প্রশ্নঃ হযরত ওমর (রা)-এর চরিত্র আলােচনা কর।

অথবা, হযরত ওমর (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলি আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মহানবী (স)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারা ধন্য হয়েছেন, হযরত ওমর (রা) ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি অজ্ঞতার যুগে যেমন উত্তম। ব্যক্তি হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি ইসলাম গ্রহণ করেও ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাই মহানবী (স)-এর বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে “অজ্ঞতার যুগে তােমাদের যারা উত্তম ছিল, ইসলামেও তারাই উত্তম”।

হযরত ওমর (রা)-এর চারিত্রিক গুণাবলিঃ

১. জ্ঞানানুরাগ ও পাণ্ডিত্যঃ হযরত ওমর (রা) জ্ঞানচর্চার অনুরাগী ছিলেন। বিদ্বান ও বাগী হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিল। কুরআন ও হাদীসে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। সামরিক বিজ্ঞান ও কৌশলের জন্য তিনি সমগ্র আরবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।

২. ন্যায়বিচারকঃ বিচারে তিনি ছিলেন অতি কঠোর। তিনি বিশ্বাস করতেন, আইন কাউকে ক্ষমা করে না। বিচারে তার নিকট মুসলিম-অমুসলিম, উচু-নীচু, আপন-পর সবাই সমান ছিল। তিনি স্বীয় পুত্রকেও মদ্যপান করার দায়ে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন।

৩. আদর্শবাদীঃ মহানবী (স)-এর রেখে যাওয়া আদর্শ ছিল তার একমাত্র পাথেয়। তার মতাে আদর্শ নেতা ধরণীতে বিরল।

৪. চারিত্রিক দৃঢ়তাঃ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি যে দৃঢ় অভিমত পােষণ করেছেন তার প্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনে ২৩টি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। এজন্যই মহানবী (স) বলেন, আমার পরে যদি কেউ নবী হতাে তাহলে হযরত ওমর (রা)-ই নবী হতাে, কিন্তু আমার পরে আর কোনাে নবী নেই।

৫. ন্যায়পরায়ণতাঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায় অকল্যাণ বিদূরিত করে হযরত ওমর (রা) ন্যায়ভিত্তিক শাসন পরিচালনা করেন।

৬. সম্পদের প্রতি অনীহাঃ ধন-সম্পদের প্রতি ওমর (রা)-এর ছিল তীব্র অনীহা। জাক-জমক ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। তিনি মনে করতেন বিলাসিতা মানব জীবনের সরলতা ও পবিত্রতা নষ্ট করে।

৭. প্রজাবৎসল শাসকঃ হযরত ওমর (রা) ছিলেন প্রজাবৎসল শাসক। তিনি সর্বদা প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশা মােচন এবং সুখ-শান্তি বিধানে মগ্ন থাকতেন। তিনি রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করতেন। খলিফা স্বয়ং আটার বস্তা মাথায় বহন করে দুঃখী প্রজার গৃহে পৌছে দিতেন।

৮. মানবদরদিঃ একদা জনৈক বেদুইনের স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি নিজের স্ত্রীকে বেদুইনের স্ত্রীর খেদমতের জন্য নিয়ােগ করে মানবদরদি হিসেবে নিজেকে ধরণীর বুকে চিরস্মরণীয় করে রাখেন।

৯. সাম্য, সততা ও মানবতাবাদীঃ হযরত ওমর (রা)-এর সময়ে সর্বস্তরের মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কেউ বেআইনী কোনাে অতিরিক্ত সুযােগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারত না। তার দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান মানবিক মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী ছিল।

১০. অনাড়ম্বর জীবন যাপনঃ বাস্তবিকই তার সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা ছিল বিস্ময়কর। গাত্রাবরণ বলতে তার বহু তালিবিশিষ্ট একটি মাত্র জামাই ছিল। তার প্রধান খাদ্য ছিল সামান্য রুটি বা খেজুর। ধন ঐশ্বর্যের প্রতি ছিল তার প্রবল অনীহা।

১১. কোমল ও কঠোরের সংমিশ্রণঃ হযরত ওমর (রা)-এর চরিত্রে কঠোরতা কোমলতার চমৎকার সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। এজন্য মহানবী (স) বলেছেন, আল্লাহর কাছে ওমর যত শক্ত ও কঠোর, আমার উম্মতের মধ্যে দ্রুপ আর কেউ নেই।

১২. কর্তব্যনিষ্ঠাঃ ঐতিহাসিক মুইর বলেন, সরলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল হযরত ওমর (রা)-এর মুখ্য নীতি। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি বায়তুল মাল থেকে দৈনিক মাত্র দু’দিরহাম গ্রহণ করে অতি কষ্টে জীবনযাপন করতেন।

১৩. সত্য প্রতিষ্ঠায় আপসহীনঃ আল্লামা শিবলী নােমানী বলেন, সত্য প্রতিষ্ঠায় হযরত ওমর (রা) ছিলেন আপসহীন। অপরাধী প্রমাণিত হলে কোনাে শাসনকর্তাকে পদচ্যুত করতেও তিনি দ্বিধাবােধ করেননি।

১৪. দাসপ্রথার বিলােপ সাধনঃ ঐতিহাসিক মােহাম্মদ আলী বলেন, দাসপ্রথা বিলােপে গৃহীত পদক্ষেপ হযরত ওমর (রা)-এর অন্যতম কৃতিত্ব। অমুসলিমদের প্রতিও তিনি ছিলেন একান্ত সহানুভূতিশীল।

১৫. অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারীঃ তিনি কুরআন হাদীসে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ফিকশাস্ত্রের এক হাজার মাসয়ালা সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, পরবর্তী ফকীহরাও তা সমর্থন করেন। এজন্য অধ্যাপক হিট্টি বলেন- In fact, ‘Omar, whose name according to Muslim tradition is the greatest in early Islam after that of Mohammad (SM).

১৬. ইসলামী বিধি-বিধানের একনিষ্ঠ সেবকঃ হযরত ওমর (রা) ইসলামের মূল আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য এবং সকল বিধি-বিধানের প্রতি কর্তব্য পালনে ছিলেন মহানবী (স)-এর সার্থক প্রতিচ্ছবি। বদর, উহুদ, খন্দক, হেনাইন ও খায়বার যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। তাবুক অভিযানের পূর্বে মহানবী (স)-এর আহ্বানে তিনি তার সম্পত্তির অর্ধেক আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেন।

উপসংহারঃ হযরত ওমর (রা) তার চরিত্র মাধুর্য এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দ্বারা | শুধু মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎই গড়ে তােলেননি, তাদের নিজস্ব ইতিহাসও সৃষ্টি করেছেন। তাই ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, The death of Omar was a real calamity to Islam.