লাল কাঁকুরে মাটির দেশ বীরভূমের কোপাই নদীর তীরে বাঁশবাদি অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে পুরুষ পরম্পরায় বাস করে কাহারেরা। বর্তমানে যেসব কাহার এখানে বাস করে তাদের মাতব্বর বনওয়ারী। সকলেই এখানকার অরণ্য প্রকৃতির সঙ্গে এমন মিশে গেছে যে-কোনাে চরিত্রকেই প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না। তারা হয়ে ওঠে আরণ্যক। তাদের স্বভাব বৈশিষ্ট্যকে লেখক পরিচয় করিয়ে দেন হাঁসুলী বাঁকের কোনাে না কোনাে নৈসর্গিক উপাদানের সাহায্যে। মাতব্বর বনওয়ারী স্বভাবে ভালােমানুষ, শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু যখন সে বিদ্রোহ করে তার ওপর ভর করে আসুরিক শক্তি এ বনওয়ারী তখন ‘বিধাতার মােটা হাতে পাথর কেটে গড়া।’ সুঁচাদ পিসি চিররহস্যময়। নানা উপকথা বলে সে কাহারদের বশে রাখতে চেষ্টা করেছে। সে বলে, বাবা কালারুদ্দের নির্দেশ যেন কেউ অমান্য না করে। এই ‘আদ্যিকালের বুড়ি’ সুচাদ পিসি অকারণে কাঁদে, ‘বােমা ফাটার মতাে’ ফেটে পড়ে, ছােটো সামান্য ঘটনাকে অসামান্য করে দেখে। তার প্রকৃতিটাই ‘অরণ্য অর্থাৎ অরণ্যের মতাে’। লেখক বলেছেন, “অরণ্য যেমন মাতলে ঝড় ওঠে, কাঁদলে বর্ষা নামে, তেমন পিসি তিলকে করে তাল, উইটিপিকে করে পাহাড়, কাঁদলে গগন ফাটিয়া চেঁচায়….” কালােশশী, ‘কোপাই নদীর দহ’ পাখি পাখির মতােই চঞ্চলা, আষাঢ় মাসে ঘনমেঘে তাল চড়ুই যেমন নেচে নেচে ওঠে পাখিও সেরকম নাচে। নখ আর ঠোট দিয়েই সে বিরােধী পক্ষকে ঘায়েল করে। আর সুবাসীর চোখ দুটো, ‘ঠিক সাপের মতাে’। পাগল কাহার ‘নীলের বাঁধের জলের মতাে’। আকাশের রং-এর নীলের বাঁধের জলের রং বদলায়, অনুরূপ পাগলের কাছেও কাহার পাড়া আকাশ। ‘কাহার পাড়া হাসলে সে হাসে কাঁদলে সে কাঁদে।’ ‘নিমতেলে পানু’ নিমগাছের মতােই বুঝি তেতাে। কোনাে ঘটনাকেই সে সহজে ছাড়ে না। তার ঘাের প্যাচের কথা কাহারদের মনে তিক্ততার স্বাদ আনেই। এইভাবেই চরিত্রগুলি হয়ে ওঠে হাঁসুলী বাঁকের চঞ্চল প্রকৃতির প্রতীকরূপ।
প্রকৃতির বস্তুধর্মী বর্ণনায় হাঁসুলীবাকের প্রাকৃতিক পরিবেশ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। এ প্রকৃতি যেন হাঁসুলী বাঁকের নিজস্ব। পারিপাশ্বিক সৌন্দর্য নিয়ে হাঁসুলীবাক হয়ে ওঠে বড়াে মনােরম। এখানকার রাত্রির বর্ণনা দিচ্ছেন লেখক এইভাবে- “হাঁসুলীবাঁকে রাত্রি প্রভাত হয় পৃথিবীর সঙ্গেই যথা নিয়মে। গাছে গাছে পাখি ডাকে। ঘাসের মাথায় রাত্রের শিশির বিন্দু ছােটো ছােটো মুক্তোর দানার মতাে টলমল করে। বাঁশবনের মাথা থেকে বনশিরিষ, নিম, আম, জাম, কাঁঠাল, শিরিষ, বট, পাকুড়ের মাথা থেকে টুপটাপ করে শিশির বিন্দু ঝড়ে পড়ে মাটির বুকে। যে ঋতুতে যে ফুল ফোটার কথা সেই ফুল ফোটে। পূর্বদিকে নদীর ধার পর্যন্ত অবারিত মাঠের ওপারে—কোপাইয়ের ওপারের গ্রাম গােপগ্রামের চারিপাশে গাছপালার মাথায় সূর্য ওঠে।”
হাঁসুলীবাকের প্রকৃতি নবরূপ ধারণ করে হেমন্তঋতুতে। মাঠে কতাে না পাকা ধানের লাবণ্য, রবিফসলের সবুজ রূপ হাঁসুলী বাঁককে বড়ােই সৌন্দর্যময়ী করে তােলে। লেখকের বর্ণনায় সেই প্রাকৃতিক পরিবেশটি অপূর্ব। “কার্তিক অগ্রহায়ণ হাঁসুলীর বাঁকের উপকথায় পালনের মাঠে রং হয় সােনার বরণ। ঝিরঝির হিমেল বাতাস, পাকা ধানের গন্ধে ভুরভূর করে। ….আউশের মাঠে আউশধান উঠে গিয়ে রবি ফসলের সবুজ ভরে ওঠে। গম, কলাই, আল, যব, সরষে তিসির অঙ্কুরে রােমাঞ দেখা যায়। হিলে হিলে বাশবনের মাথা উত্তরের বাতাসে দুলতে থাকে। আকাশে উড়ে নেচে বেড়ায় নতুন পাখির দল। দুপুরের রােদ চনচন করে, রাত্রিবেলা গা সিরসির করে”। প্রকৃতির এই পরিবেশ অঙ্কনে তারাশঙ্কর হয়ে উঠেছেন কবি।
চৈত্রসংক্রান্তি শেষ মানে বছরের ও শেষ, সেই বছরের পরিসমাপ্তি বােঝা যায় গােটা বাঁশবনের চাঞ্চল্যের মধ্য দিয়ে “হাঁসুলী বাঁকের বাঁশ বনে আদ্যিকালের অন্ধকার চাঁকে চকে অর্থাৎ চমকে চমকে উঠল, কীটপতঙ্গ পশুপাখিরা কলকল করে উঠল। সাপেরা গর্তের মধ্যে পাক ঘুরে ফণা তুললাে, জন্তু জানােয়ার গা ঝাড়া দিলাে। তারাও জানলে বছর শেষ হল” গােটা প্রকৃতি যেন কাহারদের মতােই ব্যক্তিত্ব পেয়ে যায়। প্রকৃতির মধ্য এইভাবে ব্যক্তিত্ব আরােপ করে তারাশঙ্কর হাঁসুলীর্বাকের প্রকৃতিকে দুর্দান্ত, স্বতন্ত্র স্বভাব বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন করে তােলেন। হাঁসুলি বাঁকের কালবৈশাখী ঝড় যেন দৈত্যের চেহারা নেয়। লেখকের বর্ণনায় তা অপূর্ব হয়ে ওঠে- “কালো মেঘের গাঁয়ে রাঙামাটির ধুলাের লালচে দোলাই অর্থাৎ চাদর উড়ছে। কালাে মেঘের কষ্টি পাথরে গড়া বাবা কালরুদ্রের রক্তরাঙা পাটের কাপড় যেন ফুলে ফুলে উঠছে। হাঁ হাঁ করে হাঁকতে হাঁকতে আসছে। দুহাত দোলাতে দোলাতে বুক দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সামনে যা পাবে সাপটে জাপটে ধরে তুলে মেরে ফেলতে ফেলতে ছুটে চলে পাগলা হাতির মতাে, শিঙ বাঁকানাে বুনাে মােষের মতাে, গাছ ভাঙে মাঝখান থেকে, ডাল ও ভাঙে। মূলসুদ্ধ উপড়ে পড়ে, পাতাকুল ছিড়ে কুটে সারি সারি।” কড়া মাটির দেশ এই হাঁসুলীর বাঁক। মাটিতে কোপ দিলে আগুন ঠিকরে পড়ে। সবমিলে হাঁসুলী বাঁকের প্রকৃতি হয়ে ওঠে সজীব ব্যক্তিসত্তাময়, এছাড়া, এই উপন্যাসের স্বল্পজ্ঞাত অজ্ঞাত জনগােষ্ঠীর জীবনের উপকথা বলতে গিয়ে তারাশংকর কয়েকটি অজ্ঞাত নিসর্গের ব্যবহারও করেছেন। যেমন বাবাঠাকুরের থানের বর্ণনা, অসুরের কাঁড়ি, বনওয়ারীর চড়ক চাপার স্থানের বর্ণনা, শিমূল গাছের বর্ণনা প্রভৃতি।
সবশেষে বলা যায়, প্রকৃতি এ উপন্যাসের একটি বিশেষ চরিত্র হয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে। ব্যক্তিজীবন ও গােষ্ঠী জীবনে অমােঘ প্রভাব বিস্তারকারী বাঁশবাদী গ্রামের আকাশ, মাটি, জল, বৃক্ষ, প্রাণী, পূজার থান, সমন্বিত আদিম বিশ্বাসের প্রাকৃতিক জগৎটি সমগ্র উপন্যাসটির মধ্যে পরিব্যাপ্ত। প্রকৃতি এখানে কখনাে বা চরিত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধে বাঁধা পড়েছে, কখনাে চরিত্রের সুখ দুঃখে নিজেও উদ্বেলিত হয়েছে, কখনাে চরিত্রগুলির সুখ দুঃখ, সৌভাগ্য, দুভার্গকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। সমগ্র কাহিনিটিরই যেন সে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ উপন্যাসে নায়ক বিচারে বনওয়ারী করালীর পাশে বাঁশবাদীর প্রকৃতিকেও এক যােগ্য প্রতিযােগী হিসাবে স্বীকার না করে উপায় থাকে না।
Leave a comment