উদ্ধৃত পঙক্তিটি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বোধন’ কবিতার অংশ।
‘বোধন’ কবিতার সূচনাই হচ্ছে কোনো এক ‘মহামানব’কে আহ্বানের মধ্য দিয়ে। প্রগতিবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে দীক্ষিত কবি নিশ্চিতভাবেই ‘মহামানব’ বলতে কোনো ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন সত্তাকে আহ্বান করেননি। যে আহত বিপর্যস্ত সময়ে বাংলার ইতিহাসে সাধারণ মানুষকে লোভ ও ষড়যন্ত্রের বলি হতে হয়েছে, সে সময় যথার্থ ইতিহাসবোধ বা কালচেতনাকেই আহ্বান করেছেন কবি। অথবা বলা যায়, ‘মহামানব’ বলতে এখানে সাধারণ মানুষের সংহত বৈপ্লবিক চেতনাকেই তিনি আহ্বান করেছেন।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ বা ১৩৫০ বঙ্গাব্দ বাংলার ইতিহাসে এক ভয়ংকর মৃত্যুময় সময়। ইতিহাসে এই বছরটি পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্য কুখ্যাত। বাংলার লক্ষ গ্রাম তখন দুর্ভিক্ষ তথা মন্বন্তরের কালো থাবায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সেই মন্বন্তরের পটভূমিতেই ‘বোধন’ কবিতাটি রচিত।
১৯৪২-এর এপ্রিলে জাপানিদের হাতে বর্মার পতনের ফলে বাংলায় ব্রহ্মদেশ থেকে চালের আমদানি বন্ধ হয়ে গেল। ফলে চাহিদার তুলনায় চালের জোগান বাংলায় অনেকখানি কমে গিয়ে একটা অন্নাভাব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এটাই দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ ছিল না। খরা এবং বন্যাকে অনেকে দুর্ভিক্ষের কারণ হিসাবে দেখাতে চান। কিন্তু সেটাও দুর্ভিক্ষের আসল কারণ ছিল না। পঞ্চাশের মন্বন্তর ছিল প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যসৃষ্ট। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সৈন্যদের জন্য প্রচুর পরিমাণে ধানগম ও খাদ্যশস্য সঞ্চয় করেছিল। ফলে সাধারণ মানুষের অন্নে টান পড়েছিল। দ্বিতীয়ত যুদ্ধের কারণে ব্যতিব্যস্ত থাকায় ব্রিটিশ ভারতের প্রসাসন যন্ত্রও প্রায় ভেঙে পড়েছিল। সেই প্রশাসনিক শৈথিল্যের সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ী, সুযোগসন্ধানী জোতদার-মজুতদার ও কালোবাজারীর দল প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ফলে তারা ধানচাল গুদামজাত করে অবৈধভাবে কৃত্রিম অন্নাভাব সৃষ্টি করেছিল। গ্রামের সম্পন্ন কৃষক ও জোতদারেরা লুঠের ভয়ে ধানচাল শহরের গুদামে এনে লুকিয়ে ফেলেছিল। সেখানে অগ্নিমূল্যে সেইসব ধান চাল বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করছিল তারা।
এই পরিস্থিতিতে বাংলার পল্লী-অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবেই ভেঙে পড়েছিল। কৃষিজীবী মানুষ অন্নের অভাবে প্রথমে তৈজসপত্র, হালবলদ এবং শেষে ভিটে-জমি পর্যন্ত মহাজনের কাছে বিক্রি করে অন্নসংস্থানের চেষ্টা করেছিল এবং তারপর তারা দলে দলে গত্বে ও শহরের রাস্তায় স্টেশনে-ফুটপাতে এসে ভীড় করেছিল। কৃষক পরিণত হয়েছিল পথের কঙ্কালসার ভিক্ষুকে। কলকাতায় রাজপথ ‘ফ্যান দাও’ আর্তনাদে ও শবদেহে নরকের চেহারা নিয়েছিল। সমস্ত গ্রাম বাংলা এবং সেইসঙ্গে কলকাতাসহ বাংলার শহরগুলিতেও নেমে এসেছিল মৃত্যুর ও সর্বনাশের কালো ছায়া। এই অবস্থায় কবি মানুষের কালচেতনাকে কিংবা সংঘবদ্ধ গণচৈতন্যকে (‘মহামানব’) বাংলার নৈরাশ্যলাঞ্ছিত মৃত্যুময় পটভূমিতে আহ্বান করেছেন।
‘মহামানব’কে বাংলার এই সর্বনাশের পটভূমিতে কবির আহ্বানের কারণ নৈরাশ্যের অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলে প্রতিরোধী চৈতন্যে সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করে তোলা। কবি অনুভব করেছেন, একান্ত হতাশায়, অস্তিত্বের বিপন্নতায় আত্মসমর্পণ করলেও এই সমূহ সর্বনাশ থেকে মুক্তির পথ পাওয়া যাবে না। বরং ‘ধূর্ত-প্রবন্ধক’ জোতদার-মহাজন-কালোবাজারীদের লোলুপতা, অমানবিক ষড়যন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী কুচক্রীদের দ্বারা সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষের চরম আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে প্রাণশক্তি হারিয়ে নিশ্চেষ্ট প্রতিরোধহীনভাবে শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনলে। আসলে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রশ্রয়ই দেওয়া হবে। এই প্রতিরোধহীনতা যথার্থ ইতিহাসচেতনার পরিচায়ক নয়। কবি তাই ‘মহামানব’কে আহ্বান করেছেন সংহত সংঘবদ্ধভাবে জনচৈতন্যকে প্রতিরোধী ভূমিকায় উজ্জীবিত করে তোলার জন্য। প্রাণরসহীন এই সময়ের ‘শুকনো পাতায়’ সংগ্রামের ‘আগুন’ জ্বালার স্বপ্ন কবির এই সংগ্রামী ভূমিকার উদ্বোধনের জন্যই ‘মহামানব’কে আহ্বান করেছেন কবি।
Leave a comment