উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রাকৃত গল্পগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মায়াজাল বিস্তার করে আছে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি। প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের এই বিশেষ ধরনের গল্পের এমন কলাকৌশল রহস্য নিবিড় বর্ণনাভঙ্গি, অপরূপ কল্পনার ঐশ্বর্য এবং এর সাথে অবাস্তব, অবিশ্বাস্য, অতিলৌকিক, রোম্যান্স এর উচ্ছ্বসিত সুর প্রবাহ বিদ্যমান।

গল্পটির পরিবেশ রচিত হয়েছে নদীর তীরে বরীচ নগরে আড়াইশ বছর আগেকার তৈরি দ্বিতীয় শাহ-মামুদের ভোগবিলাসের নির্জন প্রাসাদে গল্পকারের ভাষায়- “অনেক অতৃপ্ত বাসনা অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইয়াছে। সেই সকল চিত্তদাহে, সেই সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তর খণ্ড ক্ষুধার্ত হইয়াছে, সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে লালাইত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায়।”

এমনই রহস্যময় পরিবেশের মধ্যে লেখকের কল্পনা বিচিত্র সীমারূপ পরিগ্রহ করে। সেই অবাধ কল্পনা ও সংগীত প্রবাহের মধ্যে যেন অবাস্তব কোথাও কিছু নেই। তারপরেও মানব মনে ভয় এবং শরীরের নতুন শিহরণ জাগায়। তুলার মাশুল আদায়কারী নির্জন প্রাসাদবাসী যে ভদ্রলোক গল্পের নায়ক- সূর্যাস্তের পরক্ষণে সে আর নিজের মধ্যে থাকে না। সেই রহস্যময় প্রাসাদটি তার চারপাশে একটি ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য তাকে আহ্বান করে। তুলার মাশুল আদায়কারীর কাছে এক একটি রাত এক একটি স্বপ্ন জগতের মতো অতিবাহিত হয়। এ স্বপ্ন জগৎ হয়তো কখনো শেষ হতো না যদি না প্রতি প্রভাতে জনশূন্য পথে পাগল মেহের আলী ‘তফাৎ যাও’ বলে চিৎকার করতো। করিম খাঁর সতর্কতার সত্ত্বেও প্রতি রাতে গল্পকথক নির্জন প্রাসাদটিতে গমন করতো অন্য এক অলৌকিক শক্তির প্রভাবে। কেননা অনেক বছরের পুরনো প্রাসাদটির মধ্যে সে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পেত। যেমন-

“আবার সেইদিন অর্ধরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া বসিয়া শুনিতে পাইলাম, কে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে যেন আমার খাটের নিচে, মেঝের নিচে এই বৃহৎ প্রাসাদের পদার্পণ ভিত্তির তলবর্তী একটি আর্দ্র অন্ধকার ঘরের ভিতর হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে, তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও। কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া, তোমাদের সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও।”

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি কৌশলের দিক থেকে অনবদ্য বা অনন্য। তার প্রারম্ভিক ভূমিকা স্বল্প পরিসর। সমাপ্তি ও আকস্মিক অন্য একটি গাড়ি আসবার অবসরে স্টেশনের বিশ্রাম কক্ষে গল্পটি বর্ণনার সূত্রপাত এবং আরেকটি গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে গল্পটির আকস্মিক সমাপ্তি। এই গল্পে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ একান্তভাবে চিত্তবিকারজনিত নয়। পুরাতন প্রাসাদের অন্তঃপুরে বাসনাজালে আবদ্ধ দেহহীন লালসাময় রূপসীদের অদৃশ্য অবোধ প্রভাবের বলে যে সেখানে একাধিক রাত যাপন করেছে তার শরীর মন অল্পে অল্পে সেই প্রাসাদের মোহগ্রাসে জীর্ণ হতে হতে অবশেষে জীবন বা বুদ্ধি তিরোহিত হয়ে মৃত্যু অথবা পাগলে রূপান্তরিত হয়েছে। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ পাগলা মেহের আলী। তুলার মাশুল আদায়কারী ও এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। গল্পকারের ভাষায়-

“সমস্ত রাত্রি ঝড়ও থামে না ক্রন্দনও থামে না। আমি নিষ্ফল পরিতাপে ঘরে ঘরে অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম কেহ কোথাও নাই; কাহাকে সান্ত্বনা করিব। এই প্রচণ্ড অভিমান কাহার। এই অশান্ত আক্ষেপ কোথা হইতে উত্থিত হইতেছে।”

“ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটির কাহিনির বর্ণনাভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুর রহস্যময়তা একটি রসঘন শিহরিত পরিবেশ সৃষ্টি করে। সুতরাং ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি অতিপ্রাকৃত গল্প হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সার্থক সৃষ্টি। গল্পটির মধ্যে ভৌতিক পরিবেশ, জগৎ নির্মাণ, ভয় ও শিহরণের সঞ্চার, বাস্তবের সাথে অবাস্তবের একটি মায়াজাল সৃষ্টি অতিপ্রাকৃত গল্পেরই সার্থক রূপায়ণ।