প্রশ্নঃ অধিকারের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর। 

ভূমিকঃ পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। পৌরনীতি ও সুশাসনে অধিকার বলতে বোঝায় সমাজের সকলের জন্য কল্যাণকর কতগুলো সুযোগ-সুবিধা। অপরদিকে অধিকার ভোগের বিনিময়ে একজন নাগরিককে বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসব দায়িত্বকেই নাগরিকের কর্তব্য বলা হয়। অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই একজন নাগরিকের ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। নাগরিক জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়। অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। একমাত্র কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই অধিকার উপভোগ করা যায়। 

অধিকারের সংজ্ঞা ও অর্থ (Definition and Meaning of Right): পৌরনীতি ও সুশাসনে অধিকার বলতে বোঝায় সমাজের সকলের জন্য কল্যাণকর কতগুলো সুযোগ-সুবিধা। অধিকার সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। অধিকার ব্যতীত ব্যক্তির জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। সুতরাং সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তি যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে তাই অধিকার। সমাজে বসবাসকারী সকল মানুষের পারস্পরিক স্বীকৃত দাবিই অধিকার। সমাজেই অধিকারের জন্ম এবং সমাজই এর রক্ষক। এজন্যই অধ্যাপক লাকি বলেছেন যে, “অধিকার সমাজ বহির্ভূত বা সমাজ নিরপেক্ষ নয়। অধিকার সমাজভিত্তিক।”

অধিকারের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Rights): অধিকারকে প্রথমে দু ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) নৈতিক অধিকার ও (২) আইনগত অধিকার।

১। নৈতিক অধিকার (Moral Rights): নৈতিক অধিকার বলতে আমরা সে সব অধিকারকে বুঝি যা নৈতিকতা বা ন্যায়বোধ থেকে উদ্ভূত। সমাজের নৈতিকতা বা ন্যায়বোধ থেকে নৈতিক অধিকারের উদ্ভব। যেমন- দরিদ্রের সাহায্য পাবার অধিকার, পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তান লালন-পালন ও তাদের ভরণপোষণের অধিকার ইত্যাদি। নৈতিক অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত নয়। এ অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে না। Dictionary of Social Science গ্রন্থে বলা হয়েছে, “নৈতিক অধিকার মানুষের নৈতিক অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল এবং এগুলো কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সুরক্ষিত নয়।” (Moral rights which are dependent on the ethical feelings of man and they are not guaranteed by any legal authority.) তবে নৈতিক অধিকারের পিছনে সমাজের সমর্থন রয়েছে। কোনো ব্যক্তি এ অধিকার ভঙ্গ করলে সমাজে তার তীব্র সমালোচনা হতে পারে। সার্থক ও সুন্দর সামাজিক জীবনের জন্য নৈতিক অধিকার অত্যাবশ্যক। নৈতিক অধিকার ব্যক্তি ও সমাজভেদে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে।

২। আইনগত অধিকার (Legal Rights): আইনগত অধিকার বলতে ব্যক্তির সে অধিকারকে বোঝায় যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং অনুমোদিত। আইনগত অধিকারের পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব। আইনগত অধিকার ভঙ্গকারীকে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া যায়। জীবন ধারণের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চাকরির অধিকার ইত্যাদি আইনগত অধিকারের পর্যায়ভুক্ত। আইনগত অধিকারের উৎস হচ্ছে রাষ্ট্র।

আইনগত অধিকারকে আবার কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- (ক) সামাজিক অধিকার (Civil Rights), (খ) অর্থনৈতিক অধিকার (Economic Rights), (গ) রাজনৈতিক অধিকার (Political Rights) ও (ঘ) সাংস্কৃতিক অধিকার (Cultural Rights), ধর্মীয় অধিকার (Religions Rights) ও ব্যক্তিক অধিকার (Personal Rights)।

নিম্নে বিভিন্ন অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

(ক) সামাজিক অধিকার (Civil Rights): যে সকল অধিকার নাগরিকের সভ্য জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য তাকেই সামাজিক অধিকার বলে। সামাজিক অধিকারসমূহ নিম্নরূপঃ

১. জীবনের অধিকার (Right to life): জীবনের অধিকার বা আত্মরক্ষার অধিকার নাগরিকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং প্রয়োজনে বাইরেও রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবনের বা আত্মরক্ষার নিরাপত্তা বিধান করবে।

২. ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (Right to liberty): ব্যক্তি স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রে বসবাস করবে। কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক বা শাস্তিদান করা যাবে না।

৩. চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার (Right to thought and speech): প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার, মতামত প্রকাশ করার এবং আইন ও সংবিধান মেনে গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার ব্যক্তির রয়েছে।

৪. সভা-সমিতির অধিকার (Right to association and Meeting): প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণভাবে, রাষ্ট্র কর্তৃক বেআইনী ঘোষিত বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি এমন অনুষ্ঠানে বা সভা-সমাবেশে সমবেত হবার, সভা-সমিতি করে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে।

৫. চলাফেরার অধিকার (Right to movement): রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ এলাকা ব্যতীত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে কোনো স্থানে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে।

৬. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (Freedom to Press): রাষ্ট্র অনুমোদিত সকল সংবাদপত্রের স্বাধীন, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশ করার অধিকার থাকতে হবে।

৭. চুক্তি সম্পাদনের অধিকার (Right to contract): যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা আইনানুগ পদ্ধতিতে অপর কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।

৮. আইনের চোখে সমানাধিকার (Right to equality before the eye of law): জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল মানুষের আইনের চোখে সমানাধিকার থাকতে হবে।

৯. সম্পত্তির অধিকার (Right to Property): প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ভোগ দখল, বিক্রী ও হস্তান্তর করার অধিকার থাকবে। রাষ্ট্র সম্পত্তি ভোগের নিরাপত্তা বিধান করবে।

১০. ধর্মের অধিকার (Right to Religion): প্রত্যেক নাগরিক নিজের পছন্দ ও বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোনো ধর্ম গ্রহণ, পালন ও তা’ প্রচার করতে পারবে।

১১. পরিবার গঠনের অধিকার (Right to organize family): পরিবার মানুষের আদি প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেক নাগরিকের ইচ্ছেমত বিয়ে করার মাধ্যমে পরিবার গঠনের অধিকার রয়েছে।

১২. অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার লাভের অধিকার (Right to economic and social justice): অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুবিচার পাওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে।

১৩. শিক্ষার অধিকার (Right to education): প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষা লাভের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র শিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত রাখবে এবং শিক্ষা বিস্তারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

১৪. নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও চর্চার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র তা’ সংরক্ষণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

১৫. খ্যাতি বা সম্মান লাভের অধিকার (Right to fame): সকল নাগরিকের তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ খেতাব, সম্মান ও পুরস্কার পাবার অধিকার থাকবে।

(খ) অর্থনৈতিক অধিকার (Economic Rights): যে অধিকার ব্যক্তিকে অভাব ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়ে অর্থনৈতিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান করে তাকেই অর্থনৈতিক অধিকার বলে। এগুলো নিম্নরূপঃ

১. কর্মের অধিকার (Right to work): যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া এবং তা’ করার ক্ষমতাকে কর্মের অধিকার বলে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং কর্মসম্পাদনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

২. ন্যায্য মজুরি লাভের অধিকার (Right to reasonable wages): ন্যায্য মজুরি লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের স্বীকৃত অধিকার। ন্যায্য মজুরি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত না করা হলে কর্মের অধিকার গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।

৩. বিশ্রাম বা অবকাশ লাভের অধিকার (Right to Rest): বিশ্রাম বা অবকাশ লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায্য অধিকার। কাজের মাঝে বিরতি, বিশ্রাম, অবকাশ যাপনের সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। এছাড়াও রাষ্ট্রের উচিত কাজের সময়সীমা ও শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ করে দেওয়া।

৪. শ্রমিক সংঘ বা ইউনিয়ন করার অধিকার (Right to form trade union): আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে কর্মরত ব্যক্তি বা শ্রমিকের সংঘ বা ইউনিয়ন গঠন বা তার সভ্য হবার অধিকার একটি স্বীকৃত অধিকার।

৫. বুদ্ধ ও অক্ষম অবস্থায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা (Right to economic security in old and Incapable condition): বৃদ্ধ ও কাজকর্ম করতে অক্ষম ব্যক্তিদের রাষ্ট্রের নিকট থেকে আর্থিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে বৃদ্ধ ও অক্ষম ব্যক্তিরা এ অধিকার ভোগ করে।

(গ) রাজনৈতিক অধিকার (Political Rights): নাগরিকগণ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের জন্য যে সমস্ত অধিকার ভোগ করে থাকে তাকেই রাজনৈতিক অধিকার বলে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত। রাজনৈতিক অধিকারসমূহ নিম্নরূপঃ

১. স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার (Right to residence): আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে যে কোনো নাগরিকের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার রয়েছে।

২. নির্বাচনের অধিকার (Right to election): জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ভোট দেবার, নির্বাচনে প্রার্থী হবার অধিকার রয়েছে।

৩. আবেদন করার অধিকার (Right to Petition): যে কোনো নাগরিকের তার অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি লিখিত আকারে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিকট জানানোর অধিকার রয়েছে।

৪. সরকারি চাকরি লাভের অধিকার (Right to hold Public Office): জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের সরকারি চাকরি লাভের অধিকার থাকবে।

৫. বিদেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা লাভের অধিকার (Right to Protection in abroad): একজন নাগরিক বিদেশে যে রাষ্ট্রেই বসবাস বা অবস্থান করুক না কেন, সেখানে কোনো সমস্যায় পড়লে তার নিজ রাষ্ট্রের সাহায্য এবং নিরাপত্তার সুবিধা লাভের অধিকার থাকবে।

৬. সরকারের সমালোচনা করার অধিকার (Right to criticize Government): একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের বা গণবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনা করার।

(ঘ) সাংস্কৃতিক অধিকার (Cultural Rights): সংস্কৃতি হচ্ছে নাগরিকের আত্মপরিচয়ের বাহন। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে নাগরিক তার ইচ্ছা ও অভিব্যক্তিকে অপরের নিকট প্রকাশ করে। নাগরিকের ব্যক্তিসত্তা ও জাতীয় সত্তাকে তুলে ধরতে হলে প্রত্যেক নাগরিকের সংস্কৃতি চর্চার অধিকার থাকা উচিত।

(ঙ) ধর্মীয় অধিকার (Religious Rights): ধর্মীয় অধিকার বলতে প্রত্যেক নাগরিকের ইচ্ছামত ধর্মমত গ্ৰহণ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ও ধর্মীয় মতামত প্রকাশ সংক্রান্ত অধিকার বোঝায়। নাগরিকের ধর্মীয় অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বরং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন কারো ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ বা আঘাত করতে না পারে তা দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

(চ) ব্যক্তিক অধিকার (Personal Rights): ব্যক্তিক অধিকার বলতে প্রত্যেক নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ‘সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায়। ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, পরিবার সংগঠনের অধিকার, খ্যাতি লাভের অধিকার ইত্যাদি হচ্ছে ব্যক্তিক অধিকার। ব্যক্তিক অধিকার ব্যতীত কোনো নাগরিক তার নিজ সত্তাকে বিকশিত করতে পারে না। 

উপসংহারঃ অধিকার ও কর্তব্য উভয়ই সমাজবোধ থেকে উদ্ভূত এবং উভয়েরই রক্ষক সমাজ। অধ্যাপক হ্যারল্ড জে. লাঙ্কি এজন্যই বলেছেন যে, ‘অধিকারের ধারণা কর্তব্যহীন হতে পারে না।’ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সহজাত মানবিক অধিকারগুলোই হচ্ছে মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, ‘অধিকারের প্রশ্নে মানুষ স্বাধীন ও সমান হয়ে জনুগ্রহণ করে এবং সব সময় সেভাবেই থাকতে চায়’ (Man are born and always continue free and equal in respect to their rights)।