয়ে খাদ্যবস্তু হিসেবে কলার ছড়াকে টেনে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রত্যেকটি লাঠি কলার দূরত্ব থেকে ছােটো হওয়ায় তা সম্ভব হল না।
  • এরপর শিম্পাঞ্জিটি একটি লাঠিকে আর-একটি লাঠির দ্বারা ঠ্যালা দিয়ে কলার ছড়া পর্যন্ত নিয়ে গেল। কিন্তু এক্ষেত্রেও সম্ভব হল না , কারণ সে লাঠিদুটিকে জোড়া লাগাতে পারেনি।
  • এই পর্যায়ে শিম্পাঞ্জিটি নিরাশ হয়ে লাঠি দুটিকে নিয়ে খেলা করতে লাগল। ঠিক এই সময় কোহলার কিছু ইঙ্গিত দিলেন কীভাবে লাঠি দুটিকে জুড়তে হয়। তিনি দুটি আঙুলকে বার করে জোড়া করে মুখােমুখি দেখাতে লাগলেন। কিন্তু শিম্পাঞ্জি সেই ইঙ্গিত বুঝতে পারল না।
  • পরবর্তী পর্যায়ে শিম্পাঞ্জিটি লাঠি নিয়ে খেলা করতে করতে একসময় হঠাৎ একটি লাঠিকে আর-একটি লাঠির সঙ্গে জুড়ে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই যুক্ত লাঠি দিয়ে কলার ছড়াকে কাছে টেনে নিল। এইভাবে যে সমস্যাটির সমাধান করল।

সিদ্ধান্ত: এই পরীক্ষা থেকে গেস্টাল্টবাদীরা সিদ্ধান্তে আসেন যে, অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কৌশল দেখা যায়। এখানে পরিস্থিতির সামগ্রিক সত্তা প্রত্যক্ষণের ভিতর দিয়ে শিম্পাঞ্জিটি পরিস্থিতির সামগ্রিক রূপের মধ্যেকার সম্পর্কগুলি উপলব্ধি করে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে সমস্যাসমাধানের পথ শিখে নেয়। অর্থাৎ কলার ছড়ার অবস্থান, লাঠির দৈর্ঘ্য, নিজের অবস্থান ইত্যাদির মধ্যেকার সম্পর্ক সামগ্রিকভাবে সুলতান নামক শিম্পাঞ্জিটি বুঝতে পেরেছিল বলে, তার পক্ষে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। তাই গেস্টাল্টবাদীরা মনে করেন, শিখন অংশভিত্তিক হয় না, শিখন হয় সামগ্রিক রূপের ভিত্তিতে।

শিম্পাজিকে নিয়ে কোহলারের পরীক্ষা

অন্তদৃষ্টিমূলক শিখনের পরীক্ষায় মনােবিজ্ঞানী উলফগ্যাং কোহলার কয়েকটি শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে পরীক্ষা করেন।

পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ: একটি উঁচু খাঁচার ছাদ থেকে কয়েকটি কলা ঝুলিয়ে রাখলেন। কিন্তু নাগালের বাইরে থাকা কলা কিছুতে পাড়তে পারল না শিম্পাঞ্জিটি। কোহলার বাইরে থেকে এগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। খাঁচার ভিতর কতকগুলি প্যাকিং বাক্স রাখা ছিল। ভিতরে থাকা শিম্পাজিগুলির মধ্যে একজন বাক্সগুলি জড়াে করে উপরে দাঁড়িয়ে হাত পাওয়ার চেষ্টা করছিল। অবশেষে সেই পদ্ধতিতে শিম্পাঞ্জিটি সফল হল।

সুলতানকে নিয়ে পরীক্ষা: সুলতান নামে বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জিকে নিয়েও কোহলার এই পরীক্ষাটি করেন। খাঁচার মাথার দিকে নাগালের বাইরে কলার কাদি রাখা ছিল। সুলতান সেই খাঁচায় রাখা দুটো লাঠি একটার সঙ্গে একটা জুড়ে কলার কাদিটি পাড়তে সক্ষম হয়।

সিদ্ধান্ত: কোহলার এই পরীক্ষাগুলি থেকে সিদ্ধান্তে আসেন— 

  • সमস্যার সামগ্রিক রূপ উপলধি: প্রাণী শুধু প্রচেষ্টা ভুলের মাধ্যমে শেখে না, সমস্যামূলক পরিস্থিতির সামগ্রিক রূপ উপলব্ধি করে তা সমাধানের চেষ্টা করে।
  • হঠাৎ করে প্রত্যক্ষণ: সমস্যাটি সামগ্রিকভাবে উপলব্ধির পর হঠাৎ করে সমাধানের উপায় উপলদ্ধি করে, যাকে বলা হয় অন্তদৃষ্টি।
  • খণ্ড হিসাব প্রত্যক্ষণ না কার সমগ্রভাবে প্রত্যস্থণ: প্রাণী বিষয়টিকে সমগ্রভাবে দেখার চেষ্টা করে, বিভিন্ন বস্তু যাদের  মধ্যে সাদৃশ্য আছে তাদেরকে সমগ্র হিসেবে দেখে।