‘জন্মচিহ্ন’ বলতে লেখক বুঝিয়েছেন যে মধ্যযুগের সাহিত্যে সে যুগের চিহ্ন এবং আধুনিক যুগের সাহিত্যে একালের চিহ্ন থাকবেই। পূর্বকালের কবি ভারতচন্দ্রের রচনায় যতই লিপি কুশলতা থাক, তা’ যে-কোনো আধুনিক কবির নয় কিংবা নজরুলের কবিতা যে মধুসূদন রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের আগে কিছুতেই লেখা হতে পারতো না, তা’ আমরা বুঝতে পারি। আবার কর্ণ ও কুন্তীর সাক্ষাৎকারের বিবরণ মহাভারতেও আছে রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদে’ও আছে ; বিষয় একই, অথচ আমরা বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ ‘কর্ণকুম্ভ সংবাদ’ লিখতে পারতেন না। তার কারণ, প্রকৃত লেখায় ফুটে ওঠে ‘যুগধর্ম তথা পরিবেশ ধর্ম’, যাতে লেখকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।

এই ‘চিহ্ন’ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়, ‘পরিবেশ ধর্ম, যাতে থাকে পারিপার্শ্বিকের ছাপ, তার দুটি দিক—একটি ‘বিষয় বস্তু’ বা content অপরটি ‘প্রকাশ’ অর্থাৎ ‘রূপায়ণ’ তথা form। এ দুটির যথাযোগ্য সুসঙ্গত মিলনেই গড়ে ওঠে সাহিত্য রূপ অখণ্ড সৃষ্টি। একটা মোটা হিসেবে বলা যায়, দেহ ও মনের যথাযথ সংযোগে যেমন গড়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ। দেহ ও মনকে যেমন বিচ্ছিন্ন করা যায় না, বিষয়বস্তু ও প্রকাশ-কলারও তেমনি দ্বৈত অস্তিত্ব অস্বাভাবিক। ‘শকুন্তলা’র কথাবস্তু মহাভারতে ও কালিদাসে প্রায় এক, কিন্তু ভাব-বস্তুতে পৃথক। অনেক সময় কথাবস্তু পৃথক হলেও ভাব-বস্তু এক হতে পারে। এই ভাব-বস্তুই হল আইডিয়া, বাণী বা message। সৃষ্টিতে এটি রূপায়িত হলে তা সত্য হয়ে ওঠে। অতএব প্রকাশ বা রূপায়ণের মধ্য দিয়েই প্রকাশ ঘটে সত্যের। কেউ কেউ আবার রূপকলা বা প্রকাশ কলাকেই সৃষ্টির আসল রহস্য মনে করে সাহিত্যকে শুধু আর্ট জ্ঞান করেন। রূপকলার বিশ্লেষণে রীতি বা স্টাইল, আঙ্গিক বা টেকনিক, অলংকার ইত্যাদি নানা দিক রয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য সমালোচকেরা ‘রসশাস্ত্রে’র আলোচনায় ভাববস্তুকে যেমন বিশ্লেষণ করেছেন অলংকার শাস্ত্র নিয়েও তেমনি যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। এতে সাহিত্যের সত্য খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় সাহিত্যের সত্য মূল ধরা পড়ে না। দেহ-মনের বিচিত্র লীলাতেই যেমন জীবন, সাহিত্যও তেমনি ভাব ও রূপের মিলন।

রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একস্থানে লিখেছেন, “আধুনিকতার যদি কোনো তত্ত্ব থাকে তবে সেই তত্ত্বকে নৈর্ব্যক্তিক আখ্যা দেওয়া যায়, তবে বলতেই হবে, বিশ্বের প্রতি এই উদ্ধত অবিশ্বাস ও কুৎসার দৃষ্টি এ-ও একটা মোহ, এর সঙ্গেও নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তুবকে সহজভাবে গ্রহণ করার গভীরতা নেই।” প্রাচীনকালে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, সে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র। তার মধ্যে মানবীয় চেতনা সৃষ্টি হয়েছে, মানুষের মর্যাদা বিষয়েও একটা সীমাবদ্ধ ধারণা তার গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মানুষের মূল্যবোধ-সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ভাবে সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি, কাজেই সে নিজেকে দেবতার ক্রীড়নক হিসেবেই দেখেছে। তাই মানুষের নামেও কীর্তিত হয়েছে দেবতা মাহাত্ম্য। সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে আমরা দেবতা আর ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছি। তাই চণ্ডীদাসের ‘সবার উপর মানুষ সত্য যে মানুষ সেও আধ্যাত্মিক মানুষ, মর জগতের আধিভৌতিক মানুষ নয়। তুলনামূলক ভাবে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য ছিল অনেক আধুনিক। তাদের জীবনযাত্রা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশ ছিল অনেক উন্নত, তাদের মানবতাবাদ সাহিত্যে অনেকটাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার বুনিয়াদ অনেকটা আধুনিক কালেরই যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ ছিল। প্রাচীন চিনেও কনফুসীয় যুগ থেকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজবোধে স্থান পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে চিনে মানুষের মূল্য, ব্যক্তিত্বের ও গণতন্ত্রের স্ফুরণ আর বিশেষ ঘটল না। ফলত চিনের সমাজও অনড় হয়ে রইল। মধ্য যুগটা পৃথিবীর সর্বত্রই অন্ধকারাচ্ছন্ন যেমন য়ুরোপ, তেমনি চিন, তেমনি ভারত। প্রাচীনযুগে মানবতাবাদের যে অস্ফুট প্রকাশ সর্বত্র লক্ষ করা গিয়েছিল, মধ্যযুগে কোথাও তা’ এক পা এগুতে পারেনি ; বরং নানাদিক থেকে তা কিছুটা পিছিয়েই পড়েছিল।

দীর্ঘকাল পরে আবার গ্রিক চিন্তাজগতের পুনরাবিষ্কার-চেষ্টা থেকেই শুরু হল য়ুরোপীয় রেনেসাঁস—বস্তুত এটিকেই আমরা আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে গ্রহণ করতে পারি। প্রাচীন যুগের মানবতাবোধের ঐতিহাসিক পরিণতি রূপেই এর উদ্ভব। তবে প্রাচীন মানবতাবোধের সঙ্গে এর যে পার্থক্য, তা পরিমাণগত নয়, গুণগত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে, ‘আধ্যাত্মিক মানুষের’ কাল গত হল; মানুষের মানবতাবোধ, এইবার যথোপযুক্ত স্বীকৃতি লাভ করল। আধুনিকতার প্রথম সোপান এইটিই। এরপরই ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি নিয়ে চিন্তা জগতে তুমুল আলোড়ন চলছিল। তারপরই ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লবের পর সর্বজনস্বীকৃত রূপে ‘মানুষকে অধিকার’ ঘোষণায় মানবতাবাদ আর একধাপ এগিয়ে এল। মানুষের চিন্তা ধারায় যখন বাঁক ফেরে সমকালীন সাহিত্যেও তার চিহ্ন থেকে যায়। প্রোমিথিউস আনবাউন্ডে’র মধ্য দিয়ে কবি যে ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, একসময় সেই স্বপ্নভঙ্গের দুঃখও মানুষকে সইতে হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিকতার পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্বপ্নলোকে পাড়ি দিয়েছে। এল টেনিসন-আর্নল্ডদের যুগ ; ওদিকে হুইটম্যান আর এদিকে ব্রাউনিং-এর আশাবাদ। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, শোনা গেল ‘ওয়েস্টল্যান্ডের’ বিলাপ। কিন্তু পৃথিবী তো থমকে থাকেনি। একসময় হতাশার কালও শেষ হল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে রুশ বিপ্লবের ফলে আধুনিকতার তৃতীয় পর্ব সূচিত হল। ফরাসি বিপ্লবে ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের আবশ্যিকতাও স্বীকৃত হয়েছিল। এই দাবি মেটানোর জন্যই প্রয়োজন দেখা দিল শোষণতন্ত্রের অবসানের। রুশ বিপ্লবে স্বীকৃত হল মানুষও বিপ্লবী শক্তি, কারণ মানুষ সৃষ্টিকর্মী। সে নিয়তি-তাড়িত নয়, আপনার ভাগ্য সে আপনি গড়ে নিতে পারে। মানুষের এই ক্রমিক আধুনিকতায় উত্তরণ-চিহ্ন রয়ে গেছে যুগে যুগে সাহিত্যের বুকে। এখন আধুনিক সাহিত্য মানুষের এই স্বীকৃতি, এই মানবসত্য ও ব্যক্তি মহিমার্কে প্রকাশ করতে পেরেছে যে তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করে না দেখলে বোঝা যাবে না।