প্রশ্নঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে অনন্ত চরিত্র আলােচনা কর।

অথবা, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অনন্ত চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ তীরবর্তী অন্ত্যজ মানবপ্রবাহের ভাঙা-গড়ার ছন্দে আন্দোলিত জীবনের বিশাল ক্যানভাস অবলম্বিত হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১] রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৫৬) উপন্যাসে। বিষয়ভাবনা ও শিল্পরূপ বিচারে এ গ্রন্থ আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রায় শর্তই পূরণ করেছে। ভৌগােলিক সীমাসংহতি, মানবমনের ওপর ভূপ্রকৃতির সর্বাত্মক প্রভাব, মানুষে-প্রকৃতিতে অন্তরঙ্গ যােগ, জীবন-স্বাদের অনন্য একমুখীনতা ও সার্বভৌমতা যেমন এ উপন্যাসে বিদ্যমান, তেমনি চরিত্রায়ণ, দৃষ্টিকোণ ও ভাষাবিন্যাসে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক কাঠামাের জীবন প্রাণময় রূপ লাভ করেছে। মহাকাব্যিক ফ্রেমের মধ্যে যে জীবনকে রূপদান করেছেন ঔপন্যাসিক তা নদীর মতােই কখনাে বাঁকপরিবর্তনকারী, ভাঙন ও নির্মাণশীল।

অনন্ত চরিত্রের ক্রমবিকাশে উপন্যাসে এসেছে গতি; অনন্ত আছে উপন্যাসের অনেকাংশ জুড়ে। অনন্ত চরিত্র এ উপন্যাসে প্রায় নায়কের মর্যাদায় অঙ্কিত। এ চরিত্রকেই কেন্দ্র করে লেখকের জীবনদর্শন, একে কেন্দ্র করেই দুই সন্তানহীন নারীর স্নেহের লড়াই সংঘর্ষে গিয়ে পৌঁছেছে। তিতাস তীরের মানুষের জীবন বৃত্তের প্রতিনিধি অনন্ত।

‘খলা’ বাইতে গিয়ে কিশাের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে এবং মালাবদলের রীতিতে ‘গান্ধর্ব’ মতে তাকে বিয়ে করে। তাদের সন্তান অনন্ত শুকদেবপুর থেকে স্বামী কিশােরের সঙ্গে গােকনঘাটে ফেরার পথে ডাকাত কতৃক আক্রান্ত হয় তারা। কিশােরের স্ত্রী নিজেকে রক্ষা করার জন্য নদীতে ঝাপ দেয়। পরদিন নদী তীরে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পায় গৌর নিত্যানন্দ মালাে। এই মালােদের সংসারেই জন্ম হয় অনন্তর। অনন্ত ও তার মা গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ মালাে আশ্রিত। শৈশবেই অনন্তের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল এক অনুসন্ধিৎসু মন। চার বছর বয়সেই সে যেন তার নিজস্ব এক তৈরি করে নেয়। গােকনঘাটে যাওয়ার সময় অনন্ত তার সেই নিজস্ব ভূবনের যাবতীয় উপকরণ সঙ্গে নিয়েই নৌকায় ওঠে। শিশু সংগ্রাহক অনন্ত সপ্তকে ছিল ‘কয়েকটি ছবির টুকরাে, দেশলাইর খালি বাক্স, জাল বুনিবার দুই-একটা ভাঙ্গা উপকরণ, কিছু সুতা, ছেড়া একখানা ভক্তিতত্ত্বসার, এক টুকরা পেনসিল।’

নিজের গড়া এই রাজ্য ছেড়ে নতুন রূপকথার রাজ্যে যাত্রা অনন্তর। প্রথম নৌকায় চড়ে অভিভূত সে। এক সময় নদীর গল্প শুনে অনন্তর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠত; তখন গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ মালাে ভাবতে অনন্ত বড় হয়ে মস্ত জেলে হবে। আজ সেই নদী তার নিজ বিচরণ ক্ষেত্র যেন। সে আরাে বিস্মিত হয়ে দেখছে নদী ও প্রকৃতি। বড় গাঙের পাগল অনন্ত মায়ের কোল থেকে নেমে গিয়ে নদী দেখছে। নদীর তলদেশের বালিময় রূপ ও নানা ছােটো মাছ স্বচ্ছ পানিতে দৃশ্যমান। এ বিষয়ে উপন্যাসের এক স্থানে বলা হয়েছেঃ

“দুই-একটা শামুক হাঁটিয়াছে, তার রেখা বালির বুজে আঁচড় কাটিয়াছে। ছােটো ছােটো বেলে মাছ সে বালিতে কষ্ট লাগাইয়া চুপ করিয়া আছে….. আর সেই শামুক চলার দাগ, কম জল হইতে ক্রমে বেশি জলের দিকে চলিয়া গিয়াছে। ওখানটাতে কি রহস্য। নামিলে পায়ে মাটি ঠেকিবে না। আরাে একটু দূরে বুঝি ঐ দাড় দিয়াও মাটি ছোঁয়া যাইবে না। সেখানটাতে আরাে কত রহস্য!”

অনন্ত এই রহস্যের সন্ধান পায়নি, বিস্মিত মন নিয়েই পৌছে গেছে নতুন বসত গােকনঘাটে। নদীর এই বয়ে চলাকে সময়ের সঙ্গে, মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করেই ঔপন্যাসিক যেন বলেছেন, “সে তাে নদী নয়, হাজার বছরের না শােনা গল্প দুই তীরের বাঁধনে পড়িয়া একদিকে বহিয়া চলিয়াছে।”

অনন্তরাও যেন ঠিক সেই না শােনা গল্পের পাতার সঙ্গে নতুন একটা পাতা যােগ করেছে গােকনঘাটের মালাে সমাজে ঠাই পেয়ে। অজানা পরিবেশে কালােবরণের মা ও বাসন্তী অনন্তর মাকে সাহায্য করেছে নানাভাবে। মায়ের মৃত্যুর পর অনন্ত বাসন্তী মাসীর ওপর হয়ে পড়ে নির্ভরশীল। মাসীর বাবার অভাবের সংসারে অনন্তর অবস্থান সুখের হয়নি। উপায়হীন অনন্ত কখনাে কখনাে বাজার থেকে দোকানীর ফেলে দেওয়া পচা পান কুড়িয়ে আনত বাসন্তী মাসীর মায়ের জন্য। তাতে বাসন্তীর প্রতি তার মায়ের বকাবকি থামত না। এক দিন অনন্তর জন্যই মা মেয়েতে হাতাহাতি হয়। মা-মেয়ের সম্পর্কের এই অবনতির মুখে অনন্তর প্রতি বাসন্তীর স্নেহ ভাটা পড়ে। ফলে অনন্ত পাড়ি জমায় অন্যত্র।

নদী ও কাল বলে চলে বিরতিহীন। ঐ তিতাসের সঙ্গেই অনন্তর সাক্ষাৎ; ফলে নদী তিতাস ও মানুষ অনন্ত অন্তহীন গতি প্রবাহের মধ্যে মিশে গেছে। এই নদী প্রবাহই যেন অনন্তর জীবনে এক নিয়ামক, তাকেও তাই চলতে হয়েছে পথে, পথে। মাসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এক গন্তব্যহীন পথে তাকে যেদিন পড়তে হয়েছে সেদিনও নদীর সঙ্গে তার যেন সূচিত হয়েছে এক গভীর সম্পর্ক। গােকনঘাটে আসার পথে নৌকায় মায়ের কোলে বসে যে কল্পনাচারিতায় অনন্ত নৌকার অস্তিত্ব ভুলে লক্ষ করেছিল নদীর প্রবহমানতা, আজও তেমনি গভীর মনােনিবেশে সে দেখলাে নদী-

“এখান হইতে সােজা দক্ষিণ দিকে নদীর গতি। চাহিলে শেষ অবধি দেখা যায়, বহু দূর দূরান্তর হইতে দক্ষিণের রাজ্য হইতে কেউ বুঝি ঢেউ চালাইয়া দেয়, সেই ঢেউ আসিয়া লাগে অনন্তর এই নৌকাখানাতে সেদিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া থাকে।”

ভাঙা নৌকার আশ্রয় ছেড়ে অভিমানী অনন্ত আর ফেরেনি বাসন্তী মাসীর কাছে। এখন থেকেই পরিচিত বনমালী অনন্তকে নিয়ে যায় নবীনগরে। নবীনগর গ্রামে উদযাপিত পূজাপার্বণের মাধ্যমে অনন্তের মানস সংগঠনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এ গ্রামে এসে কিশােরী অনন্তবালার সঙ্গে সে হার্দ্য সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ হয়। এ সম্পর্ক ক্রমশ বিস্তারিত হয় পত্র পল্লবে। অনন্তের বেদনাময় অথচ চির উৎসুক জীবনযাত্রায় এ সম্পর্ক হয়ে ওঠে মহার্ঘ্যস্বরূপ। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘রামধনু’। এ অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিঃস্ব বালক অনন্তের অসহায় উদাস ও কল্পনাপ্রবণ মনােদৃষ্টিকেই কেবল উপস্থাপন করেছেন। মায়ের মৃত্যুর পর, এরকম উদার সংবেদ জীবনপরিবেশে অনন্ত আশ্রয় খুঁজে পায়। অর্থনৈতিক অনটন সত্ত্বেও বাসন্তী মাতৃস্নেহে আগলে রাখে অনন্তকে। কিন্তু বালক অনন্ত অনন্তপথের অভিযাত্রিক। সংসারের সীমাবদ্ধ আঙিনা ছেড়ে সে ছড়িয়ে পড়তে চায় প্রকৃতির বিশাল সৌন্দর্যলােতে এ উপন্যাসে মায়ের মৃত্যুর পর অনন্তের বাধা বন্ধনহীন স্বেচ্ছাবিহারী অবস্থাকেই শুধু চিত্রিত করেননি লেখক, সে বর্ণিত হয়েছে, মায়ের মৃত্যুর পর মাসাধিক পালিত হবিষ্য প্রথা। বনমালীর দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাসঙ্গিক এলাকা উদ্ধৃতি যােগ্য।

“ছেলেটার গায়ের রঙ ফর্সা। কিন্তু খড়ি জমিয়া বর্ণলালিত্য নষ্ট করিয়া দিয়াছে। এক চিলতা সাদা মাঠা কাপড় কটিতে জড়ানাে। আর এক চিলতা কাঁধে। বিঘৎ পরিমাণ একখানা কুশাসন ডানহাতের মুঠায় ধরা। নৌকা গড়িবার সময় তক্তায় তক্তায় জোড়া দেয় যে দুই মুখ সরু চ্যাপ্টা লােহা দিয়া, তারই একটা দুই মুখ এক করিয়া কার্পাস সুতায় গলায় ঝলানাে। পিতামাতা মারা যাওয়ার পর মাসাবধি হবিষ্য করার সন্তানের এই সমস্ত প্রতীক।”

মাতৃশ্রাদ্ধের দিন কয়েক পর গােকনঘাট পরিত্যাগ করে অনন্ত চলে যায় নবীনগর গ্রামে উদয়তারার পিত্রালয়ে। অনন্তকে কেন্দ্র করে বাসন্তীদের পারিবারিক কলহ যখন চরমে, তখন উপায়হীন বাসন্তীর তীব্র ভৎসনায় অতিষ্ঠ হয়ে অসহায় অনন্ত আশ্রয় নেয় উদয়তারার কাছে। স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনন্তের দৃষ্টিপথে উন্মােচিত হয় নতুন দিগন্ত।

নবীনগর গ্রামের নতুন পরিবেশে অনন্তের কিশাের মন নিত্যনব অভিজ্ঞতায় আন্দোলিত হয়। এ গ্রামের এক বৃদ্ধ বৈষ্ণব বৈষ্ণববাচিত বাৎসল্যরসে বিভাের হয়ে অনন্তের মধ্যে যশােদাদুলাল ও শচীনন্দনের সাদৃশ্য অনুভব করে। এ বৃদ্ধ বৈষ্ণবের সংস্পর্শ অনন্তকে দেয় অনুভববেদ্য কল্পনাশক্তি। এ গ্রামে শ্রাবণ মাসব্যাপী মনসার গান, পদ্মপুরাণপাঠ, বেহুলার চির-এয়ােতির স্মারক উৎসবরূপে ‘জালা-বিয়া’-র আয়ােজন এবং তজ্জনিত হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে অনন্তের কিশােরহৃদয়, উদ্দীপিত ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

নৌকায় বনমালীর বােন উদয়তারার কোলে শুয়ে গভীর রাতে আকাশের তারা আর প্রকৃতির রূপ দেখে অনন্ত বিস্ময়বােধ করে। জলের মধ্যে তারার ছায়া দেখে অনন্তর মনে পড়ে জলের তলের রহস্যের কথা। মায়ের কাছে শােনা সিন্দাবাদের দৈত্যের কাহিনি, আরব্য উপন্যাসের কল্পকাহিনি, আকাশ থেকে ধপাস ধপাস করে পড়ে চারদিক কাপিয়ে দেও-দৈত্য আসার গল্প। আকাশের রহস্য প্রসঙ্গে নানা নােক কথা, লােক বিশ্বাস, সংস্কার, স্মৃতি-পুঞ্জিত কিংবদন্তী, দেব দেবীর কথা একাকার করে উপন্যাসে যেন অন্য এক নতুন কল্পলােকের সৃষ্টি করা হয়েছে। কল্পনাবিলাসী অনন্ত উদয়তারার কোলে বসে কল্পনা করেঃ “নদীর স্রোত তাহাকে দেশ দেশান্তরে ভাসাইয়া নিবে, ঢেউ তাহাকে দোলা দিবে।”

সে নিবিড় অন্ধকারে একমাত্র অনন্তই জেগে থাকবে, আর জেগে থাকবে জলের মাছ। এ প্রসঙ্গে একজন সমালােচক বলেছেন, “অনন্ত জীবন প্রবাহ আর এই নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝখানে নদীর মতােই অনাদি অনন্ত সচল বর্তমানে, আকাঙ্ক্ষা অনন্তর। আর তার দৃষ্টিভঙ্গিতেই উপন্যাসে বাস্তব আর পরাবাস্তব যেন অন্তহীন সমান্তরলতার জন্ম দিয়েছে।” এ ঔপন্যাসিক বার বার রঙধনু দেখিয়েছেন অনন্তকে। লেখক যেন জীবনের রূপকে প্রতীকী পরিচর্যার মাধ্যমে। দেখানাের চেষ্টা করেছেন। রঙধনুর আগমন ও প্রস্থানের আকস্মিকতার মতােই অনিশ্চিত যেন গােকনঘাটের মালাে-জীবনের পরিস্থিতি। প্রকৃতিতে যখন রঙধনু ওঠে তখন জীবনেও তা ব্যাপ্ত হয়, সে কারণে তিতাস ত শুধু একটি নদীর নাম নয়, সে যে মৃত্তিকা ও মানুষের কাহিনিকেও বুনে চলে।

অনন্ত মেধাবী ছাত্র। তার প্রতিভায় মালােরা মুগ্ধ। সকলে অনন্তর ব্যাপারে তাই পোষণ করতে থাকে উচ্চাশা। অনন্তকে মালােরাই ভর্তি করিয়ে দেয় গােপালখালি মাইনর স্কুলে। চিঠি লিখতে, তমসুকের খত লিখতে, বেপারীর সঙ্গে মাছের খাতার হিসাব লিখতে মালােদের যেতে হয় হরিদাস সারের কাছে। তাকে অনেক অনুরােধ করে, বড় বড় মাছ দিয়ে, টাকা দিয়েও অনেক সময় কাজ পেতে কষ্ট হয়। মালােদের এই অভাব মেটানাের দায়িত্ব যেন বর্তায় অনন্তর কাঁধে। কিন্তু লাভ হয়নি মালােদের। নাপতানীর পরামর্শে আর নিজ আগ্রহে উচ্চ শিক্ষার আশায় অনন্ত চলে যায় শহরে। নবীনগরে এসে অনন্তর সঙ্গে পরিচয় ঘটে অনন্তবালার। অনন্তবালা সেই বাল্য বয়সেই কথার বাঁধনে বাঁধতে পেরেছিল অনন্তকে, সে তাকে তার আগামী দিনের বর মনে করেছিল। কিন্তু অনন্তবালার ইচ্ছার প্রতি অনন্তর কোন সমর্থন ছিল না। সে কথা অনন্তবালা মনে হয় বুঝেছিল; অনন্তর লেখাপড়ার আগ্রহের কাছে অনন্তবালার ভালােবাসার আহ্বান ছিল একটি গৌণ বিষয়। তবু অনন্তবালা সম্ভবত অনন্তর আশাতেই রাজি হয়নি অন্যত্র বিয়ে করতে। অনন্তবালার বাবা এক রকম বিরক্ত হয়েই বনমালীকে পাঠায় কুমিল্লা শহরে অনন্তর কাছে। সেখানে অনন্তর বেশভূষা দেখে বনমালী হয়ে যায় সঙ্কুচিত। চলে আসার সময় তার স্বগতােক্তি শুনে ফেলে অনন্ত। অবশেষে অনন্ত যথােচিত সামাজিকতা করেই আপ্যায়ন করে বনমালীকে, ভদ্রতা করে কতকগুলাে কাপড় কিনে দেয় গ্রামের লােকদের জন্য। কিন্তু অনন্ত একবারও অনন্তবালার নাম মুখে আনেনি; এবং বনমালী এ সম্পর্কে কোন কথা অনন্তকে বলতে সাহস করেনি। এমনকি জীবিকার অভাবে যেদিন মালােরা ধ্বংসের মুখে, সে দিনও তাদের বাঁচাতে আসেনি অনন্ত।

সুতরাং সার্বিক বিচারে বলা যায়- উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে মহামারীর মতাে মৃত্যু এসে মালােদেরকে নিশ্চিহ্ন ও সর্বস্বান্ত করে দেয়। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে কোনাে রকমে টিকে থাকে বাসন্তী আর কিশােরের বৃদ্ধ, পিতা রামকেশব। অনন্ত কুমিল্লার শাহরিক পরিবেশে শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠলেও গােকনঘাটের মালাে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরুদূর। লেখাপড়া শেখার ফলেই সে যেন শ্রেণিচ্যুত হয়ে উঠে গেছে ওপরের শ্রেণিতে। রামকেশব ও বাসন্তীর অন্তিম সময়ে মানব কল্যাণের নামে তাদের মুখােমুখি হলেও পরিচয় গােপন করেছে অনন্ত। মূলত শেষ পর্যন্ত অনন্ত হয়ে পড়েছে শ্রেণিচ্যুত-উচ্চবিত্ত শ্রেণির অধিকারী একটি চরিত্র- যার সাথে তিতাসতীরবর্তী জেলেদের কোনাে সম্পর্কই আর অবশিষ্ট ছিল না।