বার্কার প্রদত্ত সংজ্ঞা : বার্কার (Ernest Barker) তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে অধিকার সম্পর্কে তাঁর অভিমত বিস্তারিতভাবে ব্যক্ত করেছেন। উল্লিখিত গ্রন্থটির চতুর্থ খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে — অধিকারের প্রকৃতি ও বণ্টন নীতি’ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বার্কারের মতানুসারে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল তার সদস্যদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে বর্তমান গুণাবলীর বিকাশ সাধন করা। একে তিনি চূড়ান্ত রাজনীতিক মূল্যবোধ হিসাবেও উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইন সমাজের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সম্ভাব্য সর্বাধিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক বাহ্যিক শর্তাবলী নির্ধারণ ও সংরক্ষণ করে থাকে। এই সমস্ত নির্ধারিত ও সংরক্ষিত শর্তকে অধিকার হিসাবে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ অধিকার হল স্থিরীকৃত ও সংরক্ষিত এক বাহ্যিক পরিবেশ বা শর্তাবলী যা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিত্বের সামর্থ্যসমূহের সর্বোচ্চ বিকাশের সহায়ক। বার্কারের মতানুসারে অধিকার হল: “…the external conditions necessary for the greatest possible development of capacities of personality. These secured and guaranteed conditions are called by the name of rights.” অধ্যাপক বার্কার আরও বলেছেন যে, এই রকম শর্তাদির একটা পরিকল্পনা রাষ্ট্র প্রস্তুত করে। এবং তদনুসারে সেগুলি বণ্টনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নীতির ভিত্তিতে কাজ করে। এই নীতিগুলিকে সাধারণভাবে ও সমানভাবে প্রয়োগ করা যায়। বার্কার বলেছেন যে, ১৭৮৯ সাল থেকে এই নীতিগুলিকে স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব বলা হচ্ছে।

বৈধ ব্যক্তিত্ব: বার্কারের মতে রাষ্ট্র এবং আইন ন্যায় ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। একে তিনি বলেছেন যথার্থ ব্যবস্থা। এবং এই ব্যবস্থারই ফল হল অধিকার। বার্কার বলেছেন: “Rights in their nature are the result, and the embodiment in particular persons, of the general system of Right or Justice on which the state and its law are based.” ন্যায্য ধারণার সঙ্গে সম্পর্ক রহিত কোন অধিকার থাকতে পারে না। আইন ন্যায্য ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই আইনের থেকে বিচ্ছিন্ন কোন অধিকারকে সুনিশ্চিত বা সংরক্ষিত করা যায় না। বার্কার বলেছেন: “I cannot have rights, in any sense of the term, apart from the notion of Right, and I cannot have secured and guaranteed rights, in the legal sense of the term, apart from the law which is based…upon the notion of Right.” ব্যক্তির অধিকার-সমষ্টি রাষ্ট্রের ভিতরে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইনের অধীনে থাকে। এই অধিকার হল ব্যক্তির সমগ্র সামর্থ্য ও পদমর্যাদার প্রতিরূপ। এ হল ব্যক্তির সাধারণ ও সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বার্কার একে বলেছেন ব্যক্তির বৈধ ব্যক্তিত্ব (legal personality)।

নৈতিক ব্যক্তিত্ব: প্রত্যেক ব্যক্তির একটি নৈতিক ব্যক্তিত্ব (moral personality) আছে। এই নৈতিক ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিকে একটি বৈধ ব্যক্তিত্ব প্রদান করা হয়। আইন ব্যক্তির হাতে অধিকারসমূহ নাস্ত করে এবং আইনই তা সংরক্ষণ করে। এই সমস্ত অধিকার হল ব্যক্তির বৈধ ব্যক্তিত্ব। এই বৈধ ব্যক্তিত্ব হল নৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের পূর্ব শর্ত। অর্থাৎ ব্যক্তির নৈতিক বৈশিষ্ট্য বা সত্তাকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করার জন্য কতকগুলি অধিকার প্রদান করা হয়। নৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের জন্য নাগরিক অধিকার দাবি করতে পারে। কোন অনৈতিক কাজের জন্য অধিকার দাবি করা যায় না। সুতরাং অধিকারের একটি উৎস হল এই নৈতিক ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ বৈধ ব্যক্তিত্বের মত নৈতিক ব্যক্তিত্বও হল অধিকারের উৎস। অধ্যাপক বার্কার বৈধ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নৈতিক ব্যক্তিত্বের সংযুক্তির কথা বলেছেন। তিনি অধিকার সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে আইনের আলোচনা থেকে নৈতিকতার আলোচনায় উপনীত হয়েছেন।

অধিকারের দুটি উৎস: বার্কারের মতানুসারে আদর্শগত বিচারে অধিকার সব সময় একসঙ্গে দুটি উৎস থেকে উৎসারিত। এই দু’টি উৎসের একটি হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং আর একটি হল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন। তিনি বলেছেন: “Ideally a right will always be derived simultaneously from two sources, and will possess a double quality-(1) the source of individual personality, and the quality of being a condition of its development, (2) the source of the State and its law, and the quality of being secured and guaranteed by the action of that law.” দুটি উৎস থেকে নির্গত অধিকারের মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে। অধিকারের প্রথম উৎস হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব (individual personality)। এবং এক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য হিসাবে ব্যক্তিত্ব বিকাশের অনুকূল শর্তাদি বর্তমান থাকে। অধিকারের দ্বিতীয় উৎস হল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় আইন। এবং এ ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য হিসাবে আইনের অনুশাসনের নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা বর্তমান থাকে।

আধা-অধিকার: দুটি উৎস থেকে উৎসারিত অধিকার হল আদর্শ অধিকার। তবে অধিকার একটি উৎস থেকেও নির্গত হতে পারে। একটিমাত্র উৎস থেকে নির্গত অধিকারের মধ্যে একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে। এ রকম অধিকারকে আধা-অধিকার (quasi-right) বলা যায়। বাস্তবে এ রকম আধা-অধিকার দেখা যায়। বার্কার বলেছেন: “But in actual life we may find a sort of right, or a quasi-right’, which is derived from one source only, and possesses only one quality.” আধা-অধিকার কেবল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব অথবা কেবল রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন থেকে নির্গত হয়। বার্কার উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। যে অধিকার শুধুমাত্র ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব থেকে উৎসারিত তার মধ্যে বৈশিষ্ট্য হিসাবে বর্তমান থাকে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিকাশের অনুকূল শর্তাদি। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে দাস ভিত্তিক রাষ্ট্রের মধ্যে ক্রীতদাসের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আবার কেবলমাত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন থেকে নির্গত আধা-অধিকার দেখা যায়। এ রকম আধা-অধিকারের বৈশিষ্ট্য হিসাবে থাকে শুধুমাত্র আইনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অধিকারের সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত করণ। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে দাস-ভিত্তিক রাষ্ট্রে দাস-মালিকদের ক্রীতদাসকে সম্পত্তি হিসাবে ভোগ করার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।

অধিকার ব্যবস্থার সামগ্রিকতা: কোন ব্যক্তি রাষ্ট্র বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এবং এই কারণে সমগ্র অধিকার-ব্যবস্থা থেকে ব্যক্তির অধিকার বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ব্যক্তির অধিকার হল সমগ্র অধিকার ব্যবস্থারই একটি অংশবিশেষ। ব্যক্তির এ রকম কোন অধিকার থাকতে পারে না যা সমগ্র অধিকার-ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্রের এলাকার অন্তর্ভুক্ত নাগরিকমাত্রেই অধিকার ভোগ করে। নাগরিকদের যাবতীয় অধিকারকে নিয়ে সামগ্রিকভাবে একটি অধিকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়। একজন নাগরিককে ব্যক্তি হিসাবে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করা যায়। কিন্তু ব্যক্তির অধিকারকে সমগ্র অধিকার ব্যবস্থা থেকে আলাদা করে বিচার করা যায় না। বস্তুত বার্কার সমগ্র সমাজব্যবস্থা থেকে ব্যক্তির অধিকারকে আলাদা করে আলোচনা করতে চাননি। নাগরিক ব্যক্তি হিসাবে পৃথকভাবে বিবেচনার বিষয় হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তির অধিকার সমগ্র অধিকার ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। অন্যের ক্ষতি করে অধিকার ভোগ করা যায় না। আবার সমাজ থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করলে ব্যক্তির অধিকারকে বাস্তবে কার্যকর করা যাবে না। সামগ্রিকভাবে অধিকার-ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন একান্তভাবে অপরিহার্য। এবং একজন ব্যক্তির অধিকার হল এই সাধারণ অধিকার ব্যবস্থার অংশ।

রাষ্ট্র ও আইনের সঙ্গে অধিকারের সম্পর্ক: সকল অধিকার রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। নাগরিকের অধিকার ভোগ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে যাবতীয় অধিকারকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা প্রদান। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে তার এই দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকে। বস্তুত রাষ্ট্র ও আইন ব্যতিরেকে অধিকারের ধারণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। অধ্যাপক বার্কারের মতানুসারে অধিকার আইনের মধ্যেই বর্তমান; আইনই হল অধিকার। তিনি বলেছেন: “Law contains rights, and indeed is rights.” বার্কার আইন ও অধিকারকে একই জিনিসের দুটি দিক (aspects) হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। আইনকে তিনি বিষয়গত দিক (objective aspect) হিসাবে দেখেছেন। বাহ্যিক দিক থেকে বিচার করে দেখলে আইনের এই বস্তুগত দিকটি বোঝা যায়। এ দিক থেকে দেখলে অধিকারই আইন বা আইনই অধিকার। আবার অধিকারকে তিনি বিষয়ীগত দিক (subjective aspect) হিসাবে দেখেছেন। ব্যক্তিগত দিক থেকে বিচার করলে অধিকারের এই বিষয়ীগত বা মনোগত দিকটি অনুধাবন করা যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও আইন এবং অধিকার ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্র ও আইন থেকে আলাদা করে দেখলে অধিকার মূল্যহীন প্রতীয়মান হয়।