ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

মানুষের জ্ঞানচর্চার উষালগ্ন থেকেই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের সূচনা। বিদ্যা দান ও বিদ্যা গ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে এই নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষক ছাত্রদের সামনে যে জ্ঞান-প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন তারই আলােতে ছাত্র খুঁজে পায় নতুন জীবনের ঠিকানা । শিক্ষকের অকৃত্রিম ভালােবাসায় আর ছাত্রের অপরিসীম শ্রদ্ধায় এই পবিত্র সম্পর্ক অনাবিল সৌন্দর্যে বিকশিত হতে থাকে। পিতা-মাতার ঔরসজাত সন্তানটিকে মানুষের মতাে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে শিক্ষক মাতা-পিতার মর্যাদায় আসীন হন। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক দিলেন। জ্ঞানদানের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রের জীবনের বিকাশসাধন করার পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্বেরও জাগরণ ঘটিয়ে থাকেন। অন্যদিকে পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী শিক্ষার্থী প্রচণ্ড কৌতূহলে মেটাতে শিক্ষকের কাছ থেকে পেতে পারে মনের খােরাক। ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্ক আবহমান কাল ধরে চলছে। অতীতে শিষ্যরা গুরুগৃহে অবস্থান করে বিদ্যার্জনের পাঠ গ্রহণ করত এবং পাঠ শেষে গুরুদক্ষিণা দিয়ে নিজগৃহে ফিরে আসত। প্রাচীন ভারতে ও গ্রিসে ছাত্র-শিক্ষকের এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। বর্তমানে বাউল ও সুফি সাধনায় গুরু-শিষ্য সম্পর্কটি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে পরস্পরনির্ভর ও সৌহার্দমূলক সম্পর্ক হিসাবে বিচার করেছেন। অথচ আজ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেকটা তিক্ততায় পর্যবসিত । ছাত্র-শিক্ষকের সেই মধুর সম্পর্কে চিড় ধরেছে। সময়ের পালাবদলে মানুষের মন মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার বহুমুখী বিপণনে ব্যস্ত ছাত্র ও শিক্ষক। এরূপ বাজার-ব্যবস্থায় শিক্ষক বিক্রেতা আর ছাত্র আজ ক্রেতার ভূমিকায় নেমেছে। নামি-দামি শিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জন করতে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে যাদের আর্থিক সঙ্গতি কম সে ধরনের অভিভাবকের সন্তানরা এ সুযােগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নামে বেনামে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের কোচিং সেন্টার। এদের বাহারি বিজ্ঞাপনে শিক্ষকের প্রকৃত আদর্শ হারিয়ে কতিপয় ক্ষেত্রে শিক্ষক এখন মুনাফাখাের। বৈশ্বিক চাহিদায় কিছু কিছু শিক্ষক নামধারী বিবেকহীনের মতাে পরীক্ষার হলে ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছে এবং দিচ্ছে বাড়তি সুযােগ । অন্যদিকে কতিপয় ছাত্র শিক্ষককে কেনা গােলামের মতাে ভাবছে। কখনাে কখনাে পরীক্ষার হলে সুযােগ-সুবিধা না দিলে ছাত্রের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছে। রাজনীতির ছত্রছায়ায় কিছু ছাত্ৰনামধারী সন্ত্রাসী যেমন পবিত্র শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে তেমন পরম গুরুজন শিক্ষককে অপমান করতেও দ্বিধা করছে না। জাতির জীবনে এই অমানিশার ঘাের কাটতে আর কত দেরি? ছাত্রজীবনের যথার্থ বিকাশের প্রয়ােজনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি এখনই ঘটাতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ আয়ােজনে শিক্ষাঙ্গনকে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের সত্যিকারের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে । রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের সুসস্পর্কের মধ্য দিয়েই নির্মিত হবে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।