অধিকার সম্বন্ধে বিভিন্ন তত্ত্ব: অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট রাজনীতিক বা আইনগত আলোচনা প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক যুগের আলোচনা। প্রাচীনকালে গ্রীস, রোম বা অন্যান্য জায়গায় এ বিষয়ে যে সমস্ত আলোচনা হয়েছে তা তেমন সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা বা আলোচনা রাজনীতিক ও দার্শনিক ক্ষেত্রে সাড়া জাগানো আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজনীতিক বিপ্লবের অধ্যায়ে নবজাগরণের পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। ইতিহাসের এই পর্বে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ব্যাপকভাবে শুরু হয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে কেন্দ্র করে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসী বিপ্লব ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। ব্যাপকভাবে আলোচনা চললেও অধিকারের প্রকৃতি প্রসঙ্গে দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের অবসান ঘটেনি। দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার কারণে অধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। অধিকার সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য মতবাদগুলি হল:
-
(ক) স্বাভাবিক অধিকার সম্পর্কিত মতবাদ,
-
(খ) আইনগত মতবাদ,
-
(গ) আদর্শবাদী মতবাদ,
-
(ঘ) ঐতিহাসিক মতবাদ এবং
-
(ঙ) মার্কসীয় মতবাদ।
স্বাভাবিক অধিকার সম্পর্কিত মতবাদ
স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা: অনেকের মতে মানুষ কতকগুলি অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই সহজাত অধিকারগুলি অপরিত্যাজ্য এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ঊর্ধ্বে। স্বাভাবিক অধিকারের প্রবক্তাদের মতানুসারে মানুষ কতকগুলি সর্বজনীন অধিকার ও ন্যায়বোধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই সমস্ত অধিকার ভোগ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন অনাবশ্যক। স্বাভাবিক অধিকার রাষ্ট্রনিরপেক্ষ বলে রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই অধিকার প্রাক্-সামাজিক (pre-social) ও প্রাক্-রাজনীতিক (pre-political)। মানুষের দেহের বর্ণের মত স্বাভাবিক অধিকার মানুষের সহজাত ও অঙ্গীভূত। এই অধিকার স্বাভাবিক, অপরিহার্য, চিরন্তন ও অবাধ। এই হল স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা।
ঐতিহাসিক পটভূমি – চুক্তিবাদীদের ধারণা: স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা অতি প্রাচীন। প্রাচীন গ্রীসের স্টোয়িক দার্শনিক এবং পরবর্তীকালে রোমান আইনবিদদের লেখায় স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা দেখা যায়। স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের উৎপত্তির ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন হলেও, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুখ্যতঃ চুক্তিবাদী হস্, লক্ ও রুশোর লেখায় এই মতবাদ বিকাশ লাভ করে। এই ত্রয়ী চুক্তিবাদীর মতে প্রাক্রাষ্ট্রীয় যুগে স্বাভাবিক অধিকার ছিল। এই অধিকার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। হস স্বাভাবিক অধিকার বলতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে প্রত্যেকের নিজস্ব ধারণা অনুসারে যা খুশী করার অবাধ স্বাধীনতাকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “One’s natural rights are one’s natural powers. In the state of nature, every man has a right to everything even to one another’s body.” লকের মতে কতকগুলি স্বাভাবিক অধিকার সমেত মানুষের জন্ম। লক্ জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করেছেন। রাষ্ট্র সৃষ্টির ফলে স্বাভাবিক অধিকারের কোন ক্ষতি হয়নি। বরং রাষ্ট্রের উপরই স্বাভাবিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। রুশোর মতে মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ (“Man is born free but everywhere he is in chains.”)। রুশোর মতবাদে স্বাভাবিক অধিকার সমষ্টিগত ইচ্ছা (general will)-র অঙ্গীভূত। এই সমষ্টিগত ইচ্ছাই হল জীবন, স্বাধীনতা ও অপর সকল বিষয়ের সংরক্ষক।
টমাস পেইনের অভিমত: টমাস পেইনের মতানুসারে স্বাভাবিক অধিকারসমূহের সংরক্ষণই হল সকল রাজনীতিক সংঘের লক্ষ্য। এই অধিকারগুলি হল স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার এবং অত্যাচার প্রতিরোধের অধিকার। তিনি বলেছেন: “The end of all political associations is the preservation of the natural and imprescriptible rights of man, and these rights are liberty property, security and resistance of oppression.” ফ্রান্স ও আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বাস্তব রূপায়ণ দেখা যায়। আমেরিকার জনগণের অধিকারের সনদে ঘোষণা করা হল: ‘মানুষ স্রষ্টার দ্বারা কতকগুলি অবিচ্ছেদ্য অধিকারে মণ্ডিত (“Men are endowed by their creators with certain inalienable rights.”)। এ প্রসঙ্গে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখ অন্বেষণের অধিকারের উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্রান্সের মানুষের অধিকারের সনদের মাধ্যমেও স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা বিশেষ রূপ লাভ করেছে। ফ্রান্সের স্বাধীনতা ঘোষণায় (১৭৯৩) মানুষের গুরুত্বপূর্ণ স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে স্বাধীনতা, সাম্য, নিরাপত্তা এবং সম্পত্তির অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়।
বেন্থাম ও স্পেন্সার: হিতবাদী বেন্থাম (Jeremy Bentham) এবং স্পেন্সার (Herbert Spencer) স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের সমর্থক হিসাবে পরিচিত। বেহাম স্বাভাবিক অধিকার বলতে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগকে বুঝিয়েছেন। স্পেন্সারের মতানুসারে ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বাধীনতা হল মৌলিক বা স্বাভাবিক অধিকার। রাষ্ট্র ব্যক্তির এই অধিকার কার্যকর করতে না পারলে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নির্দেশ অমান্য করতে পারে। তবে এঁদের মতে অধিকার রাষ্ট্র-পূর্ব বা সমাজনিরপেক্ষ হতে পারে না।
গ্রীণ: আদর্শবাদী গ্রীণ (T. H. Green)-এর অভিমত হল প্রতিটি মানুষের নৈতিক প্রকৃতি উপলব্ধির জন্য যে অধিকারগুলি আবশ্যক সেগুলোই হল স্বাভাবিক অধিকার। সেই অধিকারগুলি সংরক্ষণ করে রাষ্ট্র ব্যক্তির নৈতিক সত্তাকে বিকশিত করতে সাহায্য করবে।
ল্যাস্কি: ল্যাস্কির মতানুসারে বাক্-স্বাধীনতার, ন্যায্য মজুরীর, প্রকৃত শিক্ষার, সংঘ প্রতিষ্ঠার, স্বায়ত্তশাসনের এবং খাদ্য সংস্থানের অধিকারগুলি হল স্বাভাবিক অধিকার। এগুলি স্বাভাবিক অধিকার, তার কারণ হল এগুলি ছাড়া রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না (“These are natural rights in the sense that without them the purpose of the State cannot be fulfilled.”)
গিডিংস: বর্তমানকালের সমাজবিজ্ঞানীদের মতে স্বাভাবিক অধিকার হল শাশ্বত, সহজাত ও অপরিত্যজ্য নয়। স্বাভাবিক অধিকার হল সামাজিক নীতির সহায়ক এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়ামক। সমাজবিজ্ঞানী গিডিংসের মতে, প্রাকৃতিক নিয়ম হিসাবেই সমাজজীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় অধিকারগুলিই হল স্বাভাবিক অধিকার। তিনি বলেছেন: “(Natural rights are) socially necessary forms of right, enforced by natural selection in the sphere of social relations.”
স্বাভাবিক অধিকারের সমালোচনা:
স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।
(১) সমাজ ও রাষ্ট্রনিরপেক্ষ অধিকার হয় না: রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত দাবি বা স্বত্বকেই অধিকার বলে। সুতরাং রাষ্ট্র নিরপেক্ষভাবে অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব। সমাজ-নিরপেক্ষ বা রাষ্ট্র-নিরপেক্ষ অধিকারের কল্পনা নিতান্তই অবান্তর। বোসাংকেতের মতে, অধিকার সমাজ ও রাষ্ট্রনিরপেক্ষ হতে পারে না। তিনি বলেছেন: “A right…is a claim recognised by society and enforced by the state.” অনুরূপভাবে হিতবাদী বেহামের মতেও, অধিকার হল সমাজস্বীকৃত দাবী। তাই স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা অবাস্তব।
(২) অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট: ‘স্বাভাবিক’ কথাটির কোন নির্দিষ্ট বা সর্বজনগ্রাহ্য অর্থ নেই। সেইজন্য স্বাভাবিক অধিকারের কোন নির্দিষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য রূপ নেই। মানুষের কোন অধিকারগুলিকে স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা যায়, তা অত্যন্ত অস্পষ্ট। বিভিন্ন অর্থে ব্যবহারের জন্য স্বাভাবিক অধিকার সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয়নি।
(৩) অধিকার শাশ্বত বা চিরন্তন হতে পারে না: অধিকার মানুষের সমাজবোধ থেকে উদ্ভূত। সমাজ সততই পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজের আর্থনীতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে অধিকারেরও পরিবর্তন হয়। সুতরাং অধিকার শাশ্বত, সহজাত ও চিরন্তন হতে পারে না। সমাজের গতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে অধিকারের ধারণারও পরিবর্তন ঘটে এবং ঘটেছে।
(৪) বৃহত্তর কল্যাণের পরিপন্থী: স্বাভাবিক অধিকার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে–একথা বলার অর্থ হল স্বাভাবিক অধিকার সংরক্ষণের অজুহাতে রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে সীমিত করা। এতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অকাম্য কার্যকলাপ প্রশ্রয় পেতে পারে। সমাজের বৃহত্তম কল্যাণের স্বার্থে এটা অসঙ্গত।
(৫) উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর: অধিকার কখনই অবাধ বা অসীম হতে পারে না। অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ প্রয়োজন। এর অর্থই হল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অস্তিত্ব। তা ছাড়া, স্বাভাবিক অধিকারকে অবাধ বলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার করলে উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়।
(৬) মার্কসীয় সমালোচনা: মার্কসবাদীদের মতানুসারে, স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব। স্বাভাবিক অধিকারের নীতি স্বীকার করে নিলে সমাজে মুষ্টিমেয় শোষক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ ধনবৈষম্যমূলক সমাজে সকলের নয়, কেবল আর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বাভাবিক অধিকারের মূল্যায়ন: বহুবিধ বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বে নিপীড়িত মানুষের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তা ছাড়া আদর্শের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক অধিকার বলতে সমাজের ব্যাপক অংশের কল্যাণের সহায়ক এবং ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী অধিকারকে বোঝান যেতে পারে। এদিক থেকে স্বাভাবিক অধিকারের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
অধিকারের আইনগত মতবাদ
অধিকারের আইনগত ধারণার মূল কথা: আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকার হল রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবি। গ্রীণের মতানুসারে মানুষ কেবল সমাজের সভ্য হিসাবেই অধিকার লাভ করতে পারে। কারণ সমাজের মধ্যেই দাবি-দাওয়ার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। তাই অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। সমাজের বাইরে এর সৃষ্টি অসম্ভব। রাষ্ট্রই সমাজের পক্ষে আইনের মাধ্যমে এই অধিকারকে স্বীকৃতি জানায় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সুতরাং অধিকার হল রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবি। এ হল অধিকার সম্পর্কে আইনগত ধারণার মূল কথা। বোসাংকেতের মতে, ‘অধিকার হল সমাজ কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি” (“A right is claim recognised by society and enforced by the state.”)। অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের আপেক্ষিক বলে আইনের পরিবর্তনের সঙ্গে অধিকারেরও পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং অধিকার কোন চিরন্তন বিষয় নয়। আবার অধিকার সহজাত, সমাজ বা রাষ্ট্র-নিরপেক্ষ এবং রাষ্ট্র-পূর্ব বিষয়ও নয়। কারণ রাষ্ট্রই আইনের দ্বারা অধিকার সৃষ্টি ও রক্ষা করে। আইনের দ্বারা স্বীকৃত বলেই অধিকার লঙ্ঘিত হলে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে। এই মতবাদে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির কোন অধিকার স্বীকার করা হয় না।
বিভিন্ন প্ৰবক্তা: অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের গুরুত্বের কথা প্রচার করা হয়। স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের পরিবর্তে এই সময় উদারনীতিক চিন্তাবিদ্গণ অধিকারের আইনগত মতবাদ প্রচার করেন। অস্টিন, বেন্থাম, রিচি, সলমণ্ড প্রভৃতি চিন্তানায়কগণ অধিকারের আইনগত তত্ত্ব প্রচার করেন। বেহামের মতানুসারে অধিকার হল একমাত্র আইনেরই ফলস্বরূপ। তিনি বলেছেন: “Rights are the fruits of law and law alone.” রিচির কথায়: “Legal right is the claim of a individual upon others recognised by the state.”
অধিকারের আইনগত মতবাদের সমালোচনা:
অধিকারের আইনগত মতবাদটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত হয় না। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মতবাদটির সমালোচনা করা হয়।
(১) রাষ্ট্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্পূর্ণ: রাষ্ট্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকারের আইনগত তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। অধিকারের আইনগত মতবাদ সমাজের ঔচিত্য-অনৌচিত্যের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য। ব্যক্তির এবং সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের স্বার্থে কি কি অধিকার থাকা উচিত সে বিষয়ে এই মতবাদ নীরব। অধিকারের সামাজিক উপযোগিতা এবং নীতিগত বিচারে কোন অধিকার স্বীকৃত ও সমর্থনযোগ্য কিনা সে বিষয়ে এই মতবাদ নীরব।
(২) ল্যাস্কির মত: ল্যাস্কির মতে অধিকার রাষ্ট্র সৃষ্টি করে না, রাষ্ট্র কেবল অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণ করে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The state briefly does not create, but recognises, rights.” আইনানুমোদিত না হয়েও অধিকার থাকতে পারে। ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক দাবি বলবৎযোগ্য বলেই অধিকারে পরিণত হয়। না; বরং অধিকার বলেই রাষ্ট্র এগুলিকে বলবৎ করে থাকে। বহুত্ববাদীদের মতানুসারে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ।
(৩) সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সদস্য হিসাবেও ব্যক্তি অধিকার ভোগ করে: ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রের সদস্য হিসাবেই অধিকার ভোগ করে, এ কথাও ঠিক নয়। রাষ্ট্র ব্যতিরেকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে। ল্যাস্কির মতে, একমাত্র আইন নয়, ভালমন্দ বা ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত আমাদের ধারণাই হল অধিকারের প্রকৃত উৎস।
(৪) রাষ্ট্রকে বাধা দেওয়ার অধিকার আছে: অধিকারের আইনগত তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির কোন অধিকার নেই। এও ঠিক নয়। কারণ রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির কোন অধিকার খর্ব করে তা হলে সাধারণ কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তির উচিত রাষ্ট্রকে সেক্ষেত্রে বাধা দেওয়া।
(৫) মার্কসীয় সমালোচনা: মার্কসবাদীদের মতানুসারে আইনগত দৃষ্টিতে সমাজের বৃহত্তর অংশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও আইন আর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। কোন বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রচিত আইন সমাজের সকলের অধিকার রক্ষা করতে পারে না।
অধিকারের আইনগত মতবাদের মূল্যায়ন: বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও মতবাদটির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। অধিকারের আইনগত মতবাদই অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট এবং বৈজ্ঞানিক ধারণার সৃষ্টি করেছে। তবে এই মতবাদে কেবল আইনগত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই মতবাদটি অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট।
অধিকার সম্পর্কে আদর্শবাদী মতবাদ
আদর্শবাদী ধারণার মূল কথা: রাষ্ট্রদর্শনে অধিকার বলতে বোঝায় মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও ব্যক্তিজীবনের সম্যক প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। আদর্শবাদী ধারণা অনুসারে মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলী বা ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী বাহ্যিক পরিবেশই হল অধিকার। তাই অনেকে অধিকার সম্পর্কিত এই আদর্শবাদী তত্ত্বকে অধিকারের ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব (Personality Theory of Rights) বলে থাকেন। বলা হয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু অন্তর্নিহিত শক্তি বা ক্ষমতা থাকে। মানুষ এর বিকাশ সাধনের জন্য চেষ্টা করে। একেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ বলে। কিন্তু কতকগুলি সুযোগ-সুবিধা বা অবস্থা ব্যতিরেকে তা সম্ভব হয় না। ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য এই সকল অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ-সুবিধাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধিকার বলে। অধ্যাপক ল্যাস্কির কথায়: ‘বস্তুত অধিকার হল সমাজজীবনের সেই সকল অবস্থা যেগুলি ছাড়া কোন মানুষ সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে না’ (“Rights, in fact are those conditions of social life without which no man can seek, in general, to be himself at his best.”)। আদর্শবাদী তত্ত্ব অনুসারে অধিকার বলতে মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের জন্য কতকগুলি বাহ্যিক শর্তকে বোঝায়। এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশকে সুনিশ্চিত করাই হল অধিকারের মূল উদ্দেশ্য। অধিকারের আদর্শবাদী মতবাদ ব্যক্তির নৈতিক অধিকারগুলির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। আইনের পরিবর্তে নৈতিক ভিত্তির উপর অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে এই মতবাদের বেশী আগ্রহ।
অধিকারের স্বরূপ: আদর্শবাদী ধারণা অনুসারে (১) সমাজ থেকেই অধিকারের উৎপত্তি হয়। সমাজ মানুষের মঙ্গলের জন্যই অধিকার স্বীকার করে। (২) অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য জড়িত থাকে। ব্যক্তি সমাজের একজন হিসাবে অধিকার ভোগ করে। তাই তাকে নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। একের আত্মবিকাশের অধিকার ভোগ অপরের কর্তব্য পালনের উপর নির্ভরশীল। অধিকার দাবির সঙ্গে অপরের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করার দায়িত্বও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। (৩) প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মবিকাশে সাহায্য করা সামগ্রিকভাবে সমাজের কর্তব্য। (৪) সামগ্রিক কল্যাণ বা সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের সঙ্গে অধিকার সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের অধিকার সমাজের অন্যান্য সকলের ব্যক্তিত্ব বিকাশের অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
আদর্শবাদী মতবাদের সমালোচনা:
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বের বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে।
- ব্যক্তিত্বের ধারণা মানসিক বা ভাবগত। তাই ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ কি এই মতবাদ তা নির্ধারণ করতে পারেনি।
- অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের গুরুত্বকে অবহেলা করে অধিকারের প্রয়োগ সম্পর্কে সঠিক কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
- এই মতবাদে ব্যক্তির অধিকারকে সমাজকল্যাণের সহায়ক হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। যদি ব্যক্তির ও সমাজের কল্যাণের মধ্যে বিরোধ বাধে তা হলে কিভাবে তার সমাধান হবে, সে বিষয়ে আদর্শবাদ নীরব।
- সর্বাত্মক রাষ্ট্রের প্রবক্তারা অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বের বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নৈতিক সত্তাকে চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করেছেন এবং রাষ্ট্রের বেদীমূলে ব্যক্তিস্বার্থকে বলি দিয়েছেন।
অধিকার সম্পর্কে ঐতিহাসিক মতবাদ
মূল বক্তব্য: ঐতিহাসিক মতবাদের মূল বক্তব্য হল এই যে, অধিকার ইতিহাসেরই সৃষ্টি। এই মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, সমাজে দীর্ঘকাল ধরে যে সমস্ত প্রথা প্রচলিত থাকে সেগুলিই কালক্রমে অধিকারে পরিণত হয়। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ বংশানুক্রমিকভাবে কোন বিশেষ একটি প্রথাকে মেনে চলতে থাকলে, সেই প্রথাটিকে মেনে চলা স্বাভাবিকভাবে মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়। সংশ্লিষ্ট প্রথাটি এইভাবে কালক্রমে অধিকারে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক অধিকারবোধের ধারণার উদ্ভব হয়েছে সমাজের প্রচলিত প্রথার প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য থেকেই। ইংরেজদের প্রথাগত অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ইংল্যাণ্ডে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ইংরেজরা তাদের সংগ্রামের পরিণতিতে ‘অধিকারের সনদ’ (Magna Carta) ও ‘অধিকারের আবেদন পত্র’ (Petition of Rights) লাভ করেছে। বার্ক (Edmund Burke)-এর মতানুসারে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে মানুষের বিমূর্ত অধিকারের ভিত্তিতে।
ঐতিহাসিক মতবাদের সমালোচনা:
অধিকার সম্পর্কিত ঐতিহাসিক মতবাদকে নানা কারণে সমর্থন করা যায় না। (১) ‘ইতিহাস অধিকারের সৃষ্টি করেছে বা অধিকার প্রথাভিত্তিক একথা মেনে নেওয়া যায় না। এক সময় বহুলভাবে প্রচলিত ‘ক্রীতদাস প্রথা’ অধিকারে পরিণত হয়নি। তবে দাস মালিকদের দিক থেকে ক্রীতদাস প্রথা অধিকার হলেও নৈতিক ধারণার বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে তা কালক্রমে অধিকারে রূপান্তরিত হয়নি। (২) অধিকারকে প্রথাভিত্তিক বলে স্বীকার করে নিলে সমাজ রক্ষণশীল হয়ে পড়বে। এমনকি সমাজে অনেক কুসংস্কারও প্রতিষ্ঠিত হবে। (৩) এই মতবাদে অধিকারের উদ্ভবের ব্যাপারে বক্তব্য থাকলেও অধিকারের প্রকৃতি প্রসঙ্গে মতবাদটি নীরব। এই সমস্ত নানা কারণে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অধিকার সম্পর্কিত ঐতিহাসিক মতবাদ গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
অধিকার সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ
অধিকার সামাজিক অবস্থার আপেক্ষিক: অধিকার সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদ রাষ্ট্র এবং আইনের প্রকৃতি সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার অনুরূপ। মার্কসবাদ অনুসারে অধিকার সামাজিক অবস্থার আপেক্ষিক। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমেই মার্কসবাদীরা অধিকারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। এই মতবাদ অনুসারে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থাই হল বনিয়াদ বা মূল ভিত্তি। এরই উপর রাজনীতিক ও আইনগত উপরি-কাঠামো গড়ে ওঠে। বনিয়াদের পরিবর্তন হলে সঙ্গে সঙ্গে উপরি-কাঠামোরও পরিবর্তন হয়। এর অর্থ হল তখন রাজনীতিক, দার্শনিক, আইনগত, ধর্মীয়, নান্দনিক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন হয়। মার্কসবাদে এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকারের ধারণা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
মার্কসীয় অর্থে অধিকার: মার্কসীয় ধারণা অনুসারে সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যে সক্রিয় সদস্য হিসাবে কাজ করার জন্য আবশ্যিক সুযোগ-সুবিধাই হল অধিকার। এই অর্থে একদিকে আর্থনীতিক উন্নয়ন ও অপরদিকে সামাজিক সম্পর্কের উপর অধিকার নির্ভরশীল। সামাজিক সম্পর্ক (social or property relations) অধিকার ভোগের ব্যাপারে প্রধান নির্ধারক হিসাবে কাজ করে। সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টায় ব্যক্তি অন্যান্যদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। অর্থাৎ মার্কসীয় দৃষ্টিতে অধিকারের ধারণা শ্রেণী-সম্পর্ক ও শ্রেণী-সংগ্রামের ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়।
বৈষম্যমূলক সমাজে জনগণের অধিকার থাকে না: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অধিকার শ্রেণীস্বার্থ নিরপেক্ষ এবং জনগণের অধিকার হতে পারে না। বৈষম্যমূলক সমাজে অধিকার বলতে মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণীর অধিকারকেই বোঝায়। উৎপাদন ব্যবস্থার উপর যে শ্রেণীর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকে তারাই রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদেরই শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসাবে আইন প্রণয়ন এবং তা বলবৎ করে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র সেই সকল আইন ও অধিকার সৃষ্টি ও প্রয়োগ করে যেগুলি রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী যারা, তাদের স্বার্থ রক্ষা বা চাহিদা পূরণের উপযোগী। অর্থাৎ আর্থনীতিক সুবিধাভোগী শ্রেণীই রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী হয় এবং তারাই বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার ভোগ করে থাকে। দাস-সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র বা আইন দাস-মালিকের অধিকার সৃষ্টি ও সংরক্ষণে নিযুক্ত ছিল। দাস-মালিকরাই সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকারটুকুও ক্রীতদাসের ছিল না। সামস্ততান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র সামন্ত প্রভুদের স্বার্থে পরিচালিত হয়ে তাদেরই স্বার্থ রক্ষার উপযোগী আইন ও অধিকার সৃষ্টি বলবৎ করেছে। আবার ধনতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র পুঁজিপতিদের স্বার্থে পরিচালিত হয়ে তাদের স্বার্থের উপযোগী আইন ও অধিকার সৃষ্টি ও রক্ষা করে। ধনবৈষম্যমূলক শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অধিকার শ্রেণীগত হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার পবিত্র অধিকার হিসাবে স্বীকৃত হলে সকলের অধিকার ভোগ সম্ভব হতে পারে না।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে জনগণের অধিকার সৃষ্টি হয়: কেবল সমাজতান্ত্রিক সমাজে বা শ্রেণীহীন সমাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার বা জনগণের অধিকার সৃষ্টি হতে পারে। এরূপ সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সকল সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে জনগণ আর্থনীতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি সকল অধিকার ভোগ করার সুযোগ পায়। তবে সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক কাঠামো বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে কোন অধিকার ভোগ করা যায় না। এক্ষেত্রে আইন ও অধিকার সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক কাঠামোর পরিপূরক হয়ে থাকে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের আর্থনীতিক সাম্যের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তা ছাড়া নাগরিকদের কাজের অধিকার, সর্বহারা বা শ্রমিকশ্রেণীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য অধিকার স্বীকৃত হয়।
অধিকার ও কর্তব্য পৃথক নয়: মার্কসীয় ধারণা অনুসারে অধিকার ও কর্তব্য দুটি স্বতন্ত্র বিষয় নয়। অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। মার্কস “No rights without duties, no duties without rights.” ব্যক্তির অধিকার ভোগের সঙ্গে সমাজ ও সমাজস্থ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের প্রতি কর্তব্যের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। অধিকারের সার্থকতা ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে যথার্থ সমন্বয় সাধনের উপর নির্ভরশীল।
Leave a comment