প্রশ্নঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ ও সর্বধরেশ্বরবাদের মধ্যে পার্থক্য কী? তোমার কাছে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য?

অথবা, অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ ও সর্বধরেশ্বরবাদের মধ্যে পার্থক্য কী? তোমার কাছে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য? আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ দর্শনে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের সমন্বয় ঘটেছে। প্রত্যেকটা বিষয় আলোচনায় দর্শনে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তেমনি ঈশ্বরের সরূপ, জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক, মানুষের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে দর্শনে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। এই মতবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, সর্বধরেশ্বরবাদ প্রভৃতি এ মতবাদগুলোর সমর্থকরা নিজ নিজ মতবাদের পক্ষে অবস্থান করে ঈশ্বরের সাথে জাগতিক সম্পর্ক নিরূপণের প্রয়াস পান।

অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের মধ্যে পার্থক্যসমূহঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে আগে এদের সম্পর্কে জানা দরকার। তাই নিম্নে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের সংজ্ঞা উল্লেখপূর্বক পার্থক্য দেখানো হলো।

অতিবর্তী ঈশ্বরবাদঃ অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ “Delsm”। এ শব্দটি আবার এসেছে ল্যাটিন শব্দ Deus থেকে, যিনি স্রষ্টা ও’আইন প্রণেতা। এ মতবাদ অনুসারে অনন্তকাল ধরে ঈশ্বর একাই ছিলেন। নিম্নে সর্বেশ্বরবাদ ও সর্বধরেশ্বরবাদের পার্থক্য নিরূপণ করা হলোঃ 

(১) ঈশ্বরেরর সত্তাকে স্বীকারের দিক থেকেঃ সর্বেশ্বরবাদ শুধুমাত্র ঈশ্বরের সত্তাকে স্বীকার করে, কিন্তু জীব ও জগতের স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার করে না। পক্ষান্তরে, সর্বধরেশ্বরবাদ জগতের / ঈশ্বরের স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার না করলেও জীবের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে স্বীকার করে।

(২) ঈশ্বরের অবস্থানের দিক থেকেঃ সর্বেশ্বরবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর জগতের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে অন্তর্বর্তী, অর্থাৎ জগতের সবখানে সব জিনিসেই ঈশ্বর নিমোন। এ মতবাদ অনুসারে সবই ঈশ্বর, ঈশ্বরই সব। পক্ষান্তরে, সর্বধরেশ্বরবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর একই সাথে জগত ও জীবের মধ্যে অতিবর্তী এবং অন্তর্বর্তী।

(৩) ইচ্ছার স্বাধীনতার দিক থেকেঃ সর্বেশ্বরবাদ ইচ্ছার স্বাধীনতা স্বীকার করে না বলে এ মতবাদ আমাদের আত্মচেতনা, ধর্ম ও নৈতিকতার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে না। পক্ষান্তরে, সর্বধরেশ্বরবাদ জীবের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে স্বীকার করায়, এ মতবাদ আমাদের আত্মচেতনা, ধর্ম ও নৈতিকতার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে।

(৪) জীবের স্বাধীন সত্তার দিক থেকেঃ সর্বেশ্বরবাদ জীবের কোনো স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে না। কেননা এ মতবাদ অনুসারে সবই ঈশ্বর, ঈশ্বরই সব। তাই জীবের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই। পক্ষান্তরে সর্বধরেশ্বরবাদ জীবের স্বাধীন ইচ্ছাকে স্বীকার করায় জীবের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করে। কেননা এ মতবাদ অনুযায়ী, জীব তার নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

(৫) সর্বেশ্বরবাদ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় সম্পর্ককে দিক থেকেঃ সর্বেশ্বরবাদ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে, কিন্তু সমস্যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। পক্ষান্তরে, সর্বধরেশ্বরবাদ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়- এর সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে জ্ঞান সমস্যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে।

(৬) জগতের অস্তিত্বের দিক থেকেঃ সর্বেশ্বরবাদ এ জগতকে মিথ্যা মনে করে। এ মতবাদ অনুযায়ী, ঈশ্বর ব্যতীত জগতের কোনো স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। পক্ষান্তরে, সর্বধরেশ্বরবাদ জগত ও ঈশ্বরের Writer সম্পর্ককে স্বীকার করে। Writer এ মতবাদ অনুযায়ী জগত অলীক ও মিথ্যা নয়।

সর্বেশ্বরবাদ ও সর্বধরেশ্ববাদের মধ্যে যেটি অধিক গ্রহণযোগ্যঃ জীব ও জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কবিষয়ক এ মতবাদ দু’টির মধ্যে সর্বধরেশ্বর মতবাদই সন্তোষজনক ও যুক্তিগ্রাহ্য। কারণ এ মতবাদটির মধ্যে অতিবর্তী, ঈশ্বরবাদ এবং অন্তর্বর্তী ঈশ্বরবাদের সুষম সমন্বয় সাধিত হয়েছে। তা ছাড়া এ মতবাদ নানা কারণে সন্তোষজনক। এ মতবাদ সসীম ও অসীম ও অনন্তের যে সমস্যা। তার সমাধান করতে পারে, কারণ অসীম অনন্ত ঈশ্বর সান্ত সসীমের মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করেন। এ মতবাদ জীবের নৈতিকতা ও ধর্ম-সম্পর্কীয় অনুভূতির যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারে। সুতরাং সর্বেধরেশ্বরবাদ ধর্ম ও নৈতিকতা এবং জীবের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করছে। তাই এটি একটি সন্তোষজনক মতবাদ।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সর্বেশ্বরবাদ ও সর্বধরেশ্বরবাদের মধ্যে নানারকম পার্থক্য রয়েছে। সর্বেশ্বরবাদ মোতাবেক জগত ও ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। ঈশ্বরই সব এবং সবই ঈশ্বর। আর সর্বধরেশ্বরবাদ মোতাবেক জগত ও জীবনের বাইরেও ঈশ্বর ক্রিয়াশীল। তবে সার্বিক বিচারে এ দুই মতবাদের মধ্যে সর্বধরেশ্বরবাদই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। সর্বধরেশ্বরবাদ অধিকতর গ্রহণযোগ্য হলেও সর্বেশ্বরবাদ ও সর্বধরেশ্বরবাদ এ উভয় মতবাদেরই গুরুত্ব রয়েছে।