(১) বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology): বিশ্বতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Cosmology’ শব্দটি গ্রিক Kosmos থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘Kosmos’ শব্দটির অর্থ সুশৃঙ্খল বিশ্বজগৎ। দর্শনের এই শাখায় বিশ্বজগতের পরিদৃশ্যমান দিকের অনুসন্ধান করা হয়। দর্শনের এই শাখা রূপবিজ্ঞান বা জগৎদর্শন নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকে। বিশ্বজগৎ দেশ-কাল, জড় , প্রাণ, বিশ্বজগতের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ, অর্থাৎ সৃষ্টি, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে এ শাখায় আলােচনা করা হয়।

(২) তত্ত্ববিদ্যা (Ontology): অনেকে তত্ত্ববিদ্যাকে দর্শনের প্রাণস্পন্দন বলে আখ্যায়িত করেন। বিশ্বজগতের প্রকৃত সত্তাসম্পর্কীয় আলােচনাকেই সাধারণত তত্ত্ববিদ্যা বলা হয়ে থাকে। Ontology শব্দটি গ্রিক শব্দ Ontos এবং Logos থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘Ontos’ শব্দটির অর্থ সত্তা এবং ‘Logos’ শব্দটির অর্থ বিজ্ঞান। তাই Ontology অর্থ হচ্ছে সত্তাসম্পর্কীয় বিজ্ঞান।

(৩) মনােদর্শন (Philosophy of mind): মনােদর্শনে প্রধানত মন বা আত্মার স্বরূপ, দেহ ও মনের সম্পর্ক, ইচ্ছার স্বাধীনতা ও আত্মার অমরত্ম নিয়ে আলােচনা করা হয়। মনােদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের একটি বিশিষ্ট শাখা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

(৪) জ্ঞানবিদ্যা (Epistomology): দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বা বিভাগ হলাে জ্ঞানবিদ্যা। দর্শনের যে শাখায় জ্ঞানের উৎপত্তি, সীমা, যথার্থতা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে আলােচনা করা হয় তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা। দর্শন জীব, জগৎ ও ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আলােচনা করে। কিন্তু তার আগে দার্শনিককে এরূপ জ্ঞানলাভের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বিচার করে দেখতে হবে। জ্ঞানের উৎস কী, জ্ঞান লাভের উপায় কী, কতটুকু জ্ঞানলাভ সম্ভব, জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয়, যথার্থ জ্ঞানের শর্ত কী কী, জ্ঞানের । সীমা কতদূর, জ্ঞানের সত্য-মিথ্যা কিভাবে নিরূপণ করা যায়- জ্ঞানবিদ্যা জ্ঞানসম্পর্কিত এ রকম প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করে।

(৫) মূল্যবিদ্যা বা মূল্যসম্পর্কিত দর্শন (Axiology): মানবসভ্যতার ইতিহাসে দর্শনের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি আলােচনা করলে দেখা যায় যে, দর্শনের অন্যতম কাজ হচ্ছে মানবসভ্যতার প্রকৃত মঙ্গলের পথ নির্দেশ করা। আর সে হিসেবে বিশ্বতত্ত্ব, তত্ত্ববিদ্যা, মনােদর্শন, জ্ঞানবিদ্যার চুলচেরা আলােচনা এবং সাম্প্রতিককালের ভাষা বিশ্লেষণকারীদের যৌক্তিক বিশ্লেষণপদ্ধতি সবই ক্ষুন্ন হবে। যদি না এ আলােচনার সাথে মূল্যসম্পর্কিত দার্শনিক আলােচনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই দর্শনের আরেকটি প্রধান শাখা হচ্ছে মূল্যবিদ্যা বা মূলসম্পর্কিত দর্শন। ধর্মীয় মূল্য, নৈতিক মূল্য, সৌন্দর্যগত মূল্য ইত্যাদি মূল্য নিয়ে মূল্যবিদ্যায় আলােচনা করা হয়।

আধিবিদ্যা ছাড়া কি ভালাে দর্শন সম্ভবঃ অধিবিদ্যা ছাড়া ভালাে দর্শন সম্ভব কি না, অথবা অধিবিদ্যার সাথে দর্শনের সম্পর্ক কী- এসব প্রশ্নের উত্তর চট করে দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বিস্তারিত আলােচনা দরকার। দর্শন হলাে জগৎ ও জীবনের সামগ্রিক আলােচনা। বিজ্ঞানের আলােচনার পদ্ধতির মতাে দর্শন প্রকৃতির কোনাে সুনির্দিষ্ট বিভাগ নিয়ে আলােচনা করে না, বরং দর্শন হচ্ছে জগৎ ও জীবনের অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গি।

দর্শন ও অধিবিদ্যার সম্পর্কঃ দর্শন ও অধিবিদ্যার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দর্শন ও অধিবিদ্যার সম্পর্ক আলােচনা করলে এদের মধ্যে কতগুলাে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

সাদৃশ্যঃ তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা মূলত বিশ্বজগতের মূল উপাদান বা সত্তাসম্পর্কীয় সমস্যা নিয়ে আলােচনা করে। বস্তুজগতে দু’টি রূপ আছে; যথা- ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা অবসিক এবং অতীন্দ্রিয়। বস্তুর অবসিক রূপ হলাে সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই সতত পরিবর্তনশীল অবসিক রূপের আড়ালে অতীন্দ্রিয় রূপ বিরাজ করে, যা হলাে অপরিবর্তনীয় সত্তা। এই অপরিবর্তনীয় সত্তাকে অস্বীকার করলে বস্তুর অবসিক রূপের পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। প্লেটো, এরিস্টটল, হেগেল, ব্রাডলি প্রমুখ দার্শনিক বস্তুর এই অতীন্দ্রিয় রূপ বা অপরিবর্তনীয় সত্তার ওপর বিশেষ জোর দেয়ার ফলেই বলেন যে, দর্শনের প্রধান কাজ তত্ত্বজ্ঞান দেওয়া। প্লেটো তার দর্শনে দু’টি জগতের কথা বলেন- একটি হলাে দৃশ্যমান জগৎ এবং অপরটি ভাব বা ধারণার জগৎ। তার মতে, দৃশ্যমান জগৎ ধারণার জগতের প্রতিরূপ বা অনুলিপি মাত্র এবং এই জগতের বিভিন্ন বস্তু ধারণার জগতের কতগুলাে ধারণার অনুলিপি মাত্র। প্লেটোর মতে, দর্শন ও অধিবিদ্যা অভিন্ন। সম্প্রতিককালের দার্শনিক আলেকজান্ডারও দর্শন ও অধিবিদ্যাকে অভিন্ন মনে করেন।

অধিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে বৈসাদৃশ্যঃ দর্শন ও অধিবিদ্যার মধ্যে সাদৃশ্যের পাশাপাশি কিছু বৈসাদৃশ্যও . পরিলক্ষিত হয়; যেমন-

(১) দর্শনের আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থ হলাে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা সত্যের প্রতি অনুরাগ। এদিক থেকে দর্শন যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, সৌন্দর্যবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ইত্যাদি বিদ্যা বা শাখা নিয়ে আলােচনা করে। অন্যদিকে অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা হলাে দর্শনের এমন একটি পর্ব যেখানে সত্তাসম্পৰ্কীয় সমস্যা নিয়ে আলােচনা করা হয়।

(২) অভিজ্ঞতাবাদী, প্রত্যক্ষবাদী এবং যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিকরা অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্ব বা সত্যতাকে স্বীকার করেন না। তাদের মুখ্য বক্তব্য হলাে, যা কিছু প্রত্যক্ষ করা যায় তা-ই সত্য, অতীন্দ্রিয় সত্তা প্রত্যক্ষ্যের বিষয় নয়। তাই এর আলােচনা নিরর্থক। সুতরাং দর্শনের কাজ দৃশ্যমান এবং জগতের অভিজ্ঞতার আলােচনা করা। অন্যদিকে তত্তজ্ঞান অদশ্যমান।

(৩) দর্শনের পরিসর অধিবিদ্যার পরিসর অপেক্ষা ব্যাপক। এদিক থেকে দর্শন যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যার মত অধিবিদ্যাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

(৪) দর্শন এবং জগতের দৃশ্যমান এবং অব্যক্ত উভয় দিকের আলােচনা করে। কিন্তু অধিবিদ্যা কেবল জীবন ও জগতের অব্যক্ত দিকের আলােচনায় ব্যাপৃত।

দর্শন ও অধিবিদ্যা পরস্পর নির্ভরশীলঃ তত্ত্ববিদ্যাকে সাধারণত দুই অর্থে ব্যবহার করা হয়। যথা- সংকীর্ণ অর্থে তত্ত্ববিদ্যা সত্ত্ববিষয়ক বিদ্যা এবং ব্যাপক অর্থে তত্ত্ববিদ্যা বস্তুর মৌলিকত্ব সম্পর্কে যেকোনাে অনুধ্যানমূলক অনুসন্ধান ও তত্ত্বলােচনা। শেষােক্ত মত অনুসারে তত্ত্ববিদ্যা শুধু সত্য বা তত্ত্বকেই অনুসন্ধান করে না, বরং দর্শনের সব বিভাগেরই অর্থাৎ সত্তা, জ্ঞান, সত্য, মূল্য ইত্যাদি নিয়েও আলােচনা করে। এ হিসেবে দর্শন ও অধিবিদ্যাকে অভিন্ন করা যেতে পারে। আবার অন্যদিক থেকে তত্ত্ববিদ্যাকে দর্শনের মধ্যপর্ব বলা যায়, যার প্রথম পর্ব জ্ঞানবিদ্যা এবং শেষপর্ব নীতিবিদ্যা ও সৌন্দর্যবিদা। সুতরাং দর্শন ও অধিবিদ্যার সম্পর্ক খুবই নিবিড়। কিন্তু তাই বলে দর্শন ও জ্ঞানবিদ্যাকে এক মনে করা যক্তিযুক্ত নয়। তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা মনে করে আমরা এটুকুই বলতে পারি যে, দার্শনিক আলােচনার মূলেই জ্ঞানবিদ্যার আলােচনা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আপাতঃদৃষ্টিতে অধিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অধিবিদ্যা দর্শনের একটি শাখা। তা ছাড়া অধিবিদ্যার ব্যাখ্যা একমাত্র দর্শনের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব, অন্য কোনাে বিজ্ঞানের মাধ্যমে নয়। সুতরাং অধিবিদ্যা ছাড়া দর্শন অলােচনা ডানাবিহীন পাখির মতাে অবস্থা।