অন্যান্য সংগঠন ও অধিকার: ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে অধিকার সম্পর্কিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও নাগরিক এবং রাষ্ট্র ও অন্যান্য সংঘ-সংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও বলেছেন। তাঁর মতানুসারে কেবলমাত্র রাষ্ট্রের সদস্য হিসাবে ব্যক্তি মানুষের অধিকারকে সীমাবদ্ধ রাখা সঙ্গত নয়; যদি তা রাখা হয়, তা হলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশের পরিবর্তে বিনাশ ঘটবে। তিনি বলেছেন: “To limit his rights to the single category which membership of the state involve is to destroy his personality and not to preserve it.” সমাজের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করা হল মানুষের প্রবৃত্তি। তাই সমাজে বিভিন্ন সংঘ-সংগঠন থাকে। ল্যাস্কি এদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে সমাজ হল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। সমাজে অনেক সংঘ-সংগঠন বর্তমান। সর্বজনীন কল্যাণ বা সাধারণের স্বার্থে ব্যক্তি মানুষ সংঘবদ্ধ হয় এবং সংঘ সংগঠন গড়ে তোলে। রাষ্ট্রের যেমন অধিকার আছে এই সমস্ত সংগঠনেরও তেমনি অধিকার আছে। এবং উভয়ের অধিকারই হল প্রকৃত ও বাধ্যতামূলক। ব্যক্তি মানুষ রাষ্ট্রের সদস্য এবং কেবল এই জন্যই সে অধিকার ভোগ করে ও ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সাধন করে, এটাই সব কথা নয়। সমাজে আরও অনেক সংঘ সংগঠন আছে। এদের মাধ্যমেও ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করে। তাই ব্যক্তি বহু সংগঠনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাকে মেনে নেয়। তেমন কোন চরম সংকটের সৃষ্টি না হলে ব্যক্তি এই সমস্ত সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে বজায় রেখে চলে।

রাষ্ট্রের সমন্বয়সাধনকারী ভূমিকা: ল্যাস্কি এই সমস্ত সংঘ-সংগঠনের ভূমিকার গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রের সমন্বয় সাধনমূলক ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। এই সংগঠনগুলি রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের মধ্যেই যে যার ভূমিকা পালন করে এবং বিকশিত হয়। তবে মতবিরোধের ঘটনা ঘটলে তার মীমাংসা হয় রাষ্ট্রের ইচ্ছা অনুসারে। সমাজে রাষ্ট্রের সমন্বয়সাধনমূলক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের এই ভূমিকা বরাবর বজায় থাকে। সংঘ-সংগঠনের সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সমাজের সকল সংঘ-সংগঠনের উপর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে একটি শর্তসাপেক্ষে। শর্তটি হল এই যে, সমাজের সকল সদস্যের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের প্রয়োজনীয় অধিকার স্বীকার করা হয়েছে এই মর্মে সকলকে সুনিশ্চিত করতে হবে। ল্যাস্কির মতানুসারে বাস্তবে এই দায়িত্ব রাষ্ট্র একা বহন করতে পারে না।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব: ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্রের নির্দেশমাত্রেই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে না। নাগরিকদের ন্যায্য দাবি পুরণ করতে রাষ্ট্র বাধ্য। এই বাধ্যবাধকতা পালন করার পর রাষ্ট্র আনুগত্য দাবি করতে পারে। সবাইকে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে রাষ্ট্র আনুগত্য আশা করতে পারে না। অনুরূপভাবে সুবিধাভোগীদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। ব্যক্তিস্বার্থকে সর্বজনীন স্বার্থের অধীন করতে হবে। অর্থাৎ সকলের স্বার্থের জন্য ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ ছাড়তে হবে। এ ব্যাপারে সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। তবে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। সকলের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হয়।

রাষ্ট্র ও অধিকারের বণ্টন: সমাজের অধিকার বণ্টন বা সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা মোটেই পক্ষপাতহীন নয়, বরং পক্ষপাতদুষ্ট। বর্তমানে সুযোগ সুবিধা বেড়েছে বা অধিকারের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। তার ফলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের সম্ভাবনা বেড়েছে। এতদ্সত্ত্বেও সর্বসাধারণের অধিকার অনুশীলনের সুযোগ বাড়েনি। প্রকৃত প্রস্তাবে অধিকার অনুশীলনের সুযোগ মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গের হাতেই পুঞ্জীভূত। অধিকারের ভোগ থেকে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনও বঞ্চিত। সমাজের মুষ্টিমেয় সম্পদশালী ব্যক্তিই অধিকার অনুশীলনের সুযোগ ভোগ করতে পারে। এবং এ ক্ষেত্রে এই শ্রেণীরই পক্ষে রাষ্ট্র কাজ করে। অর্থাৎ ক্ষমতাবান শ্রেণীর অধিকারের অনুকূলে রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে। এই কারণে অধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে বর্তমানে রাষ্ট্রে অতি কেন্দ্রীভবন হল অভিপ্রেত অধিকার ব্যবস্থার প্রতিকূল। তবে ব্যাপকভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ক্ষমতাকে যাঁরা কার্যকর করেন তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ল্যাস্কির মতে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে। তার ফলে আলাপ-আলোচনার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। সুস্থ ও স্বাধীন মতামত গড়ে উঠবে। এবং অধিকার সম্পর্কে সকলের সচেতনতা সৃষ্টি হবে ও বৃদ্ধি পাবে।