গদ্যের মধ্য দিয়েই একটা জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যথার্থ সংবাদ পাওয়া যায়, কিন্তু শুধু কাব্যে কবিতা মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। তাই গদ্যকে বলা হয়েছে লেখক প্রতিভার ‘নিকষ-পাথর’। এই গদ্য রচনার মধ্য দিয়েই লেখকের যথার্থ প্রতিভা ধরা পড়ে। বিভিন্ন মনীষীর আর্বিভাবে বাংলা গদ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাভ করে ছিল। এমনই দুজন গদ্যে এক নিবন্ধকারের আবির্ভাব হল যাঁরা বাংলা মননশীল গদ্য সাহিত্যের দিকপাল বলে গণ্য হবার যোগ্য। তাঁরা হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে বাংলা গদ্যভাষার নিজস্ব প্রকৃতগত সৌন্দর্য প্রথম পরিস্ফুট হয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচনায়। গদ্য রচনায় তিনিই প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। সেই পথেই অক্ষয়কুমার কিংবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথচলা অনেকটা সম্ভব হয়েছিল।

অক্ষয়কুমার ও দেবেন্দ্রনাথ:

অক্ষয়কুমার দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই ভিন্নমুখী প্রতিভার মেলবন্ধন ঘটেছিল গদ্য রচনার মাধ্যমে। অক্ষয়কুমারের মন ছিল বিশ্লেষণধর্মী। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক কাজের একটা স্মরণীয় দৃষ্টান্ত। এই তথ্যনিষ্ঠ, বৈজ্ঞানিক মানসিকতা সম্পন্ন লেখক একাগ্র সাধনায় আধুনিক মানুষের বুদ্ধির পক্ষে অধিগম্য সকল বিষয় বাংলা গদ্যে আলোচনা করে প্রমাণ করে গেছেন যে এই ভাষা আধুনিক বিদ্যার সকল শাখারই যথার্থ বাহন হতে পারে। আবার অন্যদিকে অক্ষয়কুমারের মতো দেবেন্দ্রনাথের রচনা সংখ্যায় বিপুল নয়, কিন্তু তিনি একটি পরিচ্ছন্ন গদ্যশৈলী আয়ত্ত করেছিলেন। আধ্যাত্মিক উপলব্ধির গভীরতা এবং প্রখর সৌন্দর্য চেতনার ফলে দেবেন্দ্রনাথের ভাষায় একটি স্নিগ্ধ প্রশান্তির স্বাদ পাওয়া যায় যা তখনকার অন্য কোন লেখকের রচনায় দুর্লভ।

অক্ষয়কুমারের রচনাবলী :

বাংলা গদ্যের ইতিহাসে অক্ষয়কুমার দত্ত একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন থেকে অক্ষয়কুমার বুদ্ধিজীবী বাঙালী মানসের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বুদ্ধি ও আত্মপ্রত্যয় সিদ্ধ বিবেক ছাড়া তিনি আর কারও দাসত্ব করেননি। এমনকি ঈশ্বরেরও না। এই সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক পদে নিয়োগ করেন। এর ফলে তিনি নানাবিধ জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় সুযোগ পেলেন। সেই প্রবন্ধগুলি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয়কুমার অনেকগুলি পাঠ্যশ্রেণীর পুস্তিকা শিখেছিলেন যেমন—(ক) ভূগোল (১৮৪১) (খ) চারপাঠ (তিন খণ্ড ১৮৫৩-৫৯) (গ) পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬) (ঘ) ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম খণ্ড ১৮৭০, ২য় খণ্ড ১৮৮৩) (ঙ) বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম ও ২য় খণ্ড)।

গ্রন্থগুলি মূলত বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে ছাত্রদের জন্য রচিত তাঁর ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ গ্রন্থটি ‘The Constitution of man (1828) অবলম্বনে রচিত হয়েছিল এবং তার ‘ধর্মনীতি’ (১৮৫৬) গ্রন্থটিও কুম্বের Moral Philosophy অবলম্বনে রচিত—এতে তিনি জড়জীবন ও ঈশ্বরতত্ত্বের সমন্বয় সাধন করেছেন। অক্ষয়কুমারের কোন রচনাই ঠিক সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পর্যায়ে পড়েনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার বাহনরূপে তাঁর হাতে বাঙলা গদ্য এখন সরলতা এবং প্রঞ্জলতা লাভ করেছে যে আধুনিক শিক্ষিত মানুষের শিক্ষা দ্বারা লভ্য সকল বিদ্যাই এই ভাষায় আলোচনা করা সম্ভব।

রচনারীতির বৈশিষ্ট্যবস্তুত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অক্ষয়কুমার দত্ত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই তিন মনীষীর মিলনে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তন করে। তবে অক্ষয়কুমার দত্ত ও বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে যে পরিণতি দিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ সাহিত্য সৃষ্টিতে ততোটা মনোনিবেশ করতে পারেননি। অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন— “অক্ষয়কুমার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমবয়সী এবং প্রায় সমকালেই সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যে জাতীয় রচনা বাংলা ভাষায় দীর্ঘকাল বিদ্যাসাগরী রীতি বলে খ্যাতি ও অখ্যাতি অর্জন করেছে সে জাতীয় লেখক কিন্তু আসলে অক্ষয়কুমার।” সব মিলিয়ে বলতে হয় অক্ষয়কুমারের ভাষার বলিষ্ঠতা এবং ভারবহন ক্ষমতা যে বাংলা গদ্যভাষার সম্ভাবনাকে বহুদূর বিস্তৃত করেছিল এ বিষয়ে সংসারের অবকাশ নেই।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর:

ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মজাগরণ ও সামাজিক ঐতিহ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম লেখক। তিনি ছিলেন মূলত সমাজ ও ধর্মসংস্কারক। রামমোহন রায় এবং মহর্ষি দ্বারকানাথ ঠাকুর যে ব্রহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার বিকাশ ঘটেছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে।

দেবেন্দ্রনাথের রচনাবলী:

(১) ব্রহ্মধর্ম (১৮৪৮) (২) তত্ত্ববিদ্যা (১৮৫২) (৩) ব্রহ্মধর্মের মত ও বিশ্বাস (১৮৬০) (৩) ব্রহ্মধর্মের ব্যাম্যাল ১৮৬১ এবং ১৮৬৭ (৫) জ্ঞান ও ধর্মের উন্নতি (১৮৯০) (৬) জীবনচরিত (১৮৯৮) প্রভৃতি ছোট বড় অনেকগুলি গদ্য নিবন্ধে তাঁর গদ্যশিল্পীর প্রতিভা সুপ্রমাণিত হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ রচনা ব্রহ্মধর্ম ঘেঁষা তবে সমাজ সম্পর্কে তিনি উদাসী ছিলেন না। শিক্ষা প্রচার, ব্রহ্ম সমাজের আদর্শ বিস্তার, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রবর্তন এমনকি স্বাদেশিক ব্যাপারে ও তিনি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁর বিপুল গদ্য রচনার মধ্যে দু-ধরনের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তা হল—

  • গভীর ভাবোদ্যোতক গদ্যরীতি: “ভূলোক, দুল্যোকে আকাশে, অন্তরীক্ষে উষাকালে সান্ধ্যকালে প্রজ্ঞাবান একনিষ্ঠ বীরেরা সেই স্বপ্রকাশ আনন্দস্বরূপ, অমৃতস্বরূপ পরমেশ্বরকে সর্বত্র দৃষ্টি করেন। উষার উম্মীলনের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য উদিত হইয়া যখন অচেতন প্রাণীগণকে সচেতন করে, রূপহীন বস্তুসকলকে রূপ দান করে; তখন সেই জ্যোতিমান সূর্যের মধ্যে সেই প্রকাশবান বরণীয় পুরষকে তাহারা দেখিতে পান।” (১৮৬০ সালে প্রদত্ত বক্তৃতা)

  • সহজ সরল রচনা : “এই পৃথিবীর অতি পূর্বে একটি সুপ্রকাণ্ড অগ্নি গোলক ছিল। জীবজন্তু ওষধি প্রভৃতির চিহ্নমাত্র দেখা যাইত না। ক্রমে পৃথিবীর গাত্রে আচ্ছাদন পড়িল…..। উত্তাপে অগ্নি পৃথিবী হইতে বারম্বরে উত্থিত হইয়া পুনরায় জলরূপে পড়িতে লাগিল।

দেবেন্দ্রনাথের গদ্যে সাধুরীতি ও বর্ণনা প্রবণতার সঙ্গে তার অনুভূতি গুণও লক্ষণীয়। তাঁর গদ্যে সর্বদাই স্বচ্ছন্দ বিরাজিত তিনি সাহিত্যিক হিসাবে হয়ত কিছুটা ম্লান হলেও তাঁর বুদ্ধি বিচার কল্পনা শক্তি গভীর ও সূক্ষ্ম উপলব্ধি সমন্বিত অভিব্যক্তি তাঁর গদ্যে নিত্য নিত্য বিরাজিত ছিল।

তার গদ্য রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর একটি বিষয় হলো তাঁর পত্রাবলী। ১৮৫০ ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে নানা পত্রে তার যে যোগাযোগ ঘটে প্রিয়নাথ শাস্ত্রী কর্তৃক সেগুলি পত্রাবলীর অন্তর্ভুক্ত হয়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুদীর্ঘকাল বাংলা গদ্য রচনাকে সমৃদ্ধ করেছ তাঁর নানা ধরনের লেখনীর মধ্যে, সে সমাজ বিষয়ক হোক কিংবা ব্রহ্মতত্ত্ব বিষয় বা আত্মজীবনী সবেতেই তাঁর বলিষ্ট লেখনী ধারা মাধ্যমে বাংলা গদ্য সাহিত্যকে এক সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। সেই অর্থে দেবেন্দ্রনাথ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন বাঙালী পাঠকের কাছে চিরদিনই।