অথবা, তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে জেলেপাড়ার বর্ণনা প্রসঙ্গে মাঝিদের জীবন ও জীবিকার বর্ণনা দাও।
অথবা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে দারিদ্র্যপীড়িত মালােদের যে জীবন ও জীবিকার বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা বর্ণনা কর।
অথবা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে তিতাস তীরবর্তী মানুষের জীবনচিত্রের বর্ণনা দাও।
অথবা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের আলােকে তিতাস উপকূলের সমাজচিত্রের পরিচয় দাও।
অথবা, “অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে মূলত অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন-কাহিনি রূপায়িত হয়েছে।”- এ সম্পর্কে তােমার মতামত উপস্থাপন কর।
উত্তরঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অবজ্ঞাত নিরক্ষর জনজীবন নির্ভর ধ্রুপদী উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণ [১৯১৪ ১৯৫১]-এর এ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল রত্ন। অদ্বৈত প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হচ্ছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ [১৯৫৬]। নদী-তীরবর্তী অন্ত্যজ মানবপ্রবাহের ভাঙা-গড়ার ছন্দে আন্দোলিত জীবনের বিশাল ক্যানভাস অবলম্বিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এ উপন্যাসটি সমগ্র বিশ্বের নদীমাতৃক জেলে জীবনােপাখ্যানের মহাকাব্য। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির মানবিক ও সর্বজনীন আবেদনে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। উপন্যাসটির সমাজচিত্র-জেলেজীবন পাঠককে এমনভাবে মােহবিষ্ট করে রাখে যে- উপন্যাসটি পাঠের সময় মনে হয়ে কোনাে জেলেপল্লির মধ্য দিয়ে পাঠক হেঁটে চলেছে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরবর্তী জেলে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা, কর্ম-ধর্ম-স্বপ্ন-সংস্কৃতিভিত্তিক জীবন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রচেষ্টা, ঈর্ষা, কামনা-বাসনা, পূজা-পার্বণ-উৎসব ও রীতিনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে একটি নিম্নবর্গ জনপদের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত উপন্যাসে উঠে এসেছে। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসের মধ্যে জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের মতাে চরম প্রাকৃতিক বিষয়গুলােকেও দক্ষতার সাথে তুলে এনেছেন। তাছাড়া জেলে সমাজের প্রতিটি প্রথা, পূজা, লােকজ নিয়মকানুন, বিশ্বাসকে তিনি দক্ষহাতে তুলে ধরেছেন পাঠকের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সব প্রবণতা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের সকল জেলেদের সরলতা ও নদী নির্ভরতা।
এ উপন্যাসে অন্যের নৌকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সুবলের মতাে দরিদ্র জেলে থেকে শুরু করে উজানিনগরের বাশিরাম মােড়লের মতাে ধনী প্রতাপশালী জেলেদের কথা ঔপন্যাসিক দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। একইসঙ্গে উপস্থাপন করেছেন জেলে নারীদের অন্তহীন জীবনসংগ্রামের গল্প। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসের রং রেখা স্বভাব দার্শনিকতামণ্ডিত করে পরিবেশন করেছেন। ‘প্রবাস খণ্ডের’ শুরুতে তিনি মালােপাড়ার অবস্থা অবস্থান, ঘর গেরস্থালির স্বরূপ অঙ্কন করেছেন এভাবেঃ
“তিতাস নদীর তীরে মালােদের বাস। ঘাটে বাঁধা নৌকা, মার্টিতে ছড়ানাে জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তকলি সুতা কাটার, জাল বােনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালােদের সংসার।
নদীটা যেখানে ধনুকের মত বাকিয়াছে, সেইখান হইতে গ্রামটার শুরু। মস্ত বড় গ্রামটা তার দিনের কলরব রাতের নিশুতিতেও ঢাকা পড়ে না। দক্ষিণপাড়াটাই গ্রামের মালােদের।”
মালােপাড়ার দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, বঞ্চিত, বিড়ম্বিত ও নিগৃহীত ধীবর সম্প্রদায়ের একটি পূজাব্রতকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাংশ উন্মােচন করেছেন লেখক। এ পূজাতের নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত। এ ব্রতের স্থায়িত্বকাল সারা মাঘ মাস। এ মাসে কুমারী কন্যারা প্রার্থিত বরের আকাঙ্ক্ষায় এ পূজা করে। এতদৃপ্রসঙ্গে লেখকের বর্ণনাংশ লক্ষণীয়ঃ
“এ পাড়ার কুমারীরা কোনকালে অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢােল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু এই বিবাহের জন্য তারা দলে দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে। মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে, প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিড়ি পূজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াছে; লও লও সুরুজ ঠাকুর লও স্কুটার। জল, মাপিয়া পুখিয়া দিব সপ্ত আজল। আজ তাদের শেষ ব্রত।
তরুণ কলাগাছের এক হাত পরিমাণ লম্বা করিয়া কাটা ফালি, বাঁশের সরু শলাতে বিধিয়া ভিত করা হয়। ভিতের উপর গড়িয়া তােলা হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি ঘর। আজিকার ব্রত শেষে ব্ৰতিনীরা সেই চৌয়ারি মাথায় টাকা তিতাসের জলে ভাসাইবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢােল কাসি বাজিবে, নারীরা গীত গাহিবে।”
মাঘমণ্ডলের ব্রত উৎসবে দীননাথ মালাের সপ্ত বর্ষীয়া কন্যা বাসন্তীর প্রতি অনুরাগবশত কিশাের আর সুবল কর্তৃক চৌয়ারি নির্মাণকে উপলক্ষ্য করে এ উপন্যাসে তিতাস তীরবর্তী ধীবর পল্লির একটি চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। দুঃখ দারিদ্র্য, হতাশা-বঞ্চনার মধ্যেও মালােরা এসব উৎসব অনুষ্ঠানকে সযত্ন পরিচর্যায় টিকিয়ে রেখেছে।
অধিকাংশ মালাে-শিশু পাঠশালা বিমুখ। মৎস্যই যেহেতু তাদের জীবিকার প্রধান উপকরণ, সেহেতু পাঠশালায় হাতেখড়ির পরিবর্তে তাদের হাতেখড়ি হতাে নাও-জালে। স্বল্পকাল ব্যবধানে তারা হয়ে উঠতাে নিপুণ জেলে। তাই শৈশব-কৈশােরের আনন্দমুখর দিনগুলােতেও তারা গৃহকোণ অলস ও নিশূপভাবে সময়ক্ষেপণ না করে মৎস্য শিকারের জন্য তিতাসে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু তিতাসে মাছের পরিমাণ অফুরন্ত নয়। হয়ত তাই প্রাণরক্ষার তাগিদে তারা শরণাপন্ন হয় অন্য নদীর। কিশাের ও সুবলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। একদিন তারাও প্রবীণ জেলে তিলকচাদকে নিয়ে অধিক। উপার্জনের প্রত্যাশায় শুকদেবপুরের উজানিনগরের খলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যথাসময়ে তারা উপনীত হয় বাঁশিরাম মােড়লের ঘাটে। এখানে মােড়ল পরিবারের সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতায় তারা মুগ্ধ হয়। কিশােরের মনে হয় তিতাস তীরের মনুষ্য প্রকৃতির চেয়ে এখানকার মনুষ্যপ্রকৃতি কিছুটা অন্যরকম।
একটি আঞ্চলিক উপন্যাসের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পটভূমির সঙ্গে লেখকের অন্তরঙ্গ সংশ্লিষ্টতা। তিতাস নদীর উৎসস্থল ও মােহনার মাঝামাঝি সাদকপুর থেকে নবীনগর, গােকনঘাট, আমিনপুর, বিরামপুর, ভৈরববাজার, নয়াকান্দা, শুকদেবপুর, উজানিনগর পর্যন্ত বিস্তৃত নদীর প্রবাহ পথই এ উপন্যাসের নির্বাচিত ভৌগােলিক পরিবেশ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বলা আছে যে, ‘ঝড় তুফানের রাতেও তিতাসের বুকে মাছ ধরতে যাওয়া স্বামীপুত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয় না স্ত্রীরা, মায়েরা। কারণ, তিতাস প্রকৃতিতে শান্ত। উপন্যাসটির কাহিনি বা ঘটনার সূত্রপাত ঘটে পূজা ব্রতকে কেন্দ্র করে, দিননাথ মালাের মেয়ে বাসন্তীর মাঘমণ্ডলের ব্রতে চৌয়ারি বানানাে এবং ভাসানাে নিয়ে। এ পূজার মাধ্যমে কুমারী মালাের কন্যারা উপযুক্ত বর প্রার্থনা করা। কিশাের ও সুবলের মাধ্যমে তৈরি হয় বাসন্তীর চৌয়ারি। তা কেন্দ্র করেই দূরন্ত দুই বালকের অনুরাগ জন্মে বাসন্তীর প্রতি। কুমারী কন্যাদের জন্য চৌয়ারি ব্যবস্থার মাধ্যমে বর প্রার্থনা জেলেদের রীতি। শত দুঃখবেদনার মধ্যে তারা তাদের এ উৎসব অনুষ্ঠান করে থাকে। এখানে এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির ঘটে স্বাভাবিক যােগাযোগ।
শুকদেবপুরে অবস্থান করার মধ্যে যেন কিশােরের জীবনবােধের পরিবর্তন ঘটে। সেখানে খলা বাইতে যাওয়া আসার। পথে নদী প্রকৃতির বহু বিচিত্র রূপ কিশাের সুবলের জীবনের সঙ্গে যেন নিবিড়ভাবে সংশ্নিষ্ট হয়ে পড়ে। নদী পথেই তারা সেখানে উপস্থিত হয়েছে। নদীকে অবলম্বন করেই যেন কিশাের লাভ করেছে সুন্দরী নর্তকী, স্ত্রী। আবার নদী পথেই ডাকাত হরণ করেছে তার স্ত্রী ও অর্থ। নদী পথ অথবা নদীনির্ভর জীবন প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ। মেঘনার যে মােহনায় তারা বিপদগ্রস্ত হলাে সেটিও বিপদসঙ্কুল। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বলা আছেঃ
“মােহনাটি সত্যই ভয়ংকর। এপার হইতে ওপারের কূল কিনারা চোখে ঠাহর করা যায় না। হু হু করিয়া চলিতে চলিতে স্রোত এক একটা আবর্তের সৃষ্টি করিয়াছে। দুই ধারের স্রোত মুখখামুখি হইয়া যে ঝাপটা খাইতেছে, তাহাতে প্রচণ্ড শব্দ করিয়া জল অনেক উপরে উঠিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে।”
নদীই যেন বাসন্তীকে ভাসিয়ে এনেছে সুবলের কাছে। আবার সে নদীই কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। নদীর উত্থান পতনের ঢেউই যেন সুখ দেয়নি বাসন্তীকে। স্বামীর মৃত্যুতে তাকে আজীবন থাকতে হয়েছে বিধবা। নদীই তার দুঃখের মূল। চার বছর পর কিশােরের স্ত্রীর অনন্তসহ গােকনঘাটে ফিরে আসা এ উপন্যাসের উল্লেখযােগ্য বাক। বাসন্তীকে কেন্দ্র করে লেখক জেলেপল্লির একটি নতুন সমাজের পরিচয় দিয়েছেন। যেমনঃ
“অবশেষে উঠিল অনন্তর মার কথা। তার বুক দূর দূর করিতে লাগিল। এ কথাটাও ভারতকেই তুলিতে হইল, নতুন যে লােক আসিয়াছে, আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন। তারে নিয়া কীভাবে সমাজ করিতে হইবে আপনারা বলিয়া যান। তারে কার সমাজে ভিড়াইবেন, কিষ্ট কাকার, না দয়াল কাকার, না বাসন্তীর বাপ কাকার…. রামপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিল, কারে কারে লইয়া তাের সমাজ? সুবলার শ্বশুর আর কিশােরের বাপেরে লইয়া। তা হইলে নতুন মানুষ লইয়া তাের সমাজ হইল চাইর ঘর। হ কাকা।”
তিতাসকে কেন্দ্র করে বাংলার সংস্কৃতি উদ্ভাসিত হয়েছে। তিতাসে নৌকা বাইচের কথা উল্লেখ করা যায়। উপন্যাসের ‘রাঙা নাও’ পর্বটি নৌকা বাইচ নিয়ে রচিত। ঔপন্যাসিক এ পর্বে নৌকা বাইচের সাথে বাংলার মানুষের জীবন প্রবাহের চিত্র অঙ্কন করেছেন। এ চিত্র গ্রাম বাংলার জীবন্ত চিত্র। গ্রাম বাংলার নৌকা বাইচের চিত্র জীবনকে দোলায়িত করে। ঔপন্যাসিকের ভাষায়ঃ
“সবে বেলা পড়িতে শুরু করিয়াছে। প্রতিযােগিতা শুরু হইবে শেষ বেলার দিকে। এখন দৌড়ের নৌকাগুলি ধীরে সুস্থে বৈঠা ফেলিয়া নানা সুরের সারিগান গাহিয়া গাঙময় এধার ওধার ফিরিতেছে। হাজার হাজার দর্শকের নৌকা হইতে দর্শকেরা সে সব নৌকার কারুকার্য দেখিতেছে, বৈঠা মারিয়া কি করিয়া উহার জলের কুয়াশা সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা দেখিতেছে। এক সঙ্গে এতগুলি দৌড়ের নাও দেখিয়া অনন্তর বুক আনন্দে লাফাইয়া উঠিল।”
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে বলা হয়েছে, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা মিথ্যা রােমান্টিকতা বা সত্যের ছলনা হইতে মুক্ত। তাহার মানস প্রকৃতি, আনন্দ, বিষাদ সমস্তই সহজ জীবন রসিকতার ও নিগূঢ় অনুভবের পরিচয় বহন করে। তাছাড়া এ উপন্যাসে করমালী ও বন্দে আলীর জীবনভাষ্যে জেলেদের সুখ-দুঃখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। যেমনঃ
“খাওয়ার পর কাধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দে আলী বলে, “ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম ঝাগুর মাছের ঝােল। আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাক-ভাত আজ জুটল নি, কি জানি?
করমালী বলে, বন্দালী ভাই, কইছ কথা মিছা না। তােমার আমার ঘরের মানুষ! তােমার আমার ঘরই নাই তার আবার মানুষ। দয়া কইরা রাইতে থাকতে দেয় কি খায়, কি করে কোনােদিননি খোঁজ রাখতে পারছি? তা যখন পরছি না। তখন তােমার আমার কিসের ঘর আর কিসের মানুষ।”
মালােদের জীবন চিত্র সুবলের বাবা গগন মালাের অবস্থা বর্ণনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমনঃ
“সুবলের বাপ গগন মালাের কোনাে কালে নাও জাল ছিল না। সে সারাজীবন কাটাইয়াছে পরের নৌকায় জাল বাহিয়া। যৌবনে সুবলের মা ভৎসনা করিত, এমন টুলাইনা গিরস্তি কত দিন চালাইবা! নাও করবা, জাল করবা, সাউকারি কইরা সংসার। চালাইবা! এই কথা আমার বাপের কাছে তিন সত্য কইরা তবে ত আমারে বিয়া করতে পারছ। স্মরণ হয় না কেনে?”
কিন্তু নিশ্চেষ্ট লােকে ভৎসনা করিয়া ফল পাওয়া যায় না- ‘খাইবা বুড়াকালে পরের লাথি উষ্ঠা; যেমন মানুষ তুমি।’
গগন এসব কথায় কর্ণপাত করে নাই। বুড়া কাল যখন সত্যিই আসিল, তখন বলিত, “অখন বুঝি নি? ইহার উত্তরে গগনচন্দ্র বলিত, “আমার সুবল আছে। আমি ত করতাম পারলাম না, নাও জাল আমার সুবলে করব। অত ভেন নে করিস না।”
কিন্তু সুবল দরিদ্র। তার নৌকা ও জাল কেনার সামর্থ্য নেই। এ চিত্র গ্রামবাংলার দরিদ্র জেলের বাস্তব জীবন চিত্র। অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্বীয় গােষ্ঠীর জীবন চিত্র অঙ্কন করেছেন হৃদয়ের শিল্পীর তুলির আঁচড়ে। শুধু মালােরাই নয়, তিতাস তীরের মুসলমানদের জীবনের সঙ্গেও নদীর সংযুক্ত গভীরভাবে। তিতাসকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনও আবর্তিত। কাদির মিয়া ছাদির মিয়ার মাধ্যমে সে নির্ভরশীলতার চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য আলু বাজারে নেওয়া হয় নদী পথেই। সে সময়ের তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদীর ছবি উপন্যাসের উপস্থাপিত হয়েছে বাস্তবভাবে। জন্ম-মৃত্যু বিয়ের ক্ষেত্রে মালাে সমাজের নিয়ম নীতি, ধর্মাচার, এমনকি মায়ের মৃত্যুর পর সন্তানের হবিস্যি পালনের প্রথাও উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক।
এ উপন্যাসে উপস্থাপিত প্রধান পাত্র-পাত্রীরা নিম্নবর্ণের হিন্দু। এছাড়া রয়েছে অবস্থাপন্ন মুসলমান পরিবারের কথা। তিতাস পাড়ের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রদায়গত পার্থক্য যতই থাক, মনের দিক থেকে তারা ছিল একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল। পক্ষান্তরে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মনের প্রান্তে ঠাই দেয়নি, শুধু তাদের শােষণই করেছে। লেখকের মন থেকে সমবেদনা উৎসারিত হয়েছে এ সব বিত্তহীন নিম্ন শ্রেণির মানুষের প্রতি। নদীকে ঔপন্যাসিক ব্যবহার করেছেন দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান জনগােষ্ঠীর সহানুভূতি সমবেদনার মিলন মেলা হিসেবে। এবং এটি দেখা যায় নানা ঘটনার মাধ্যমে, বিশেষকরে বনমালী ধনঞ্জয়ের কাদিরের প্রায় ডুবে যাওয়া আলুর নৌকা উদ্ধারের চিত্রের মধ্য দিয়ে।
উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে মহামারীর মতাে মৃত্যু এসে মালােদেরকে নিশ্চিহ্ন ও সর্বস্বান্ত করে দেয়। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে কোনাে রকমে টিকে থাকে বাসন্তী আর কিশােরের বৃদ্ধ পিতা রামকেশব। অনন্ত কুমিল্লার শাহরিক পরিবেশে শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠলেও গােকনঘাটের মালাে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরুদূর। অনন্তবালারা চলে যায় আসামে। নিস্তব্ধ ও প্রায়লুপ্ত বিশাল মালােপাড়া কালের সাক্ষী হয়ে হতশ্রী রূপ নিয়ে পড়ে থাকে। উপন্যাসের একেবারে অন্তিমে লেখক মালােপাড়ার যে হতদশা অঙ্কন করেছেন তা একান্তভাবে হৃদয়স্পর্শীঃ
“ধানকাটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধানগাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাঁতার জল। চাহিলে কারাে মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জলে থই থই করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর। হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালােপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সে মালােপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালােপাড়া আর নাই। শূন্য ভিটাগুলিতে গাছ গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া সাে সাে শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দের তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।”
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে মূলত অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন-কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। এ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মানসের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণনার সঙ্গে জেলেদের জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
Leave a comment