শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা আদর্শবাদী মুখার্জি অনেক স্বপ্ন নিয়ে ল এজেন্টরূপে অঞ্জনগড় রাজ্যে কাজে যোগ দিয়েছিল। মুখার্জি সম্পর্কে ‘ফসিল’ গল্পের লেখক জানিয়েছেন, ইতিহাস পাঠে গণতন্ত্রের যে ভাবনা তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছিল সে তাকেই রূপায়িত করে অঞ্জনগড়ের উন্নতির সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করল। প্রজাদের ওপর রাজ্যের দমননীতি সে বন্ধ করল, বিভিন্ন দিক থেকে স্টেটের উন্নতির চেষ্টা শুরু হল তারই উদ্যোগে। রাজ্যের আয় বাড়াবার জন্য অঞ্জনগড়ের খনিগর্ভের সম্পদ কলকাতা থেকে মার্চেন্টদের ডাকিয়ে সে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাদের হাতে তুলে দিল। খনি অঞ্চল যে বাণিজ্যিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠল তাতে সামন্ততান্ত্রিক রাজার সম্পদ ও ভোগের উপকরণ প্রভূত পরিমাণে বাড়ল বটে কিন্তু গরিব প্রজা কুর্মীরাও খনিতে কুলির কাজ করে চরম দারিদ্র্য থেকে কিছুটা মুক্তি পেল। কিন্তু কৃষক সাধারণের উন্নতির জন্য তার আসল পরিকল্পনা অগ্রনা নদীর জলকে নতুন ইরিগেশন স্কীম করে অঞ্জনগরের পাথুরে জমিতে প্রবাহিত করে দিয়ে সোনা ফলান। বিনা সেলামিতে প্রত্যেক কুর্মী প্রজাকে মাথাপিছু পাঁচ বছরের জন্য বিনা খাজনায় এক বিঘা জমি দেওয়া, বছরে তিন কিস্তি ফসল তোলার ব্যবস্থা করা, একটি ব্যাংক স্থাপন, একটা ট্যানারী আর কাগজের মিল স্থাপন—এ সবই তার পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল অঞ্জনগড়েরর রূপ ফিরিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। স্কুল স্থাপনের আকাঙ্ক্ষাও মুখার্জির কিন্তু সে ব্যাপারে মহারাজার স্পষ্ট নেতিবাচক উত্তর।

মুখার্জির ধারণা ছিল সৎকর্ম ঠিকই সিদ্ধ হয় বাধা যতই আসুক। কিন্তু তার পরিকল্পনা রূপায়িত করতে গেলে মহারাজা ও বণিকদের মৌলিক স্বার্থে ঘা পড়বে এবং তারা প্রত্যাঘাত করবে—এ সম্ভাবনা তার হিসাবের বাইরে ছিল।

দুলাল মাহাতোকে ব্যবহার করে খনিমালিকরা রাজাকে উপেক্ষা করবার চেষ্টা করলে মুখার্জি সহজেই বণিকশ্রেণির চক্রান্ত বুঝতে পারে, বুঝতে পারে দুলালের দুঃসাহসের প্রেরণা জোগাচ্ছে কারা। সে প্রথমে দুলালকে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হল। তারপর সে গেল বণিকদের কাছে কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হল। বিদেশি বণিক গিবসন আর ম্যাককেনার কথোপকথন থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠল রাজ্যের এবং প্রজাদের উন্নতির জন্য মুখার্জির সমস্ত সৎপ্রচেষ্টাই তারা বানচাল করে দিতে বদ্ধপরিকর। ম্যককেনা গিবসনকে বলে, মুখার্জির ইরিগেশন স্কীমটা অবিলম্বে ভণ্ডুল করে দিতে পারলে সাংঘাতিক লেবার অভাবের মধ্যে পড়তে হবে। গিবসন জানায়, পোষা বেড়াল মাহাতোকে দিয়েই স্টেটের সব প্রচেষ্টাই ভণ্ডুল করে দেওয়া যাবে। বলাই বাহুল্য প্রচেষ্টাগুলি প্রধানত মুখার্জি সাহেবের আদর্শবাদজাত রাজ্যের কল্যাণকর প্রচেষ্টা। ব্যর্থ মুখার্জিকে রাজা জানায় ভেতরে ভেতরে বেনিয়াদের সঙ্গে তাঁর গোপন আঁতাত রয়েছে সে কথা তার অজানা নয়। মুখার্জি বিদায় চাইলেও রাজা তাকে ছাড়ে না।

কুর্মীরা জঙ্গলে লকড়ি কাটতে গেলে ফৌজদার গুলি চালালে বাইশজন নিহত আর পঞ্চাশের ওপর আহত হয়। রাজা এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে মুখার্জি মাহাতোকে আটক করতে বলে। মুখার্জির সৎকর্মগুলি সম্পর্কে রাজার আপত্তি বরাবরই থাকা সত্ত্বেও সে প্রত্যক্ষভাবে বাধা দেননি বা প্রথামিক অবস্থায় মুখার্জিকে বিতাড়িতও করেননি। ষড়যন্ত্র প্রধানত পাকাচ্ছিল ইংরেজ বণিকরাও যদিও তার প্রত্যক্ষ প্রকাশ তখনও পর্যন্ত অলক্ষিতই থেকে গেছে। মাহাতোকে আটক করার পরামর্শ দিয়ে রাজাকে বাঁচাতে গিয়ে মুখার্জি নিজেই তার সকল প্রচেষ্টার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। এটা নিশ্চিত বোঝা যায়, এ পরামর্শ না দিলেও তাকে সব কর্মপ্রচেষ্টা ত্যাগ করে অচিরেই বিদায় নিতে হত, কারণ নিপীড়িত কৃষককুল বা খনি শ্রমিকদের জন্য তার কল্যাণ প্রচেষ্টা বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ একদিকে তা আঘাত করছিল সামন্ততন্ত্রের স্বার্থে, অন্যদিকে আঘাত করছিল পুঁজিবাদী সংগঠনকে।

গল্পের সমাপ্তিতে যখন সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের সমঝোতা ঘটল এবং উভয়ের যৌথ প্রশংসা মুখার্জির লাভ হল, তখন বিবেককে শ্যাম্পেনের স্রোতে ডুবিয়ে মুখার্জির আত্মসমর্পণ ঘটল। এটা অনিবার্য ছিল, কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এককভাবে মুখার্জির ছিল না, সে শুধু ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে চলে যেতে পারত আত্মগৌরবকে ধূলায় লুটিয়ে না দিয়ে, অন্তত নিজের বিবেকের কাছে মুক্ত থাকতে পারত, কিন্তু সে আত্মসমর্পণ করেছে বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়ে।