ভূমিকা: জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে সুখী হওয়ার জন্যই মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। মানুষ আশা করে যে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সুখ-সমৃদ্ধি সাধনে রাষ্ট্র উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করবে। এর অর্থ হল রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য অধিকার সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক অবস্থার সৃষ্টি করবে। বস্তুত মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মূল উদ্দেশ্য হল অধিকার ভোগের মাধ্যমে সুস্থ-সুন্দর ও সুখী জীবন সম্ভব করে তোলা। ল্যাস্কি (Harold J. Laski)-র মতানুসারে, রাষ্ট্র অধিকার প্রদানের মাধ্যমে মানুষের আত্মবিকাশে সাহায্য করে। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজন। ব্যক্তির সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করা দরকার। ব্যক্তির ন্যূনতম দাবি-দাওয়ার সন্তুষ্টি সাধন ব্যতিরেকে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটতে পারে না এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকশিত না হলে ব্যক্তির আত্মোপলব্ধি অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে অধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই পরিবেশের মধ্যে মানুষের আত্মবিকাশ সম্ভব হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র সকলের জন্য অধিকার স্বীকার করবে এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে। এই কারণে ল্যাস্কির অভিমত হল: ‘রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত অধিকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়।’ তিনি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Every state is known by the rights that it maintains.” এইজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অধিকার হল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগের অধিকারই হল একটি যোগসূত্র। এই অধিকার লাভের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মুখর। গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশের ফলে এখন মানুষ আরও বেশী অধিকার সচেতন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানের মাধ্যমে লিখিতভাবে নাগরিকদের অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

উদারনীতিকগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার প্রভৃতি ধারণাগুলির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই ধারণাগুলিকে উদারনীতিক মতবাদের দার্শনিক নীতি (Philosophical theory) হিসাবে অভিহিত করা হয়। আধুনিক উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির উপযোগী একমাত্র রাজনীতিক দর্শন হিসাবে উদারনীতির কথা বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় উদারনীতির অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা করা এবং ব্যক্তি-নাগরিকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করা। ব্যক্তির প্রাধান্য ও স্বাধীনতা হল উদারনীতিক মতবাদের সার কথা। ব্যাপক অর্থে মানুষের সামাজিক, নৈতিক, বৌদ্ধিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনও উদারনীতিবাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। উদারনীতিবাদের মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ। ইতিবাচক অর্থে উদারনীতি হল স্বাধীনতার নীতি তথা মৌল গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। বস্তুত কতকগুলি রাজনীতিক দর্শ ও নীতি উদারনীতিবাদে প্রচার করা হয়েছে। এগুলি হল: 

  • (ক) স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী, 

  • (খ) জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সম্মতি এবং 

  • (গ) মানবাধিকারের আদর্শ।

অধিকারের অর্থ ও প্রকৃতি

সামাজিক ধারণা: সাধারণ অর্থে অধিকার বলতে কোন স্বত্ব বা দাবীকেই বোঝায়। কিন্তু এই দাবী স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে অধিকারের সৃষ্টি হয় না। সমাজের মধ্যেই এই স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। তাই অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। গিলক্রিস্ট (Gilchrist) বলেছেন: “Rights arise from the fact that man is a social being.” সমাজের বাইরে এর সৃষ্টি অসম্ভব।

আইনগত ধারণা: রাষ্ট্রই সমাজের পক্ষে আইনের মাধ্যমে এই অধিকারকে স্বীকৃতি জানায় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সুতরাং অধিকার হল রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবী। এ হল অধিকার সম্পর্কে আইনগত ধারণা। বোসাংকেত (Bosanquet)-এর মতে, ‘অধিকার হল সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবী’ (“A right is a claim recognised by society and enforced by the state.”)। অধিকারের ধারণা রাষ্ট্র ও সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

অধিকার হল ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ-সুবিধা: রাষ্ট্রদর্শনে অধিকার বলতে বোঝায় মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও ব্যক্তিজীবনের সম্যক প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। বলা হয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু অন্তর্নিহিত শক্তি বা ক্ষমতা থাকে। মানুষ এর বিকাশ সাধনের জন্য চেষ্টা করে। একেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ বলে। কিন্তু কতকগুলি সুযোগ-সুবিধা বা অবস্থা ছাড়া তা সম্ভব হয় না। ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য এই সকল অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ-সুবিধাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধিকার বলে। ল্যাস্কির মতে ‘বস্তুত অধিকার হল সমাজজীবনের সেই সকল অবস্থা যেগুলি ব্যতিরেকে কোন মানুষ সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে না।’

অধিকার সমষ্টিগত কল্যাণকামী: প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ-সুবিধার অর্থ সকলের কল্যাণ বিধানের সুযোগ-সুবিধা। সুতরাং অধিকার হল সমষ্টিগত কল্যাণকামী। তাই আদর্শবাদী দার্শনিক গ্রীণ (T. H.Green) -এর মতানুসারে, ‘সমষ্টিগত নৈতিক কল্যাণ সম্পর্কে চেতনা ব্যতীত অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব’। তিনি বলেছেন: “Without society conscious of common moral interests, there can be no rights.” এই প্রসঙ্গে হবহাউস (Hobhouse)-এর অভিমত হল: ‘প্রকৃত অধিকার বলতে সামাজিক কল্যাণ সাধনের কতকগুলি শর্তকে বোঝায় এবং বিভিন্ন অধিকারের বৈধতা সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি বিধানের উপর নির্ভরশীল’। তিনি বলেছেন: “Genuine rights are conditions of social welfare and the various rights own their validity to the functions they perform in the harmonious development of society.” কিন্তু ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কল্যাণের সহায়ক হওয়া সত্ত্বেও কোন সুযোগ-সুবিধা আইনের দ্বারা স্বীকৃত না হলে তাকে অধিকার বলা যায় না।