মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্বের কথা লেখক এখানে ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতবর্ষে বিজ্ঞানশিক্ষা উন্নতদেশের বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতির তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এদেশের ছাত্ররা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছে। এদেশের পরীক্ষার বার্ষিক ফলাফলের তালিকায় ছাত্রদের বৈকল্য দেখে জাতীয় প্রয়াসের ও যুবশক্তির বিপুল অপচয় সূচিত করে। এইজন্য চাই মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার আয়োজন। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া বিষয়গত জ্ঞানের গভীরতা আসে না। তাই পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞান-গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে ইংরেজি গ্রন্থের সাহায্য চাই। এক্ষেত্রে পরিভাষার প্রয়োজন প্রচুর। বৈজ্ঞানিক পরিভাষার প্রাচুর্য ছাড়া বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা সম্ভব নয়। তাই অনেকে মনে করেন, ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই ইংরেজি টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবকে লেখক অভিনন্দন, জানান। এ ব্যাপারে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি খুব বাস্তবসম্মত। বিজ্ঞান শিক্ষার চর্চার ক্ষেত্রে লেখক আদর্শবাদী নন। তিনি ব্যাবহারিক বুদ্ধিতে বিশ্বাসী। এদেশের ভারতীয় ভাষার শব্দ ভাণ্ডার সীমিত। পৃথিবীর সব ভাষার মতো শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় বহিরাগত শব্দ-সম্পদ দিয়ে। সেক্ষেত্রে বিদেশি গ্রন্থ থেকে ঋণ করা শব্দগুলো যদি শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য হয়, সেই শব্দগুলো ধার করা শব্দ হিসেবে ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। জাতীয় শব্দভাণ্ডার এইভাবেই সমৃদ্ধ হবে। ভাষার ইতিহাস নদীর মতো। নদী যেমন নানা পথে ঘোরে, নানা শাখানদী সৃষ্টি করে, নানাদিক থেকে ধারা নিয়ে আসে, ভাষাও তেমনি পরিবর্তনের স্রোতে এগোতে এগোতে নানা ভাষার শব্দ ও বাক্য গ্রহণ করে। তাদের ঋণ হিসেবে ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে। এইজন্য বিদেশি উৎস থেকে উদ্ভূত শব্দ সমস্ত ভারতীয় ভাষাতেই চালু আছে এবং সেগুলি সাধারণ মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য হয়ে উঠবে। বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির সাথে সাথে এদেশের লোকরা যেসব নতুন শব্দ ব্যবহার করবেন, তা প্রচলিত হবে এবং ভাষাও সমৃদ্ধ হবে। এইভাবে ধার করা শব্দ ব্যবহার করে বিজ্ঞানচর্চা যথেষ্ট উন্নত হবে।
বৈজ্ঞানিক শব্দের তর্জমা অনেকক্ষেত্রে মনে হয় পণ্ডশ্রম মাত্র। কারণ রেলওয়ে, রেস্তরাঁ, কিলোগ্রাম, সেন্টিমিটার, হুইল, বয়লার, কাটার, ইলেকট্রন, অ্যাটম, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ডিফারেনশিয়াল কোইফিসিয়ান্ট, ইন্টিগ্রেশন-এসব শব্দ এখন বহুলপ্রচলিত ও সকলেরই বোধগম্য। পেপার, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি এখন নিত্যব্যবহার্য শব্দাবলি। এগুলি বাংলাভাষার ভাণ্ডারে স্থায়ীভাবে গৃহীত হয়েছে। এবং লেখা ও কথাবার্তায় সহজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ভাষার প্রাণশক্তির জোরেই অন্য দেশের শব্দকে ভাষার মধ্যে আত্মস্থ করা হয়েছে। এই কারণে লেখক মনে করেন শিক্ষণের সময় ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকের দায়িত্ব হবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কাজে ভাষা প্রয়োগের এই দৃষ্টান্তকে কাজে লাগানো। বর্তমান যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া শিক্ষকের পক্ষে প্রয়োজন।
বিজ্ঞান চর্চার আবশ্যিক ক্ষেত্র আলোচনাচক্র বা বিতর্কসভা। সেক্ষেত্রে শব্দের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। শব্দ সেক্ষেত্রে হাতিয়ার হয়ে দেখা দেয়। এইসব আলোচনা প্রায়ই প্রতিপক্ষের সঙ্গে হয়। প্রতিপক্ষের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নেমে শব্দের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে কাহিল করতে শব্দবাণের প্রয়োজন সর্বাধিক। সেক্ষেত্রে শব্দচয়ন বা শব্দব্যবহারের গুরুত্ব অসাধারণ। বিতর্কসভাতে বিজ্ঞানী যখন নিজের মতামতের সমর্থন পান তখন তিনি বিজয়ীর সম্মান লাভ করেন। বিজ্ঞানীরা নিজস্ব মতামতের যাথার্থ্য যাচাই করতে পারেন কেবলমাত্র শব্দপ্রয়োগের গুণে। এই কারণে শব্দব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আগ্রহ, বিচারবুদ্ধি ও সচেতনতা না থাকলে বিজ্ঞানচর্চার উৎকর্ষ নির্দিষ্ট হয় না।
Leave a comment