আর্থনীতিক ব্যাখ্যা: অধিকার সম্পর্কে মার্কসবাদীদের ধারণা স্বতন্ত্র। তাঁদের মতে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে স্বার্থের সংঘাত থাকে এবং এই সংঘাত অধিকারের প্রশ্নে বিতর্ক ও বিরোধের সৃষ্টি করে। নাগরিকগণ কেবল রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত অধিকারই আইনসঙ্গতভাবে ভোগ করতে পারে। ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র সব সময় আর্থিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থের ধারক ও বাহক হিসাবে কাজ করে। এ রকম সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র সমাজের সকলের স্বার্থ বা অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না। অথচ তত্ত্বগত বিচারে সমাজে সমষ্টির অধিকার সম্ভব হলেই অধিকার সার্থক হতে পারে, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মুনাফা অর্জনের সুযোগ স্বীকৃত এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার একটি পবিত্র অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। সমাজের সকলের সমান অধিকার এখানে অসম্ভব। কোন অধিকার সমাজনিরপেক্ষভাবে রক্ষা করা যায় না। আর মানুষের অধিকারের সীমা আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। সমাজের ধনবৈষম্যের মাত্রার সঙ্গে সমষ্টির অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে রাষ্ট্রের ক্ষমতার আনুপাতিক সম্পর্ক বর্তমান। সমাজে ধনবৈষম্য যতটা হ্রাস পাবে সমষ্টির অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। কেবল ধনবৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থায় সকলের অধিকার সার্থক ও সুনিশ্চিত হবে।
আর্থনীতিক কাঠামোর বিন্যাস অনুসারে অধিকার: অধিকার সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদে আর্থনীতিক অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। বস্তুত আর্থনীতিক অধিকারের মধ্যেই অধিকারের মার্কসীয় মতবাদের মূল নিহিত আছে। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে চূড়ান্ত বিচারে আর্থনীতিক অধিকার অন্যান্য অধিকারের নিয়ন্ত্রক ও নির্ধারক হিসাবে কাজ করে। প্রকৃত প্রস্তাবে আর্থনীতিক অধিকার ব্যতিরেকে অন্যান্য অধিকার অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। আবার সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক ও আর্থনীতিক কাঠামোর উপর আর্থনীতিক অধিকার নির্ভরশীল। সমাজের সমকালীন আর্থনীতিক কাঠামোর বিন্যাস ও সাংস্কৃতিক বিকাশের স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে অধিকারের ধারণা গড়ে উঠে। অর্থাৎ অধিকারের ধারণা সমকালীন সমাজের আর্থনীতিক কাঠামোর বিন্যাস ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির থেকে অগ্রবর্তী বা পশ্চাদবর্তী হতে পারে না; সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে আর্থনীতিক কাঠামোর বিন্যাসে অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও অধিকারের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। এই কারণে বলা হয় যে অধিকার কোন কাল্পনিক বিষয় বা বিমূর্ত ধারণা নয়।
আর্থনীতিক অবস্থান ও সম্পর্কের দ্বারা অধিকার নির্ধারিত হয়: অন্যান্য সকল অধিকারের ভিত্তিই হল আর্থনীতিক অধিকার। যাদের হাতে আর্থনীতিক অধিকার থাকে তারা অন্যান্য অধিকারও ভোগ করতে পারে। যাদের হাতে এই অধিকার থাকে না তারা অন্যান্য অধিকারও ভোগ করতে পারে না। মানুষের সামাজিক অবস্থানের মানদণ্ড হল তার আর্থনীতিক অবস্থান। তেমনি সামাজিক সম্পর্কেরও মানদণ্ড হল আর্থনীতিক সম্পর্ক। অনুরূপভাবে আর্থনীতিক অবস্থান ও সম্পর্কের দ্বারা অধিকারের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। শ্রেণী-বৈষম্যমূলক সমাজে উৎপাদনের মালিক শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণী পরিলক্ষিত হয়। মালিক শ্রেণীর হাতেই থাকে উৎপাদনের যাবতীয় উপাদানের মালিকানা। এই মালিকানা থেকে শ্রমিক শ্রেণী বঞ্চিত। তাই জীবনধারণের জন্য শ্রমিক শ্রেণীকে মালিক শ্রেণীর কাছে তাদের শ্রম বিক্রয় করতে হয়। এটা করতে তারা বাধ্য। এই মেহনতী মানুষের দল হল মজুরির ক্রীতদাস। উৎপাদনের উপাদানের মালিকানা তাদের হাতে নেই। তাদের আর্থনীতিক অধিকার নেই। এবং এই কারণে তাদের অন্যান্য সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারও থাকে না।
সমাজের আর্থনীতিক প্রকৃতির সঙ্গে অধিকারের স্বরূপ গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। কোন বিশেষ সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সমাজব্যবস্থায় অধিকারের চরিত্র নির্ধারিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজের আর্থনীতিক অবস্থার সঙ্গে অধিকারের চরিত্র ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। সমাজের আর্থনীতিক কাঠামোর বিন্যাস পরিবর্তিত হলে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে অধিকারের প্রকৃতিরও পরিবর্তন সাধিত হয়।
বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় অধিকারের প্রকৃতি: শ্রেণী-বৈষম্যমূলক বিভিন্ন সমাজে অধিকারের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। দাস-সমাজব্যবস্থায় এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অধিকারের অর্থ হল যথাক্রমে দাস-মালিক ও ভূস্বামীদের অধিকার। এই দুই শ্রেণীর অধিকার হল শোষণমূলক। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন-উপকরণের মালিকানা কেন্দ্রীভূত থাকে পুঁজিপতিদের হাতে। পুঁজিপতিরা বিদ্যমান আর্থনীতিক সম্পর্ক সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে। এর উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক এবং সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিপতিদের সম্পত্তির অধিকার অটুট রাখা। পুঁজিপতি শ্রেণী বিদ্যমান আর্থনীতিক কাঠামোর বিন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে সামাজিক ও রাজনীতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকারের ধারণা গড়ে তোলা হয়। এই ধরনের সমাজব্যবস্থায় যথার্থ আর্থনীতিক অধিকারকে স্বীকার করা হয় না। তা ছাড়া সার্বিক বিচারে এই অধিকার আর্থ-রাজনীতিক প্রকৃতিরও নয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অধিকারের প্রকৃতি আলাদা। এখানে উৎপাদন-উপাদানের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রেণী-বৈষম্য ও শ্রেণী-শোষণের অবসান ঘটে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক অধিকারের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সকল অধিকার স্বীকৃত ও সুনিশ্চিত হয়।
Leave a comment