অনুচিত প্রভাব (Undue influence): চুক্তি আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী চুক্তিভুক্ত পক্ষের মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের কারণে এক পক্ষ যদি অপর পক্ষের ইচ্ছাকে অহেতুক প্রভাবিত করতে পারে এবং এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে সে পক্ষ কোন সুবিধা আদায় করে, তবে সে চুক্তিটি অনুচিত প্রভাব বলে সম্পাদিত হয়েছে বলে ধরা যায়। এ ধারা মতে নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির উপর অনুচিত প্রভাব বিস্তার করতে পারে-
(১) উক্ত ব্যক্তি যদি অপর ব্যক্তিটির উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্তৃত্ব খাটানোর অবস্থায় থাকে অথবা যেখানে অপর পক্ষের সাথে তার বিশ্বাসমূলক সম্পর্ক (fiduciary relation) বিদ্যমান থাকে। অথবা,
(২) অপর ব্যক্তি যদি বার্ধক্য, পীড়া বা অন্য কোন কারণে এরূপভাবে শারীরিক বা মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, যাতে তার স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য সাময়িকভাবে বা চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায়।
উপরোক্ত সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত উপাদানগুলি লক্ষ্য করা যায়-
(১) পক্ষসমূহের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান।
(২) এরূপ সম্পর্কের ফলে এক পক্ষ অপর পক্ষের মতামতকে প্রভাবিত করতে সমর্থ।
(৩) এরূপ অবস্থার সুযোগে প্রভাব বিস্তারকারী পক্ষ অহেতুক সুবিধা লাভ করেছে।
অনুচিত প্রভাবের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ সমানাধিকারের ভিত্তিতে চুক্তির শর্ত সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে না এবং স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারে না।
কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে এরূপ অনুচিত প্রভাব বিস্তার করার আশঙ্কা রয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব নয় । তবে কতকগুলি বিশেষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরূপ প্রভাব অনুমিত হয়ে থাকে। এগুলি হচ্ছে পাওনাদার ও খাতক, অভিভাবক ও তার রক্ষণাধীন ব্যক্তি, শিক্ষক ও তার ছাত্র, আইনজীবি ও তার মক্কেল, মালিক ও তার প্রতিনিধি, চিকিৎসক ও তার রোগী, পিতা বা মাতা ও তার সন্তান, ধর্মীয় উপদেষ্টা ও তার অনুসারী,স্বামী ও স্ত্রী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী, এ সকল বিশেষ সম্পর্কের কারণে যদি অনুচিত প্রভাব অনুমিত হয়ে থাকে, তাহলে যার প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা আছে, তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে, সে কোন প্রকার অনুচিত প্রভাব বিস্তার করে নাই। কিন্তু যে ক্ষেত্রে এরূপ প্রভাব বিস্তারের কোন বৈধ অনুমান নেই সেক্ষেত্রে অনুচিত প্রভাব প্রভাবের অভিযোগকারীর উপরই তা প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায়।
বলপ্রয়োগ ও অনুচিত প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য (Distinction between coercion and undue influence):
(১) বলপ্রয়োগে যে পন্থায় একটি পক্ষের সম্মতি আদায় করা হয় তা অনুভবযোগ্য। এটা হয় শক্তি প্রয়োগ বা প্রয়োগের হুমকি, কিংবা আটক বা আটকের হুমকি। কিন্তু অনুচিত প্রভাবের একটি পক্ষকে যেভাবে চুক্তি করতে প্রবৃত্ত করা হয় তা তত সুস্পষ্ট নয়। এখানে শক্তি প্রয়োগও থাকে না কিংবা কিছুর হুমকিও থাকে না। তবুও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার মতো পরিস্থিতিতে সে পক্ষ অবস্থান করে না৷
(২) বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষগণের মধ্যে পূর্ব হতেই কোন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে না। কিন্তু অনুচিত প্রভাবের ক্ষেত্রে পূর্ব হতেই তাদের মধ্যে এক প্রকার সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে।
(৩) বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তি বাতিল করতে চাইলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে প্রমাণ করতে হয় কিভাবে অপর পক্ষ তার উপর বলপ্রয়োগ করেছে। পক্ষান্তরে, অনুচিত প্রভাবের ক্ষেত্রে যে সকল সম্পর্কের দরুন অনুচিত প্রভাব অনুমিত হয়ে থাকে, সে সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারীকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার করে সুবিধা গ্রহণ করে নাই। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের উপর প্রমাণের দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকেই প্রমাণ করতে হবে অপর পক্ষ কিভাবে তার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
(৪) বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন প্রকার চাপ বা ভীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ স্বাধীনভাবে তার মনোভাব ব্যক্ত করতে পারে না। অপর পক্ষে, অনুচিত প্রভাবের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের উপর এমনভাবে অনুচিত প্রভাব বিস্তার করা হয় যে, সমতার ভিত্তিতে চুক্তির জন্য আলোচনা করা তার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে৷
(৫) আইনের চোখে অনুচিত প্রভাব বলে প্রতীয়মান হলে তাকে বলপ্রয়োগ বলেও গণ্য করা যেতে পারে।
Leave a comment