ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। পৌরনীতি ও সুশাসনে অধিকার বলতে বোঝায় সমাজের সকলের জন্য কল্যাণকর কতগুলো সুযোগ-সুবিধা। অপরদিকে অধিকার ভোগের বিনিময়ে একজন নাগরিককে বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসব দায়িত্বকেই নাগরিকের কর্তব্য বলা হয়। অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই একজন নাগরিকের ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। নাগরিক জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়। অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। একমাত্র কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই অধিকার উপভোগ করা যায়। অধিকার ও কর্তব্য উভয়ই সমাজবোধ থেকে উদ্ভূত এবং উভয়েরই রক্ষক সমাজ। অধ্যাপক হ্যারল্ড জে. লাঙ্কি এজন্যই বলেছেন যে, ‘অধিকারের ধারণা কর্তব্যহীন হতে পারে না।’ 

অধিকারের সংজ্ঞা ও অর্থ (Definition and Meaning of Right): পৌরনীতি ও সুশাসনে অধিকার বলতে বোঝায় সমাজের সকলের জন্য কল্যাণকর কতগুলো সুযোগ-সুবিধা। অধিকার সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। অধিকার ব্যতীত ব্যক্তির জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। সুতরাং সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তি যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে তাই অধিকার। সমাজে বসবাসকারী সকল মানুষের পারস্পরিক স্বীকৃত দাবিই অধিকার। সমাজেই অধিকারের জন্ম এবং সমাজই এর রক্ষক। এজন্যই অধ্যাপক লাকি বলেছেন যে, “অধিকার সমাজ বহির্ভূত বা সমাজ নিরপেক্ষ নয়। অধিকার সমাজভিত্তিক।”

অধিকারের রক্ষাকবচ (Safeguard of Rights): বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং সুসভ্য সমাজ জীবনের জন্য অধিকার অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রই নাগরিকের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রবর্তন ও তা সংরক্ষণ করে থাকে। গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণের শর্তগুলোকে “অধিকারের রক্ষাকবচ” বলে। এগুলো নিম্নরূপঃ

১. আইন (Law): আইন হচ্ছে অধিকারের প্রধান রক্ষাকবচ। আইনের সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রয়োগের ফলে অধিকার নিশ্চিত হয়। আইন হচ্ছে অধিকার ভোগের আবশ্যকীয় শর্ত বা রক্ষাকবচ।

২. গণতন্ত্র (Democracy): গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকগণ নিজেরাই তাদের অধিকার সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়।

৩. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ঘোষণা (Declaration of Fundamental Rights): নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্রের সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে তা সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা লাভ করে। এর ফলে সরকার এ সমস্ত অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। নাগরিকগণ তাদের অধিকার ভোগ করতে কোনো প্রকার সরকারি বাধার সম্মুখীন হয় না।

৪. আইনের অনুশাসন (Rule of Law): নাগরিক অধিকার নিশ্চিত ও নিরাপদ করতে হলে যথার্থ আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের শাসনের অর্থ হচ্ছে আইনের চোখে ধনী, দরিদ্র, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই সমান। আইনের শাসন বলবৎ থাকলে সরকার স্বেচ্ছাচারমূলক গ্রেপ্তার বা আটক করতে পারে না।

৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (Independence of judiciary): নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে হলে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচ। স্বাধীন বিচার বিভাগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।

৬. জনগণের সজাগ দৃষ্টি (Eternal vigilance of the People): জনগণের সজাগ দৃষ্টি নাগরিক অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। প্রত্যেক নাগরিককে নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হলে কোনো শক্তিই নাগরিকের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অধ্যাপক লাস্কির মতে, “জনগণের সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টিই স্বাধীনতা বা অধিকারের সতর্ক প্রহরী।

৫. নাগরিকের তথ্য অধিকার (Rights to Information of Citizen): আইনানুগ কোনো প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা কর্তৃপক্ষের গঠন, উদ্দেশ্য, কার্যাবলি, দাপ্তরিক নথিপত্র, আর্থিক সম্পদের বিবরণ ইত্যাদিকে তথ্য বলা হয়। জনগণের অর্থে পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য জানার অধিকারই হলো ‘নাগরিক তথ্য অধিকার (Right to information for citizen)। তথ্য জানার এবং জানানোর অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই রয়েছে।

ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে বলা হয়েছে যে, “কোনো বিশেষ ঘটনা, পরিস্থিতি বা এরূপ কোনো কিছু সম্পর্কে ব্যক্তিগত অনুশীলন বা অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানই হচ্ছে তথ্য। অধিকার বলতে বোঝায় এমন কিছু যা মানুষ অন্যের কাছে বা রাষ্ট্রের কাছে আইনসম্মতভাবে দাবি করে থাকে।”

খ্রিস্টপূর্ব ৬০-২৭ সময়কালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আমলে তথ্য অধিকার-এর ধারণা বিকশিত হয়। ১৭৬৫- ৬৬ সালে ফিনিশীয় রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক এল্ডার্স সাইডিনিয়াস তথ্য অধিকারের ধারণা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তবে তথ্য অধিকার’ বিষয়টি আইনে পরিণত হয় সর্বপ্রথম সুইডিশ পার্লামেন্টে। ১৭৬৬ সালে সুইডিশ পার্লামেন্ট সর্বপ্রথম Ordinance on Freedom of Writing and of the Press’ নামে আইনটি পাস করে। এরপর ১৯৬৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ ভারত, ২০০০ সালে গ্রেট ব্রিটেন, ২০০৫ সালে জার্মানি; ২০১০ সালে পাকিস্তান এবং ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তথ্য অধিকার আইন পাস করে।

পৃথিবীতে সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক বলেই জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হলে সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

উপসংহারঃ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সহজাত মানবিক অধিকারগুলোই হচ্ছে মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, ‘অধিকারের প্রশ্নে মানুষ স্বাধীন ও সমান হয়ে জনুগ্রহণ করে এবং সব সময় সেভাবেই থাকতে চায়’ (Man are born and always continue free and equal in respect to their rights)।