প্রশ্নঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাস নদীর ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, তিতাস নদী নদীতীরবর্তী জেলেদের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তার বর্ণনা দাও।

অথবা, নদীর একটি দার্শনিক রূপ আছে— কথাটার তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাস তীরের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের মাধ্যমে মালােদের আশা আকাক্ষা, হতাশা, বেদনা মােট কথা তাদের ধ্বংসের বিস্ময়কর কাহিনির সঙ্গে যেসব সফল চরিত্র উপস্থাপনা অদ্বৈত মল্লবর্মণ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র তিতাস নদী। তিতাস নদীকে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা হয়।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক কেন্দ্রীয়ভাবে এমন কোনাে একটি চরিত্রকে বিকশিত করেননি, যাকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারতাে অন্যান্য চরিত্র। রচনাটিতে স্থান পেয়েছে তিতাস তীরের মালােদের জীবনের একের পর এক ঘটনা- তবে সেসব ঘটনা অনেকটাই তিতাস নদীকেন্দ্রিক। সে বয়ে যায় নিজের মতাে। তার মাছের ভাণ্ডার দিয়ে সে সাহায্য করেছে মালােদের। এবং এভাবেই এ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিতাস নদী থেকেছে ক্রিয়াশীল। ফলে, উপন্যাসটির অন্যতম চরিত্রে যেন রূপায়িত হয়েছে তিতাস নদী। কিন্তু তারপরও মানুষ নামক নিয়ন্ত্রকদের হাত থেকে তার রেহাই ঘটেনি। অর্থ ও ক্ষমতার জোরে মালাে পাড়া নিয়ন্ত্রিত করেছে ধনীরা, মহাজনরা।

তিতাসকে কেন্দ্র করেই এ উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্র বিকাশ লাভ করেছে। বস্তুত সাধারণভাবে তিতাস ছাড়া কোনাে চরিত্রই বিকশিত হয়নি। এর কারণ বিশেষ কোনাে চরিত্র সৃষ্টির জন্য লেখকের এ লেখা নয়। তার উদ্দেশ্য তিতাস তীরবর্তী মানুষের জীবনালেখ্য রচনা করা। সে জন্যই কিশাের, বাসন্তী, অনন্তর মা, অনন্ত, অনন্তবালা কেউই উপন্যাসে সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি। লেখক তাদের তিতাসের বহমান ধারার সঙ্গে একীভূত করে দেখতে চেয়েছেন। যত দিন তিতাস নদী ছিল গতিশীল তত দিন তিতাস তীরের মানষের ছিল প্রাণপ্রাচুর্যে উদ্দাম। এক সময় তিতাসের বুক চিরে জেগে উঠে মাটির ঢিবি। প্রায় একই সময় তিতাস তীরের বাসিন্দারা- হয়ে যায় উদাসীন, অন্যের সংকর- সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ভুলে যায়। তিতাস তীরের মানুষের জীবন তিতাস ছাড়া অচল বলেই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাস নদী পালন করেছে উল্লেখযােগ্য চরিত্রের ভূমিকা।

প্রকতপক্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মানুষ ও প্রকৃতিকে এক বিশাল ক্যানভাসে চিত্রায়িত করেছেন। তিনি এক আশ্চর্য শিল্পক্ষমতা ও সংযমের ঔদার্যে নির্মিত করেছেন তিতাসের অবয়ব। ঔপন্যাসিকের ভাষায়ঃ

“নদীর একটি দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে, কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই। নদীরও বহার শেষ নাই। কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্নভাবে বহিয়াছে। তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে। কত মানুষ মরিয়াছে। … তার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের, কত কান্নার রােল উঠিয়াছে। কত অশ্রু আসিয়া তার জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে। আর মালােদের ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ সে সবই গিয়া মিশিয়াছে তিতাসের জলে।”

তাই সার্বিক আলােচনা থেকে বলা যায়- তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস তীরের আনিক বৈশিষ্টোর সঙ্গে সঙ্গে এতদঞ্চলের মাললা সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা, হতাশা-বেদনা এবং উত্থান পতনের বিস্ময়কর কাহিনি শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করেছেন।