প্রশ্নঃ অতিপ্রাকৃত শক্তি কী? টোটেম ও ধর্মের সম্পর্ক সম্পর্কিত এমিল ডুরখেইমের ধারনা আলােচনা কর।

অথবা, অতিপ্রাকৃত শক্তি বলতে কী বুঝ? টোটেম ও ধর্মের সম্পর্ক সম্পর্কিত এমিল ডুর্খেইম-এর মতামত আলােচনা কর ।

ভূমিকাঃ ধর্ম একটি মৌল ও সর্বজনীন মানবীয় প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সব সমাজে সর্বাবস্থায়ই ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। নৃ-বিজ্ঞানী মার্ক বলেন, সব সমাজই কোনাে না কোনাে পন্থায় অতিপ্রাকৃত শক্তিকে তােষামােদ করে এবং নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে। পৃথিবীর সব সমাজেই মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, মৃত্যু পরবর্তী জীবন প্রভৃতিকে ঘিরে অসংখ্য আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এসব বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান থেকেই ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে।

অতিপ্রাকৃত শক্তিঃ অতিপ্রাকৃত শক্তি বা অতিপ্রাকৃত প্রত্যয়টি বর্তমানে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। পৃথিবীর সব ধর্মেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস। সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ ছাড়াও অতিপ্রাকৃতের ধারণা রয়েছে। ধর্মের বিভিন্নতা নির্ভর করে ঐ অতিপ্রাকৃতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে। অতিপ্রাকৃত বলতে সাধারণত প্রাকৃতের চেয়ে অধিকতর বেশি কিছু বুঝায় যা বােধগম্যে আসতে চায় না (It is something more than natural) । সুতরাং এই পৃথিবীতে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সবকিছুকে প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত এই দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এদিক থেকে প্রাকৃত বলতে সাধারণ বােধগম্য সবকিছুকেই বুঝানাে হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণে বলা যায়, কোনাে কিছুই স্বভাবজাতভাবে অতিপ্রাকৃত নয়। এটা নির্ভর করে মানুষ তার পরিবেশের প্রতি বা কোনাে বিষয়বস্তু কিভাবে দেখে বা কোনাে কোন দৃষ্টি তার উপর (Nothing is inherently supernatural, it depends on how people evaluate and look at things.) জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত পাশ্চাত্য সমাজের কাছে যা প্রাকৃত (Natural), অনুন্নত অনগ্রসর সমাজের কাছে তা অতিপ্রাকৃত (Supernatural) বলে বিবেচিত হতে পারে। অতিপ্রাকৃত তাই একটি আপেক্ষিক শব্দ।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুরখেইম তার ‘Elementary Forms of Religious life’ গ্রন্থে সব কিছু পবিত্র (Sacred) ও অপবিত্র (Profane) জগতে ভাগ করে বলেন যে, পবিত্র জগত অতিপ্রাকৃতের জগত, অস্বাভাবিক ও অসাধারণ জগত। অপবিত্র জগত দৈনন্দিন রুটিনমাফিক কর্মময় জগত, প্রাকৃতিক জগত। ধর্ম হলাে পবিত্র জগত তথা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস ও তৎসংশ্লিষ্ট কিছু আচার-আচরণ। বুদ্ধিমত্তার বিকাশের এক পর্যায়ে অতিপ্রাকৃতের ধারণা জন্মে। অন্যান্য প্রাণির মধ্যে অতিপ্রাকৃতের ধারণা নেই। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃতকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াস পাচ্ছে। ফলে সব অতিপ্রাকৃত প্রাকৃতিকরূপ নিতে পারে। আগামীতে প্রাকৃতবাদ কী অতিপ্রাকৃতবাদের পরিপূরক হবে? অর্থাৎ প্রাকৃতবাদ কী অতিপ্রাকৃতবাদের স্থান দখল করবে? অথবা অতিপ্রাকৃতবাদ বলতে কী কিছুই থাকবে না? এই প্রসঙ্গে নৃ-বিজ্ঞানী হােবেল বলেন যে, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট রায় দেয়ার সময় আসেনি। তবে তিনি বলেন যে, অবস্থাদষ্টে মনে হয়, প্রাকৃতবাদ অতিপ্রাকৃতবাদকে প্রতিস্থাপিত করবে। [Hobel, Anthropology, 3rd Edition P: 465-466)

টোটেমের সাথে ধর্মের সম্পর্কঃ টোটেম সম্পর্কে যারা আলােচনা করেছেন তাদের মধ্যে ডুরখেইম অন্যতম। নিম্নে তার টোটেম সম্পর্কিত আলােচনা তুলে ধরা হলাে-

ডুরখেইমের মতে টোটেমঃ ডুরখেইম আদি অস্ট্রেলীয় ট্রাইবালদের মধ্যে টোটেমের ধারণা লক্ষ্য করেছেন। বস্তত টোটেম ধারণা বা টোটেমবাদ হচ্ছে অনগ্রসর সমাজের এক ধরনের ধর্ম ও সংস্কৃতির নাম। টোটেমবাদ এমন এক ধরনের বিশ্বাস, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান যার মাধ্যমে কোনাে জনগােষ্ঠি কোনাে এক বিশেষ প্রাণি বা গাছের সাথে একটি আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তােলে। যে প্রাণি বা গাছের সাথে এ সম্পর্ক স্থাপন করা হয় তার নাম টোটেম প্রাণি বা টোটেম গাছ। ঐজনগােষ্ঠি নিজেদের সমাজের নাম ও নিজেদের নাম হিসাবে টোটেম প্রাণি বা টোটেম গাছের নামই গ্রহণ করে। যেমন: আদি অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারু গােত্র বা ক্যাঙ্গারু সমাজ। যে গােত্রবাসির টোটেম প্রাণি ক্যাঙ্গারু সেটা ক্যাঙ্গারু সমাজ। অর্থাৎ যে গােত্রবাসীর টোটেম প্রাণি ক্যাঙ্গারু সেটা ক্যাঙ্গারু গােত্র। ক্যাঙ্গারুকে ঘিরে তাদের বিশ্বাস, উৎসব ও আচার অনুষ্ঠান।

অস্ট্রেলীয় সমাজে টোটেমঃ ডুরখেইম বলেন যে, অস্ট্রেলীয়রা টোটেম প্রাণি বা টোটেম গাছের ছবি এক খণ্ড ডিম্বাকৃতির কাঠ বা পাথরে অংকিত করতে যাকে পবিত্র বলে মনে করা হত। টোটেমের ছবিসহ এ পাথর বা কাঠখণ্ডের স্থানীয় নাম চুরিংগা। ভুরখেইম বলেন, অস্ট্রেলীয় আরও কিছু গােত্র অবসর সময়ে চুরিংগাকে সামনে স্থাপন করে নাচ-গান করে সময় কাটাতাে। এমন অবস্থায় নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে, বাজনার তালে তালে তারা খেই হারিয়ে ফেলতাে। এ সময় তারা স্বাভাবিক জীবনে যা সম্ভবপর নয় সে কাজেও মত্ত হয়ে ওঠত। তারা যৌনাচারে লিপ্ত হতাে। কিন্তু পরক্ষণে নাচ-গান থেমে গেলে স্বাভাবিক হয়ে এ চিন্তাই করতাে যেকোনাে উচ্চতর অতিপ্রাকৃত শক্তি তাদেরকে দিয়ে উৎসবকালে যৌনাচার জাতীয় অসামাজিক কার্যাদি করিয়েছে।

চুরিংগা ও টোটেমঃ চুরিংগার মধ্যে তারা তাই এক নৈর্ব্যক্তিক শক্তির ক্রিয়া অনুভব করে যা হয়তাে। তাদের ক্ষণিকের জন্য অস্বাভাবিক করে তুলেছিল। ডুরখেইমের মত, এভাবে গােষ্ঠি আচরণ থেকে ধর্মের উৎপত্তি হতে পারে। তার মতে, চুরিংগা নামক টোটেম প্রতিকৃতি একদিকে যেমন গােত্রের প্রতীক আবার সেটা উৎসবকালে ভাবতন্ময়তার সময় ঈশ্বরের প্রতীক। যেহেতু একই প্রতীক একাধারে ঈশ্বর ও গােত্রের জন্য প্রযােজ্য। তাই ডুরখেইমের মতে, গােত্র ও ঈশ্বর এক। ডুরখেইম মনে করেন যে, সমাজ বা গােত্রই হচ্ছে ঈশ্বর (Society is but personified God)। তার মতে, একজন ব্যক্তির সাথে ঈশ্বরের যে সম্পর্ক, গােত্রের সাথেও তার একই সম্পর্ক । তার মতে, কোনাে ব্যক্তি ঈশ্বর ও সমাজকে বড় মনে করে, সম্মান ও ভয় করে। আবার ব্যক্তি বিপদকালে ঈশ্বর বা সমাজের সাহায্যও কামনা করে।

ডুরখেইমের সমাজতান্ত্রিক ও ক্রিয়াবাদী চিন্তাঃ ডুরখেইমের তত্ত্ব সমাজতান্ত্রিক এবং ক্রিয়াবাদী। কেননা তিনি বলেছেন যে, গােষ্ঠি আচরণের ফলশ্রুতি হলাে ধর্ম। আবার তার মতে, প্রাত্যাহিক কর্মজীবনের আনন্দ উৎসবকালীন এক প্রক্রিয়ায়ই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, টোটেম ধারণা বা টোটেমবাদ হচ্ছে অনগ্রসর সমাজের এক ধরনের ধর্ম ও সংস্কৃতির নাম, যার মাধ্যমে মানবগােষ্ঠি এক ধরনের বিশ্বাস গড়ে তুলতাে। আর এই বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হতাে নানা রকমের নাচ ও আচার-অনুষ্ঠান। তবে ধর্মের উৎপত্তি আলােচনায় টোটেম সম্পর্কিত ধারণার সমাজতাত্ত্বিক ভূমিকা অনস্বীকার্য কেননা প্রাত্যাহিক কর্মজীবনের আনন্দ-উৎসবকালিন এক প্রক্রিয়ায়ই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে।