প্রশ্নঃ অতি দূরবর্তী ক্ষতি বলতে কি বুঝ? দেওয়ানী ক্ষতি সংক্রান্ত আইনে কি অবস্থায় ক্ষতি অতি দূরবর্তী বলে গণ্য হয় তা বিশদভাবে আলোচনা কর।

অতি পরোক্ষ ক্ষতি বা অতি দূরবর্তী ক্ষতিঃ যেক্ষেত্রে বাদীর ক্ষতি বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল নয় কিংবা বাদীর ক্ষতি ও বিবাদীর কার্য—এ দু’য়ের যোগসূত্র যথেষ্ট প্রত্যক্ষ নয় সেক্ষেত্রে বাদীর ক্ষতিকে বলা হয পরোক্ষ ক্ষতি বা অতি দূরবর্তী ক্ষতি। পরোক্ষ ক্ষতি বা অতি দূরবর্তী ক্ষতির জন্য বিবাদীকে দায়ী করা যায় না। “In jure non remota causa sed proxima spectator” আইনে প্রত্যক্ষ বা নিকটবর্তী কারণ গ্রহণযোগ্য, অতি পরোক্ষ কারণসমূহ বিবেচ্য নয়। 

প্রত্যেক ব্যক্তি তার অন্যায় কার্যের জন্য দায়ী কিন্তু এ দায়িত্ব সীমাহীন নয়। যে কোন কার্যের পরিণতি অসীম কিন্তু অপকর্মের দায়িত্ব সীমাহীন করলে সমাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতো। তাই এক ব্যক্তির লাঠির আঘাতে যদি কাউকে সামান্য আহত করে তবে সে আঘাতের জন্য উক্ত ব্যক্তি দায়ী, কারণ আঘাতের প্রত্যক্ষ ফল আহত হওয়া। কিন্তু আহত ব্যক্তির অসাবধানতার দরুন বা ভুল চিকিৎসার জন্য উহা মারাত্মক রূপ ধারণ করলে এবং পরে অস্ত্রোপচারের সময় চিকিৎসকের অবহেলার দরুন যদি উক্ত ব্যক্তিটি মারা যায় তবে কি তার মৃত্যুর জন্য লাঠির আঘাতকারী দায়ী হবে ? লাঠির আঘাতের প্রত্যক্ষ ফল মৃত্যু নয়; প্রত্যক্ষ ফল আহত হওয়া এবং আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির অসাবধানতা, ডাক্তারের হস্তক্ষেপ এবং শেষে মৃত্যু—সবই পরবর্তী ঘটনা। লাঠির আঘাত ও মৃত্যুর মধ্যে অনেক হস্তক্ষেপ হয়েছে। কাজেই মৃত্যু এখানে লাঠির আঘাতের প্রত্যক্ষ ফল নয়, অতি পরোক্ষ বা দূরবর্তী ক্ষতি।

দূরবর্তী ক্ষতির বিধিসমূহ (Rules regarding remoteness of damage): রিপলেমিস নীতি বা প্রত্যক্ষ ফল এবং ওয়াগণ মাউণ্ড নীতি বা দূরদর্শিতা টেষ্ট দ্বারা দূরবর্তী ক্ষতি নির্ণিত হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্তে নিম্নলিখিত বিধিগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-

(১) বাদীর ক্ষতি যদি বিবাদীর ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে তবে তা কখনো অতি দূরবর্তী হতে পারে না। প্রত্যেক কার্যের প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক পরিণতি কার্য সম্পাদনকারীর অভিপ্রেত বলে আইন ধরে নেয়। এক্ষেত্রে ফল ও কারণ যোগসূত্র ছিন্ন করার মত তৃতীয় হস্তক্ষেপ অবর্তমান। তাই এক্ষেত্রে বাদীর ক্ষতি বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল। 

(২) বাদীর ক্ষতি যদি বিবাদীর কার্যের সম্ভাব্য ও প্রয়োজনীয় ফল না হয় কিংবা কার্য সম্পাদনের সময় বিবাদী তা অনুধাবন না করে থাকে তবে তা অতি দূরবর্তী ক্ষতি।

(৩) যদি তৃতীয় পক্ষের কোন স্বাধীন হস্তক্ষেপ বিবাদীর কার্য ও বাদীর ক্ষতি-এ দু“য়ের যোগসূত্র ছিন্ন করে তবে তা দূরবর্তী ক্ষতি। ‘ক’ জাহাজটি যদি অসতর্কতার দরুন ‘খ’ জাহাজকে ধাক্কা মেরে ক্ষতিসাধন করে তবে এ ক্ষতির জন্য ‘ক’ দায়ী। কিন্তু নিকটবর্তী বন্দরে মেরামত করে পুনরায় যাত্রা শুরু করে ঝড়ের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ‘খ’ প্রশ্ন তুলতে পারে যে ‘ক’ তার ক্ষতি না করলে দেরী হতো না এবং সামুদ্রিক ঝড়ে পতিত হতো না। এক্ষেত্রে সামুদ্রিক ঝড় একটা স্বাধীন কাজ এবং এর দ্বারা উদ্ভূত ক্ষতি ‘ক’ এর অসতর্কতার প্রত্যক্ষ ফল নয়, অতি দূরবর্তী ক্ষতি।

(৪) তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন হস্তক্ষেপ যদি সঙ্গত ও স্বাভাবিক মনে হয় তবে তা কারণফলাফল যোগসূত্র ছিন্ন করে না এবং বাদীর ক্ষতি অতি দূরবর্তী হিসেবে গণ্য হয় না। ক্লার্ক বনাম চেম্বারস মামলার ঘটনার প্রকাশ, বিবাদী কাটাযুক্ত তারের বেড়া সড়কে রেখেছিল। একজন পথচারী সে পথে যাবার সময় ওটা সরায়ে ফুটপাথে রেখে দেয়। অন্ধকার রাতে সে পথে চলার সময় বাদী সে তারের জন্য আহত হয়। এ ক্ষতি বিবাদীর কার্যের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বিবেচিত হয়। জনতার ভিড়ের মধ্যে কেউ জ্বলন্ত পটকা নিক্ষেপ করলে যে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার নিকট পটকা নিক্ষেপকারী দায়ী যদিও ইতোমধ্যে পটকাটি কয়েক জনের হাত স্পর্শ করেছে এবং শেষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির নিকট বিস্ফোরিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ কারণ —ফলাফল যোগসূত্র ছিন্ন করে না।

(৫) যেক্ষেত্রে প্রধানত বাদীর বৈধ বা অবৈধ কার্যের দ্বারা ক্ষতি সংঘটিত হয় এবং বিবাদীর অসংগত আচরণের ফলে তা হয়েছে বলা যায় না সেক্ষেত্রে ক্ষতি অতি দূরবর্তী।

উদাহরণঃ

(ক) স্যান ওনোফ্রে মামলার ঘটনায় জানা যায় যে, ‘মেলানী’ নামক এক জাহাজ স্যান ওনোফ্রে’ নামক অপর এক জাহাজকে অসতর্কতার দরুন ধাক্কা মারে। এতে স্যান ওনোফ্রে’ সামান্য এবং ‘মেলানী’ বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘মেলানী’কে তীরে ভিড়তে সাহায্য করার জন্য ‘স্যান ওনোফ্রে’ তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায় বুঝতে না পেরে চওড়ায় উঠিয়ে দেয় এবং আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজ ‘মেলানী’র অসতর্কতার সাথে স্যান ওনোফ্রের দ্বিতীয় দফার ক্ষতির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ধরা যায় না বলে আদালত রায় দেন। তাই এ ক্ষতি অতি দূরবর্তী।

(খ) পিগনী নামক এক ব্যক্তি রাস্তার দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পায় এবং এ দুর্ঘটনার জন্য বিবাদী ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড মূলতঃ দায়ী । মাথায় আঘাত ক্রমে স্নায়ু রোগের সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনার ১৮ মাস পরে স্নায়ুরোগে হতাশ হয়ে পিগনী আত্মহত্যা করে। তার মৃত্যুর জন্য বিবাদীকে দায়ী করা হয়। আত্মহত্যা করা অন্যায় কাজ, কিন্তু এ কাজ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু -এ দু’য়ের যোগসূত্র ছিন্ন করে নাই বলে আদালত মত প্রকাশ করেন।

(৬) তৃতীয় পক্ষের বৈধ বা অবৈধ আচরণের ফলে বাদীর ক্ষতি অতি দূরবর্তী হতে পারে।

উদাহরণঃ

(ক) হ্যারনেট বনাম বণ্ড মামলার ঘটনায় প্রকাশ, বাদী প্রথম দিকে পাগল ছিলেন। পাগলা গারদে ২৮ দিন থাকার পর পরীক্ষামূলকভাবে তাকে ছাড়া হয়। ছাড়া পেয়ে তিনি পাগল সংক্রান্ত বিষয়ের কমিশনার বণ্ড এর সাথে দেখা করেন। উক্ত কমিশনার তখনো তাকে পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ২/৩ ঘন্টা তাকে আটক রেখে পাগলা গারদের তত্ত্বাবধায়ক আদমকে ফোনে বিষয়টি অবিহিত করেন। আদম বাদীকে ধরে নিয়ে আবার পাগলাশ্রমে দীর্ঘ ৯ বছর রাখেন। ছাড়া পেয়ে বাদী আদম ও বণ্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। প্রথম ২/৩ ঘন্টা আটক রাখা অন্যায় কার্য, কিন্তু পরবর্তী ৯ বছর আটক রাখা বৈধ, কেননা তা পাগল সংক্রান্ত আইন দ্বারা সমর্থিত ছিল (The Lunacy Act. 1890 S. 330)। কিন্তু এরূপ কাজ করার পূর্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার জন্য আইনের বিধান ছিল, যা যথাযথভাবে পালন করা হয় নাই। কমিশনার বণ্ড প্রথম ২/৩ ঘন্টা আটক রাখার জন্য দায়ী কিন্তু আদম কর্তৃক পরবর্তী আটকের ফলে বাদীর যে ক্ষতি হয় তার জন্য বাদী দায়ী নয়, কেননা এ ক্ষতি বণ্ডের কার্যের প্রত্যক্ষ ফল নয়, অতি দূরবর্তী ক্ষতি।

(খ) ক যদি খ এর নিকট মানহানিকর চিঠি দেয় এবং গ তা অননুমোদিতভাবে খোলে ও প্রকাশ করে তবে ক দায়ী নয়, কারণ প্রকাশনা যথাযথ হয় নাই।